Friday, October 21, 2011

জাপান যাত্রার ডায়েরি




-আপনার কাছে কি ভারতীয় টাকা আছে?
 
ডিনার টেবিলে অপ্রত্যাশিত প্রশ্নটি শুনে অবাকই হলাম । প্রশ্নকর্তা জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ হিরোশি শিবাই । হতাশ হয়ে জানাতেই হল যে নেই । কারণ  জাপানের ফ্লাইটে ওঠার আগে নতুন দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভারতীয় টাকার বদলে জাপানি মুদ্রা ইয়েন এক্সচেঞ্জ করার ফলে তখন আমার পার্সে শুধুই ইয়েন । অবশেষে আমাদের টেবিলেরই অপর এক ভারতীয় বন্ধুর কাছে  মিললো একটি একশো টাকার নোট । সেই টাকাটি  ডঃ শিবাইর হাতে তুলে দিতেই তিনি তার ছাত্রের হাতে সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে বললেন, -ভারতকে জানতে হলে এই একশো টাকার নোটের মধ্যে কতগুলো ভারতীয় ভাষা আছে সেটা আগে দেখে নাও । বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, এটাই ভারতীয় ঐতিহ্যের মূল মন্ত্র ।
 
ওসাকার মিনামি আওয়াজি রয়েল হোটেলে প্রথম সন্ধ্যায় ভারত থেকে চব্বিশজন গবেষকদের নিয়ে ডিনার পার্টিতে পরিচয় বিনিময়ের সময় জাপানের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ভারত নিয়ে উৎসাহ দেখে খুব ভাল লাগলো । ডিনার টেবিলে নানা বার্তালাপের পর ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পি এচ ডি স্কলার হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করে যে ভারতীয় ঐতিহ্যের আলাদা কোন বৈশিষ্ট্য আছে কি না !
ভাবছি কোথা থেকে শুরু করা যায় -তখনই পাশে বসা ডঃ শিবাই আমার কাছে ভারতীয় টাকা চাইলেন । একটি ভারতীয় একশো টাকার সাহায্যে দারুণ সিক্সার মেরে খুব স্বল্প কথায় ভারত নিয়ে অনেককিছুই তিনি বলে ফেললেন । ভারতের ঐতিহ্য নিয়ে অনেক পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা এর আগেও অনেক বক্তার মুখে শুনেছি, কিন্তু শিবাইর এই অল্প কথায় ভারতের বিশেষত্বকে তুলে ধরার এই যে অসাধারণ প্রয়াস এককথায় তা অ-পূর্ব ।  ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা এশিয়া অ্যাকাডেমিক সেমিনারের কোঅর্ডিনেটর ডঃ হিরোশি শিবাইর এই ভারত প্রীতিতে আমরা মুগ্ধ । স্বাভাবিকভাবেই সদা হাস্যময় সেই মানুষটির প্রথম দিন থেকেই ফ্যান হয়ে গেলাম । 

     ৩০ শে মে, ২০১১ । দুপুর তিনটেয় গতানুগতিক ভাবে ই-মেলের ইনবক্সে খুঁজে বেড়াচ্ছি কোন গুরুত্বপূর্ণ মেল এসছে কি না ! হঠাৎই চোখ পড়ে যায় একটি মেলে ।  প্রেরকের নাম আর মেলের বিষয় দেখে স্বভাবতই উত্তেজিত । আপনি জে এস পি এস-ডি এস টি সেমিনারে জাপান যাবার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন ... তারপর কি লেখা আছে সেদিকে আর চোখ পড়েনি । প্রেরক আর কেউ নন, প্রোফেসর অজিত কেমভাবি, যিনি পুনের ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি এন্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আয়ুকা) এর ডিরেক্টর । আমার স্বপ্ন তখন হাতের মুঠোয় । কারণ জাপান নিয়ে আমার আগ্রহ সেই বাল্যকাল থেকেই । প্রযুক্তির তীর্থক্ষেত্র নিয়ে অনেক বই পড়েছি ।  