আমার চার বছরের শান্তিপূর্ণ (!) বিবাহিত জীবনে হঠাৎ করেই ঝড় নেমে এসেছে। ঘরে এখন টিকে থাকাই মুশকিল। ভেবেছিলাম গরমের বন্ধে মজা করে আম কাঁঠাল খাব আর আয়াস করে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখব। সারা রাত উল্লুকের মত জাগবো, আর দিনের বেলা শুধুই ঘুম। কিন্তু, আমার গালে ইতস্তত গজিয়ে ওঠা দাড়ি যে সংসারে অশান্তির আগুন লাগাতে পারে তা কস্মিনকালেও ভাবিনি।
এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের গরমের
বন্ধে দাড়ি রাখার প্ল্যান হঠাৎ আমার মাথায় ঢুকেছে, বিশেষ
একটি কারণে। মানসিক প্রস্তুতিও শেষ। ভাল দিন দেখে 'রেজার'-কে তালাবন্ধ করে রেখেছিলাম। তিন-চার দিন ভালই চলছিল, কিন্তু বাঁধ সাধল পঞ্চম দিনে। আমার সহধর্মিনি আমাকে বারংবার প্রশ্ন করে
অতিষ্ঠ করে তুলল। কেন শেভ করছি না, কিংবা কবে সেটা করব
ইত্যাদি হাজারো প্রশ্নের বাউন্সার সামলাতে সামলাতে আমার অবস্থা সঙ্গিন। কাঁচা পাকা
দাড়ি শ্রীমুখের সৌন্দর্য কেড়ে নিয়েছে,
গিন্নির এই বিশ্বাসে কিছুতেই ফাটল ধরানো গেল না। আয়নায় অবশ্য এই
নূতন আমিকে দেখে আমার ভালোই লাগছিল, কিন্তু
এটা বোঝাবো কাকে? দাড়ি রাখার নেপথ্য কারণ না বলে শুধু বললাম যে বন্ধ যেদিন শেষ হবে, সেদিন আবার আগের মুখশ্রী
ফিরে আসবে। স্বাভাবিকভাবেই এতে আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল। কারণ বলার জন্য আবার পীড়াপীড়ি।
কিন্তু সেটা বলা আমার সমীচিন মনে হলনা। হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো একটি বাক্য -'কারো ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়'। ব্যস-তারপর আমার
ইস্ত্রির মুখ দিয়ে কিছু সময়ের জন্য কথা বন্ধ। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় তিনি শুধু
একটি কথা বলে আমাকে চিন্তায় ফেলে দিলেন যা ভবিষ্যতের জন্য আমার পক্ষে কোনভাবেই শুভ
মনে হলনা। 'ব্যক্তি স্বাধীনতাকে আশা করি
তুমিও ভবিষ্যতে সম্মান করবে'- স্ত্রীর মুখসৃত এই
বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য আপাতত হজম করা ছাড়া আমার উপায় নেই।
নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কে
আমার মাতৃদেবীর প্রবেশ। আমার ভীমরতির কারণ অনুসন্ধানে তিনি ছুটে এসেছেন। বুঝতে
পারলাম যে রান্নাঘরে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। এবার তো মহা মুশকিল। আমার মৌনতা মা-এর
কাছে অস্বাভাবিক লাগছে। তিনি সিদ্ধান্তে আসলেন যে আমার আমার নাকি কিসের নজর লেগেছে।
ঘরে পূজো না দিলে আমার এথেকে রেহাই নেই। পুরোহিতের সঙ্গে অতিসত্ত্বর যোগাযোগের কথা
বলে তিনি আবার রান্না ঘরে চলে গেলেন। এর মানে শান্তি স্বস্তয়নের জন্য পকেট থেকে
আবার নগদ টাকা বেরিয়ে যাবে। যাই হোক ঘরে একজন প্রাণী অন্তত: খুশি, আর সে হল আমার তিন বছরের মেয়ে ঐশী। মাথার চুল যে গালে গজাতে
পারে সেটা জেনে তার খুব আনন্দ। ঐশী তো ওর মা-কে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,'মা, তোমার মুখে তো বাবার মত চুল উঠছেনা!'
