প্রাণের স্পন্দন থাকবে তো?
বিজ্ঞান সাময়িকী 'এস্ট্রোনমি অ্যান্ড এস্ট্রোফিজিক্স'-এ গবেষণা পত্রটি
প্রকাশিত হবার পর মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু এই প্রশ্নটিই। সম্প্রতি সূর্য থেকে প্রায় ২২ আলোকবর্ষ (২০৭ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার) দূরে 'গ্লিসে ৬৬৭ সি' নামক নক্ষত্রে
পৃথিবীর মত তিনটি বসবাস যোগ্য গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে। এই গ্রহ তিনটিতে জল থাকার সম্ভাবনা প্রবল। আর জল থাকলেই প্রাণ ...।
এই বিশাল মহাবিশ্বে শুধু পৃথিবী নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রহে প্রাণের
অস্তিত্ব থাকবে সেটা কখনোই মেনে নেওয়া যায়না! অগণিত নক্ষত্র খচিত রাতের আকাশে তাকালেই নানা প্রশ্ন মনের জানালায় উঁকি দেয়। এই মহাবিশ্বে কি আমরা একা? সৌরজগতের বাইরে কি কোনও গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে না? যদি ভিনগ্রহী মানুষ থেকে থাকে, তবে কি অতীতে তাদের পদার্পণ
ঘটেছিল এই গ্রহে? বহির্বিশ্বের উন্নত প্রাণীদের সঙ্গে যোগাযোগ
করা কি সম্ভব হবে? প্রশ্নগুলির উত্তরের সন্ধানে বিজ্ঞানীরা তাঁদের
গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন, কিন্তু এর উত্তর আমাদের কাছে আজও অধরা। উত্তর না মিললেও কল্পনার জগতে কিন্তু আমরা রচনা করে চলেছি নিত্য
নূতন সৃষ্টি। উপন্যাস, গল্পে তাই আবির্ভাব ঘটেছে ভিনগ্রহী মানুষ বা
'এলিয়েন'-দের যারা নাকি মানব সভ্যতা থেকেও উন্নত। আর্থার সি ক্লার্ক, কলিন হার্ভে, উইলিয়াম হিগস্মিথ ইত্যাদি কল্পবিজ্ঞান খ্যাত
লেখকদের কলম থেকে সৃষ্টি হল রোমহর্ষ কারি অবিশ্বাস্য গল্প। সাহিত্যের অঙ্গন থেকে ধীরে ধীরে তাঁদের ঠাই হতে লাগলো সেলুলয়েডের
পর্দায়। হলিউডের ম্যাজিক স্পর্শে 'ই টি', 'সুপারম্যান', 'ম্যান ইন
ব্ল্যাক' ইত্যাদি মুভি বিশ্বের বাজার দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। পিছিয়ে নেই বলিউড...'কোই মিল গয়া' মুভিটিও সবার হৃদয় স্পর্শ করল।
দূরবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কার রাতের রহস্যভরা আকাশকে নিয়ে এলো
কাছে। ধীরে ধীরে মহাবিশ্বের রহস্য আমাদের কাছে পরিষ্কার হতে লাগল। কিন্তু সৌরজগতের বাইরে কোনও নক্ষত্রে গ্রহের উপস্থিতি পরীক্ষামূলক
ভাবে প্রমাণ করা যাচ্ছিলো না। আর এর মূল কারণ হচ্ছে দূরত্ব। আসলে নক্ষত্রের আলোতেই আলোকিত হয়ে ওঠে গ্রহ। আর দূরত্ব বাড়লে অতি শক্তিশালী দূরবীন দিয়ে পৃথিবী থেকে দূরবর্তী
গ্রহকে চিহ্নিত করা মুশকিল। তখন পরোক্ষ উপায়ের উপর নির্ভর
করা ছাড়া উপায় থাকেনা। বিজ্ঞানীরা উন্নত প্রযুক্তির
সাহায্যে ১৯৮৮ সালে প্রথম সৌরজগতের বাইরে গ্রহের সন্ধান পান। শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। বাকিটা ইতিহাস। সৌরজগতের বাইরে নূতন গ্রহের
অস্তিত্ব জানার তাগিদেই 'কেপলার'-এর জন্ম। এখন পর্যন্ত ১৩২টি গ্রহ আবিষ্কারের
কৃতিত্ব তার ঝুলিতে। ওহ! বলতেই ভুলে গেছি, 'কেপলার'
আসলে কোনও মানুষ নয়, সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
মহাকাশ সংস্থা 'নাসা' প্রেরিত একটি মহাকাশযান,
যার মধ্যে রয়েছে অত্যাধুনিক দূরবীক্ষণ যন্ত্র। এছাড়াও রয়েছে নানা সূক্ষ্ম যন্ত্রাদি। জার্মানির বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলারের নামানুসারেই
তার এই নাম, যাকে গত ৭ মার্চ ২০০৯ সালে
পৃথিবী থেকে প্রেরণ করা হয়েছিল। তারপর থেকেই তার জয়যাত্রা
অব্যাহত। কেপলার বেঁচে থাকলে এই আবিষ্কারের
খবরটা পেয়ে উল্লাসে তিনি মেতে উঠতেন সন্দেহ নেই! প্রতি মাসেই নিত্যনুতন গ্রহের খবর কেপলার আমাদের উপহার দিচ্ছে। আর নূতন গ্রহ আবিষ্কার হলেই আমাদের মনে সেই চিরাচরিত প্রশ্ন
জাগে-'প্রাণ আছে তো গ্রহটিতে'?