কল্পনার ক্যানভাসে এঁকেছি জাপানকে নিয়ে কত ছবি । আর অবশেষে কি না সেই স্বপ্নের দেশের দিকেই পা বাড়াতে চলেছি, ভাবতেই কেমন লাগছিল । আমার তখন নতুন মিশন - সূর্যোদয়ের দেশ । ভারত আর জাপানের যৌথ উদ্যোগে ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাপানের ওসাকাতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর এক আন্তর্জাতিক সেমিনার হবে । ভারত থেকে মোট ২০ জন গবেষক নির্বাচিত হয়েছেন । সেমিনারের বিষয় রিসেন্ট এন্ড ফিউচার অ্যাডভান্সেস ইন অবজার্ভেশনাল অ্যাস্ট্রোনমি । ভারত সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (ডি এস টি) আমাদের জাপান যাত্রার খরচ এবং জাপান সরকারের জাপান সোসাইটি ফর দ্য প্রমোশন অব সায়েন্স (জে এস পি এস)  সেখানে ভারতীয় গবেষকদের থাকা এবং খাওয়ার বন্দোবস্ত করবে । তারপর সময় কিভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না, যাবার দিন খুব দ্রুত ঘনিয়ে এলো । বিমান টিকিট এবং ভিসাতেও কোন ঝামেলা হলনা । 
     ২৪ সেপ্টেম্বর রাত ঠিক সাড়ে এগারোটায় নুতন দিল্লী থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ছাড়লো জাপানের ওসাকা নগরীর উদ্দেশ্যে  ।  যাত্রার সময় সুদীর্ঘ তেরো ঘণ্টা । মধ্যে হংকং-এ এক ঘন্টার বিরতি । জাপান নিয়ে আগাম কিছু পড়াশোনাও করেছিলাম, সেটা ভাবতে ভাবতেই চোখে ঘুম জড়িয়ে এল । হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল ৭ টা । বিমান সেবিকারা প্রাতরাশ পরিবেশন শুরু করেছেন । আমার পাশে বসা এক জাপানি যুবকের হাতের রোলস রয়েস ঘড়িটির দিকে নজর গেল । তার ঘড়িতে সময় তখন সাড়ে দশটা । রোলস রয়েসের এই সময়টাই মনে করিয়ে দিলো যে জাপানের সঙ্গে আমাদের সময়ের ব্যবধান সাড়ে তিন ঘণ্টা । সঙ্গে সঙ্গে আমার নিজের ঘড়ি বাবাজীকে জাপানের টাইম সিস্টেমে সেট করতে গিয়ে দেখি চাবি জ্যাম হয়ে গেছে । বোধহয় ভারতের সময় সে তার হৃদয়ে রেখে দিতে চায় । যাই হোক তখন থেকেই জাপানের সময়ের সঙ্গে মানসিকভাবে আমার পথযাত্রা শুরু হল।  
২৫শে সেপ্টেম্বর দুপুর ঠিক সাড়ে বারোটায় কাঁশাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমাদের বিমান নামলো ।  তখন থেকেই জাপানের টেকনো লাইফএর সঙ্গে হাত মেলানো শুরু হল । যাবার পথে স্বয়ংক্রিয় এক কামরার ট্রেন আমাদের নিয়ে চললো ইমিগ্রেশনের চেকিং এর পথে । যেখানে প্রায় সহজেই পঁচিশ-ত্রিশ জন যাত্রী ভালভাবেই যেতে পারে । তারপর বলতে গেলে খুব তাড়াতাড়ি আমাদের মালপত্র ডিপারচার গেটে চলে এলো । জাপানের মাটিতে পা রাখার পর থেকেই দেখেছি খুব নীরবে আর নিয়মতান্ত্রিক ভাবে সবাই কাজ করছে । অভ্যর্থনার জন্য ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা সেমিনারের কোঅর্ডিনেটর ডঃ হিরোশি শিবাই নিজে তাঁর দুজন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। আমাদের পরবর্তী গন্থব্যস্থল আওয়াজি দ্বীপ । বিমানবন্দর থেকে যেতে সময় লাগবে তিন ঘণ্টা । সেখানেই মিনামি আওয়াজি রয়েল হোটেলে যেখানে আমাদের থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে । আগামী কয়েকদিন সেমিনার এই হোটেলেরই কনফারেন্স রুমে হবে । 