এই কথা বলার পর আমি আর ঘরে না থেকে দ্রুত স্থানত্যাগ করলাম।
প্রশ্ন শুধু ঘরেই সীমাবদ্ধ
রইলনা। এবার দিবালোকেও প্রশ্ন ধেয়ে আসতে লাগলো বন্ধুবান্ধব আত্মীয় পরিজনদের কাছ
থেকে। বাজার করতে বের হব হঠাৎ বাড়ির গেটেই দেখা বাড়ির মালিকের সঙ্গে। প্রশ্ন করার
সঙ্গে সঙ্গেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো 'অব কি বার...'। ঘোর বিজেপির
সমর্থক-কে প্রিয় নেতার চেহারা মনে করিয়ে দিতেই তিনি ঘায়েল। 'সাধু সাধু' বলেই তিনি অন্দর মহলে চলে
গেলেন। গলি থেকে বেরিয়ে শঙ্কর-দার সঙ্গে দেখা। সৌজন্যমূলক আলাপের পর সেই প্রশ্ন।
আমার উত্তর-'বর্তমানে তো রেলের ভাড়াই শুধু বৃদ্ধি হল,
আগামীতে ব্লেড আর রেজার ছাড় পেয়ে যাবে বলছেন?' কথাটি বলতেই বামপন্থী শঙ্কর-দার মুখের 'জিওগ্রাফি'
মুহূর্তে বদলে গেল। তারপর পাক্কা দশ মিনিট শাসক দলের বদনাম শুনতে
হল। কোনরকমে তাঁর কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে বাজারের দিকে ছুটলাম। পান ক্রয় করেই আমার দৈনন্দিন
বাজার শুরু হয়। সেটারও এক সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আছে, যা এ মুহূর্তে আর বলছিনা। 'দাদা কি বিশ্বকাপ ফুটবলে
ইরান দলের সমর্থক নাকি?' পান দোকানির এমন প্রশ্ন
শুনেই মুহূর্তে আমার প্রতিক্রিয়া,'গভীর রাত্রিতে খেলা বোধহয়
খুব একটা দেখা হয় না। আর্জেন্টিনা বলেও একটা টিম আছে।' সে
খুব চিন্তায় পড়ে গেল। আর্জেন্টিনাতে কোনও খেলোয়াড় দাড়ি রাখে কিনা এই ব্যাপারে সে
শিওর নয়। অস্ত্র কাজে লাগলো। এরপর এগিয়ে গেলাম মাছের বাজারের দিকে। সেখানেই আমার
সদ্য বিবাহিত বন্ধু দীপঙ্করের সঙ্গে দেখা। আমার দিকে চেয়ে হেসে কিছু বলার আগেই
বললাম,'চার বছর পর এর উত্তর পাবে। ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের পরই তো
শুরু হয় আসলো মজা। শুরুতে সব ঠিকঠাক চলে, তারপর...'। দীপঙ্কর কথা না
বাড়িয়ে কেটে পড়লো।
মাছের দাম দিয়েই বাজারের
বাজেট ঠিক হয়। তাই এবার সবজী কেনার পালা। গ্রামের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কম খরচে
সবজি কিনতেই বাজারের শেষ সীমানায় এসে উপস্থিত হই।
আমার দরদাম করা বোধহয় বুড়ো সবজীওয়ালার পছন্দ হলনা। 'আরে
ছোটে মিয়াঁ, গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে কি ভুলে গেলে সবজী ক্ষেতে
কি লোকসান হয়? ঘরে গিয়ে আব্বাজান কে জিজ্ঞেস করবে'। অবাক হলাম, আমার
দাড়ি তো ধর্ম বদলে দিল! কথা না বাড়িয়ে চটপট সবজী কিনে বেরিয়ে পড়লাম। রিক্সায় এসে
নামলাম বাড়ির সামনে। কলেজে যাচ্ছে পাশের বাড়ির রোহিত। চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করল কি
হয়েছে। বললাম 'নূতন ফ্যাশন'।
ঘরে ঢুকে অথিতিকে দেখে
চক্ষু চড়ক গাছ। এখনও যে কি উত্তর দেব। আমার শাশুড়ি বসে আছেন। ভারিক্কি গলায় সেই