বিজ্ঞানের তত্ব মতে জল বিনা কোনও প্রাণ টিকে থাকতে পারেনা। তাই কোনও গ্রহে প্রাণ থাকতে হলে তরল জল থাকা আবশ্যক। গ্রহে জল থাকবে কিনা তা নির্ভর করে নক্ষত্র থেকে সেই গ্রহের
দূরত্বের উপর। কারণ জল তরল থাকতে গেলে তাপমাত্রা
অবশ্যই শূন্য ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে একশো ডিগ্রীর ভেতরে হতে হবে। আমাদের এই সৌরজগতের খুব কাছের গ্রহ বুধ আর শুক্র সূর্যের খুব
কাছে থাকার জন্য জল বাষ্পীভূত হয়ে যায়। আর পৃথিবীর পরে যে গ্রহগুলি
রয়েছে যেমন মঙ্গল, বৃহস্পতি,
শনি ইত্যাদি গ্রহে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রী থেকে কম হওয়ায় সেখানেও জল
তরল অবস্থায় থাকতে পারেনা। সূর্য থেকে প্রায় পনেরো কোটি
কিলোমিটার দূরত্বে জল তরল অবস্থায় থাকতে পারে। আর আমাদের পৃথিবী রয়েছে তেমন দূরত্বে। যে বলয়ের মধ্যে জল তরল অবস্থায় থাকতে পারে তাকে 'হেবিটেবল জোন' বা
'বসবাস যোগ্য বলয়' বলা হয়। বলা-বাহুল্য যে এই
সৌরজগতে শুধু পৃথিবীই এই বলয়ের মধ্যে রয়েছে, তাই প্রাণের বিকাশ
সম্ভব হয়েছে এই গ্রহে। নক্ষত্রের ভর বেশি হলে সেই
বলয়ের দূরত্বও বাড়তে থাকে, আর কম হলে দূরত্ব
কমতে থাকে।
সম্প্রতি সূর্যের নিকটবর্তী নক্ষত্র 'গ্লিসে ৬৬৭ সি'-তে ছয়টি
গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে। এই গ্রহগুলির মধ্যে তিনটি
রয়েছে বসবাস যোগ্য বলয়ে। আমাদের প্রিয় নক্ষত্র সূর্য
ঐ নক্ষত্র থেকে প্রায় তিনগুণ বড় হলেও গ্রহ তিনটি পৃথিবী থেকে কিন্তু সামান্য বড়। প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে যে এদের ভর পৃথিবী থেকে প্রায় তিন
থেকে চার গুণ বড় হবে। বসবাস যোগ্য বলয়ে থাকার সুবাদে
গ্রহ গুলিতে জল থাকার সম্ভাবনা প্রবল। আর জল থাকলে প্রাণের সম্ভাবনা
উড়িয়ে দেওয়া যায়না। কেপলারের এই আবিষ্কারে নাসার
বিজ্ঞানীরা উল্লসিত। এ যেন প্রত্যাশা থেকেও অনেক
বেশি! বিজ্ঞানীদের পরবর্তী কাজ হবে ঐ গ্রহগুলির গঠন
প্রকৃতি আর বায়ুমণ্ডল নিয়ে অধ্যয়ন। এছাড়া ঐ গ্রহগুলিতে রেডিও
তরঙ্গ প্রেরণ করেও উন্নত প্রাণী আছে কি না এও সন্ধান করা যাবে। আসলে কেপলারের নিত্যনুতন আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি সাধারণ
মানুষদেরও বহির্বিশ্ব নিয়ে আগ্রহ বাড়াচ্ছে। হয়তো সেই দিন আর দূরে নেই
যখন বহির্বিশ্বের কোনও গ্রহে এলিয়েনদের সন্ধান আমরা পেয়ে যা।
কেপলারের এই সাফল্যে নাসার বিজ্ঞানী জন গ্রুনসফেল্ড তো আবেগে
বলেই ফেললেন-'কেপলার মহাকাশযান তো বিজ্ঞানের
রকস্টার হয়ে উঠল'। আপনারা কি বলেন?
- যুগশঙ্খ পত্রিকাতে প্রকাশিত (২৮ জুন, ২০১৩)
No comments:
Post a Comment