     এরপর শুরু হল অত্যাধুনিক বাসে চেপে যাত্রা । বিমান যাত্রার ক্লান্তি সত্ত্বেও জানালা দিয়ে জাপানের যে টুকরো ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক কথায় চোখ জুড়ানো ও  আবেশময় । শিল্প আর প্রযুক্তির প্রকৃত মেলবন্ধনের দেশে এসে আমরা তখন অভিভূত । ভারতীয় বন্ধুদের প্রায় প্রত্যেকের হাতেই তখন ক্যামেরা ঝলসে উঠছে । আমি আর তখন ছবি তুলে দেখার মজাটা মাটি করলাম না,আর মনও সায় দিচ্ছিলনা  । কারণ জানতাম জাপানের এই সৌন্দর্যের তিলমাত্রও ক্যামেরায় বন্দী করা সম্ভব নয় ।  প্রকৃতি প্রদত্ত ক্যামেরার সাহায্যে সৌন্দর্যের সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ নয় কি? রাস্তার আশে পাশে নানা আকৃতির মনোহরণকারী উঁচু উঁচু অট্টালিকা দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেল । একটা জিনিষ দেখলাম জাপানে ঝুলন্ত ব্রিজের খুব রমরমা । আসলে জাপান একটি দ্বীপ রাষ্ট্র হওয়ায় সেখানে ছোট বড় দ্বীপের সংখ্যা অসংখ্য, আর পাহাড়ি অঞ্চলের ক্ষেত্রফলও অনেক বেশী । সমুদের ঠিক পাশ দিয়েই আমাদের গাড়ি ছুটছিল । নীল আকাশ আর নীল জলের ব্যাকগ্রাউন্ডে ছোট্ট ছোট্ট সাদা ডিঙি নৌকাগুলো দূর থেকে দূরান্তরে মিলিয়ে যাচ্ছে । সমুদ্রের পাশে সৈকতে বাচ্চাদের কেউ কেউ ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, আবার কেউবা বিজ্ঞের মত বড়দের নকল করে তাঁদের পাশে বসে মাছ ধরছে । এক্সপ্রেস হাইওয়েতে এত গাড়ি চলছে কিন্তু কোন গাড়ির হর্ন শুনা যাচ্ছেনা । সবাই নীরবে যে যার গাড়ি নিয়ে আপন গন্থব্যস্থলের দিকে ছুটে চলছে । বিদেশের অনেক উন্নত দেশের মতই জাপানেও হর্ন বাজানোটা অসভ্যতার পর্যায়ে পড়ে । সবথেকে ভাল লাগছিল স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থার ভেলকি দেখে । লাল, হলুদ আর সবুজ আলোর কেরামতিতে রাস্তার ট্রাফিক সুনিয়ন্ত্রিত ।  আইনের সম্মান জানাতে অভ্যস্ত জাপানিরা আইন ভঙ্গের কথা ভাবতেও পারে না । রাস্তায় তেমন ট্রাফিক পুলিশও নজরে পড়ছিলনা । পরবর্তীতেও জাপানের নানা অঞ্চলে ভ্রমণ কালে দেখেছি যে ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা খুবই নগণ্য । আর একটি লক্ষণীয় ব্যাপার হল রাস্তার বাঁকের মোড়ে-মোড়ে বড় বড় উত্তল দর্পণ লাগানো আছে, যার সাহায্যে বাঁকের ঐ পাশ থেকে কোন গাড়ি আসছে কিনা সহজেই বোঝা যায় । ফলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও কম । ধীরে ধীরে আমাদের বাস শহর থেকে দূরে পল্লী অঞ্চলে প্রবেশ করে । চারপাশে পিকচার পোস্ট কার্ডের মত সুদৃশ্য কাঠের ছোট ছোট ঘর । সেখানকার  ছিমছাম রাস্তা দেখে মন ভরে যায় । শহরের নাগরিক জীবনের সৌন্দর্য থেকে এর রূপ ভিন্ন-সহজেই মন কাড়ে । আমাদের দেশের গ্রামের কথা ভেবে  দুঃখ হচ্ছিল ।  গ্রামের সমতল জমিতে প্রচুর সোনালি ধান খেত দেখতে পেলাম । স্বস্তি পেলাম যে বিদেশে এসেও বাঙালির রসনায় ডাল (!) ভাতের অভাব হবে না । কিন্তু খাওয়া নিয়ে আগামীতে কী যে দুর্ভোগ আছে মুগ্ধ মন তখন তা কল্পনাও করতে পারেনি ! 