অবধারিত প্রশ্ন আমার দিকে ধেয়ে আসল। 'আসলে সম্প্রতি চোখে কম
দেখতে পাই', আমার এই উত্তরে তিনি বেশ অবাক হলেন। 'আসলে দাড়ি কাটলে চোখে এর সরাসরি প্রভাব পড়ে, তাই
আপাতত কিছুদিন...'। সন্তুষ্ট হলেন বলে মনে হলনা। ডাক্তারের নাম জিজ্ঞেস করলেন।
শহরের বিখ্যাত এক চক্ষু বিশেষজ্ঞের নাম বলতেই তিনি জানালেন যে আগামী তিনদিন পর
তিনিও সেখানে যাচ্ছেন চোখ দেখাতে। আর যাচাই
করে নেবেন এই আজব উত্তরের সত্যতা। যাই হোক কেটে পড়লাম সেখান থেকে। বিকেলে ঘরে এসে
হাজির আমার সহকর্মী। ওকে বললাম যে শুধু ওকেই বলছি আসল সত্য। আমাদের ডিপার্টমেন্টে রয়েছে বুড়োর দল।
তাই আমাদের মত কমবয়সীদের বিশেষ পাত্তা না পাওয়ার জন্য এই বুদ্ধি। সহকর্মীর মনে হয়
খুব পছন্দ হল আমার কথা। সেই মুহূর্তে সেও ঠিক করল দাড়ি রাখবে। 'বিয়ে যখন করনি, তখন কোনও অসুবিধে নেই...'। আমার অন্তর্নিহিত
কথার মানে বোঝার আগেই চা মিষ্টি চলে এলো।
সন্ধ্যাবেলা শ্বশুর বাড়িতে
যেতেই শ্যালক-শ্যালিকা চেপে ধরল। বললাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক হতে চলেছে, আর এটাতে দেবদাসের ভূমিকায় আমি অভিনয় করতে চলেছি। কিন্তু এসব বলে যে ওদের ঠকানো যাবেনা, সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছি। বাবা রামদেব, বাবা
রামকৃষ্ণ ছাড়াও পাগড়ি-হীন লাদেন ইত্যাদি অদ্ভুত সব নতুন নামকরণ হল আমার। দাড়ি রেখে
যে এমন ল্যাজে গোবরে হতে হবে এটা কখনো ভাবিনি। আমার স্মার্ট চেহারাকে নাকি বর্তমানএ
দাড়ি গিলে খেয়েছে, এটাই ওদের ধারণা। যাই হোক সত্য কথা তাহলে
এতদিনে বের হল ওদের মুখ থেকে। কারণ শ্যালক-শ্যালিকাদের চোখে তো এতদিন আমি ছিলাম
পৃথিবীর সবথেকে 'আনস্মার্ট ম্যান'!
আমার দাড়ি পোষে রাখার কিছু
সুফল পেলাম। চারিদিকে আমার গুরুত্ব যেন একটু বেড়ে গেছে। সবাই যেচে এসে আলাপ করছে।
ডিপ্লোম্যাসি উত্তর দিয়ে কিভাবে সমাজে চলতে হয় সেটাও সামান্য আয়ত্ব করলাম। মোটামুটি সবাইকে
খুশি করতে পেরেছি একমাত্র সহধর্মিনি ছাড়া। ষ্টিম ইঞ্জিনের হুইসলের মত হঠাৎ গর্জনের
আওয়াজ দু'দিন ধরে শুনতে পাচ্ছি। এভাবে চললে বিশ্বকাপ
অন্তত শান্তিতে দেখা হবেনা।
স্মার্ট ফোনের দিকে এগিয়ে
গেলাম। তারপর 'সেলফাই ফটো'। ফটো আপলোড করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট করলাম- 'হিমাদ্রি উইথ বিয়ার্ড...ফার্স্ট এন্ড লাস্ট'। ফেসবুকের প্রোফাইল
ফটোর জন্যই যত কাণ্ড। সুদীর্ঘ পনেরো দিনের কৃচ্ছসাধন আজ সম্পূর্ণ হল। কাল সকালেই
হয়ে যাবো- 'শেভড জেন্টলম্যান'। সংসার হয়ে উঠবে সুন্দর আর শান্তিপূর্ণ।
- বরাকের নুতন দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত (২৬ জুন, ২০১৪ ইং)
- বরাকের নুতন দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত (২৬ জুন, ২০১৪ ইং)
No comments:
Post a Comment