     আজ থেকে ঠিক সতেরো বছর আগে এই ঘরে যখন বসে আছি তখন আচমকা ভূমিকম্পে আমরা  ভয়ার্ত হয়ে উঠি । পাশের ঘরেই আমার নাতি নাতনিরা বসে পড়াশোনা করছিল । একটা ভীষণ শব্দ শুনে  ছুটে গিয়ে দেখতে পাই তাদের উপরেই প্রায় একটি আলমারি কাত হয়ে পড়ে আছে ।  সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাই । সৌভাগ্যবশত সামান্য আহত হওয়া ছাড়া ওদের কোন বিপদ ঘটেনি ।  চারিদিকে তখন ভীত ত্রস্ত হাহাকার ।  কয়েক সেকেন্ডের কম্পনে আমাদের এই হকুদান শহর তছনছ হয়ে যায় ।


 
কথা হচ্ছিল ৮৭ বছরের জনৈক এক জাপানি বৃদ্ধের সঙ্গে । সেদিনের ভূমিকম্পের বর্ণনা দিতে গিয়ে এত বছর পরও তাঁর চোখে আতঙ্কের ছবি ।  বয়স তার স্মৃতিকে ম্লান করতে পারেনি । বৃদ্ধ জাপানি ভাষাতেই বলছিলেন আর শিবাই আমাদের ইংরেজিতে সব বুঝিয়ে বলেন । স্থান-হকুদান ভূমিকম্প স্মারক পার্ক । আমাদের হোটেল থেকে মাত্র এক ঘন্টার পথ । জাপানের ভূমিকম্প নিয়ে আমাদের কৌতূহলের ব্যাপারটা শিবাই বুঝতে পেরেছিলেন । সেমিনারের অনবরত বক্তৃতা থেকে অব্যাহতি দিতে তিনি ২৯ সেপ্টেম্বরের বিকেলটা আমাদের আশেপাশে দর্শনীয় স্থানে বেড়াতে নিয়ে গেলেন । হোটেল থাকে যাত্রা শুরু করে দুপুর ঠিক তিনটেতে স্মারক স্থলে পৌঁছে গেলাম । সেখানেই রয়েছে ১৭ জানুয়ারি ১৯৯৫ সালের ভূমিকম্পের কিছু ভয়াবহ স্মৃতি । সে সময় নানা স্থানে ফাটল দেখা দেয় । তেমনই এক বিখ্যাত ফাটলের নাম নজিমা ফল্ট যা হকুদান শহরের এই স্মারক স্থলেই রয়েছে । একটি ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িও রয়েছে যার মালিক কখনো কখনো দর্শনার্থীদের সেদিনের ভয়াবহ স্মৃতির রোমন্থন করে থাকেন । ভাগ্যক্রমে সেদিন সেই ৮৭ বছরের যুবকের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে যায় ! ঘরের ভেতরে এখনো ধ্বংসের চিত্র স্পষ্ট । রান্না ঘরে রান্নার বাসনপত্র অবিন্যস্ত ভাবে পড়ে রয়েছে, চেয়ার টেবিলও উলটে আছে । সেদিনের সেই ভূমিকম্পকে গ্রেট হানশিন-আওয়াজি আর্থকুয়েক ডিসেস্টার বলা হয়ে থাকে । ১৭ জানুয়ারির অভিশপ্ত দিনে কোবে অঞ্চল ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল, রিক্টার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৬.৯ । বিস্তর সম্পত্তির লোকসানের পাশাপাশি ৩৯ জন মানুষ সেদিন মারা যায়, আর আহত হয়েছিল অগুনতি মানুষ । প্রতি বছর ১৭ জানুয়ারি জাপানের এই শহরের প্রবীণ নাগরিকদের বিভীষিকা তাড়া করে বেড়ায় । আসলে ভূমিকম্পের সঙ্গে জাপানের তিক্ত সম্পর্কের ইতিহাস অনেক পুরনো । সারা বছরই ভূমিকম্পের সঙ্গে জাপানের খিটিমিটি লেগেই থাকে । আবার কখনো বা ভূমিকম্পের বেয়াদপি এমন পর্যায়ে চলে যায় যে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিশাল ধ্বংসের কারিগর হয়ে যায় সে । সড়ক, রেলপথ, উঁচু উঁচু ইমারতকে ধূলিসাৎ করে মানব সভ্যতাকে যেন সে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় । আর জাপানের মানুষ সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে আবার নুতন করে নিজেদের গড়ে তোলে । কারণ এই প্রাকৃতিক দুর্যোগই জাপানকে শিখিয়েছে  প্রকৃতির কোলে বেঁচে থাকার জন্য কিভাবে লড়াই করতে হয় ।  



     জল কিনতে গিয়ে আঁতকে উঠলাম ! এক লিটার মিনারেল ওয়াটার বোতলের দাম ২০০ জাপানি ইয়েনভারতীয় টাকায় মূল্য প্রায় ১৪০ টাকা ! হোটেলে কোন পানীয় জলের ফিল্টার বা একোয়া গার্ড খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলনা, রিসেপশনে প্রশ্ন করে জানলাম যে এসবের কোন ব্যবস্থা এখানে নেই । এই মূল্যে যদি  জল কিনে খেতে হয় তাহলে আমাদের মত শিক্ষকদের পকেটের অবস্থা যে কি হবে ভাবতেই অসহায় লাগছিল । হঠাৎ করে এই বিপদের সম্মুখীন হয়ে শিবাই এর শরণাপন্ন হলাম । তিনিও সহজে সমস্যার সমাধান করে দিলেন । অভয় দিয়ে জানালেন যে হোটেলের বাথরুমের জল আমরা নির্দ্বিধায় পান করতে পারি । কারণ জাপানের যেকোনো জায়গায় জলের গুণমান নিয়ে কোন সন্দেহ নেই । এও জানা গেল যে জাপানের লোকেরা খাবার জিনিষের গুণমানের উপর কোন সমঝোতা করে না তা যেকোনো খাবারই হোক না কেন । শপিং মলে গিয়েও উন্নত মানের খাবারের সন্ধান পেয়েছি । কিন্তু দাম আমাদের ভারতের তুলনায় বেশীই । ওদের টাকার ভ্যালু যে বেশী তা হাড়ে হাড়ে বোঝতে পারছি । এবার আসি জাপানের খাবার প্রসঙ্গে । খাবারের ডিশে  সেদ্ধ শাক-সবজী আর সেদ্ধ মাছ-মাংসের উপস্থিতিই বেশী । নানা রকমের সুপও অবশ্যই ছিল । কিন্তু অবিশ্বাস্য ভাবে লবণের মাত্রা সব খাবারেই খুব কম । আমাদের রসনা প্রথম কদিন ওদের খাবারের স্বাদ নিতে রাজীই ছিলনা । এই অবস্থায় খাবারের মেনুতে সাদা চালের ভাত দেখে আমরা উল্লসিত । কিন্তু মুখে দিয়ে উৎসাহ হারালাম । এ যেন অনেকটা আমাদের বিন্নী চালের ভাত বা বিরইন ভাতের মত আঠালো । তেমন কোন সবজী বা মাছের ঝোলও চোখে পড়লোনা যে ভাতের সঙ্গে মেখে খাব । কিন্তু জাপানীরা সামান্য কিছু সবজি দিয়ে ঐ ভাত চপ স্টিক (সত্যি দর্শনীয়) দিয়ে দারুণ তৃপ্তিতে খাচ্ছিল । এই চপ স্টিক দিয়ে খেতে গিয়ে আমাদের যে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় সে আর এক গল্প । তবে ছুড়ি আর কাঁটাচামচ এই যাত্রায় আমাদের কিছুটা হলেও রক্ষা করেছে । হোটেলের রেস্টুরেন্টে নানা খাবার সাজানো থাকতো । প্লেট নিয়ে প্রথম কয়েকদিন খুব উৎসাহের সঙ্গে নিত্যনুতন মেনুর দিকে এগিয়ে গিয়েছি । মনে পড়ছিল কোন এক বিজ্ঞানীর বলা একটি কথা –“নতুন ডিশ আবিষ্কার, নতুন নক্ষত্র আবিষ্কারের থেকেও আনন্দদায়ক । কিন্তু সেই আনন্দ ম্লান হয়ে যেত যখন কিছু নুতন মেনু আমাদের দিকে গুগলি ছুঁড়ে মারতো । ক্লিন বোল্ড হয়ে অবশেষে ফলের স্যালাড রাখা টেবিলে  চলে যেতাম । সেদিনের মত আবিষ্কারের আনন্দে সেখানেই ইতি ঘটতো । পরদিন আবার নুতন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়া নতুন খাবারের খোঁজে । এভাবেই একদিন অক্টোপাসের মাংসের স্বাদ নিলাম । ভালই খেতে । বাঙালি হবার সুবাদেই মাছের টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতাম । সামুদ্রিক মাছের মধ্যে ম্যাকারেল, স্যামন মাছের স্বাদ কিছুটা হলেও ইলিশ মাছের কথা মনে করিয়ে দিত । সেদ্ধ মাছের টুকরো গুলোকে গরম তাওয়ার মধ্যে সামান্য তেলে ফ্রাই করে রাখা থাকতো, আর সেই মাছগুলো নিয়ে ভাতের সঙ্গে মিলিয়ে খাবার চেষ্টা করতাম । জাপানের খাবারে লবণের পরিমাণ কম থাকার কারণ তার চারিপাশের সমুদ্র । আসলে শাক সবজী থেকেই জাপানিরা তাদের খাবারের নির্দিষ্ট লবণ পেয়ে যায়, তাই আলাদাভাবে সেটার দরকার হয় না । কিন্তু আমাদের রসনা তো সেই সত্যটা বুঝেনা । তাই লবণের সন্ধানে রেস্টুরেন্টে আমাদের চোখ এদিক ওদিক ঘুরতে থাকতো । তবে এ ব্যাপারে ভাগ্য আমাদের খুবই অপ্রসন্ন । লবণহীন খাবারই আমাদের কপালে জুটেছে বেশী । লবণকে যে এত ভালবাসি কই আগে তো এটা জানতাম না !  
     এক অক্টোবর-সকাল নটা । সেমিনার পর্ব গতকালই শেষ হয়ে গেছে । এখন তিনদিন ধরে জাপানের ঐতিহাসিক অঞ্চলে চলবে ভ্রমণ । জাপানের সেমিনার কমিটির পক্ষ থেকেই এই ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছে । যাত্রা শুরু হবে তাকোয়ামা নগর দিয়ে । এই নগর কাঠের নানা রকম তৈজস পত্র তৈরীর জন্য বিখ্যাত । যাওয়ার পথে পড়বে বিখ্যাত ঐতিহাসিক দূর্গ - নাম হিকোন ক্যাসল ।  গত ছদিন মিনামি আওয়াজি হোটেলের কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে নিচুস্তরের কর্মচারি পর্যন্ত সবার কাছ থেকেই শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পেয়েছি । হোটেল ছাড়ার সময়ও এর ব্যতিক্রম হলনা ।  ম্যানেজার,সেফ থেকে বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মচারিরা চিরাচরিত জাপানি প্রথা অনুযায়ি মাথা হেট করে বিদায় জানাচলেন (যাকে জাপানিতে বলা হয়  বো) । গাড়ি ছাড়ার পরও যতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল সবাই দাড়িয়ে আমাদের দিকে হাত নাড়ছিল । সত্যি, এমন অতিথি বৎসল দেশ সম্বন্ধে আর কি বলবো ! এখানে আসার পর থেকে ভাষা নিয়ে একটা সমস্যা ছিল । জাপানের খুব কম মানুষই ইংরেজি বুঝতে পারেন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ভাষা আমাদের কাছে আবেগ বিনিময়ের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাড়ায়নি । ইশারায় উভয় পক্ষই জেনে গেছি নিজেদের বক্তব্যের বিষয় বা প্রয়োজনীয়তার কথা । রাস্তায় হোক কিংবা ট্রেনেই হোক যখনই প্রয়োজন পড়েছে সাহায্যের জন্য সবাই  প্রস্তুত । বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও সেই অর্থে ইংরেজিতে দক্ষ নয় । ওদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম জাপানে সবকাজই জাপানী ভাষাতেই হয় । পি এচ ডি থিসিসও এর ব্যতিক্রম নয় । নিজ ভাষার প্রতি এতটাই তাদের সম্মান ও ভালবাসা । বিশেষ কোন প্রয়োজন না পড়লে অন্য ভাষা শিখতে তার আগ্রহী হয়ে ওঠেনা । ইউরোপীয় ভাষাচর্চা না করার দরুণ সভ্যতার অগ্রগতির পথযাত্রায় খুব একটা অসুবিধে হয়েছে, দেখে তা মনে হলনা ।  আমাদের দেশের ভাষা বৈচিত্র দৈনন্দিন জীবনে কোন জটিলতার সৃষ্টি করে কি না এ নিয়ে তাদের খুব কৌতূহলের ব্যাপার ছিল । হিন্দি এবং ইংরেজি এই দুটি ভাষা জানলে আমাদের এখানে ভাষাগত কোনো সমস্যা থাকেনা একথা জানতে পেরে তাঁরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো । যাই হোক দুপুর সাড়ে বারোটায় আমাদের বাস হিকোন শহরে এসে পৌঁছালো । হিকোন শিগা পারফেকচার (রাজ্যে)-এর একটি শহর  । এই শহরেই অবস্থিত সেই বিখ্যাত হিকোন ক্যাসল । লি  নাওকাতসু ১৬০৩ সালে এই দুর্গটি তৈরীর নির্দেশ দেন । সুদীর্ঘ ১৯ বছর ধরে তৈরী হয় এই দুর্গ, সেইসঙ্গে এর আশেপাশের অঞ্চলগুলিও সেজে উঠে জাপানি স্থাপত্যকলায় । ১৬২২ সালে এই দুর্গের নির্মান কার্য সম্পন্ন হয় । ভূমিকম্পের দরুণ জাপানের প্রাচীন অট্টালিকা থেকে আধুনিক পাঁচতারা হোটেল সবকিছুই কাঠের তৈরী । হিকোন ক্যাসলও এর ব্যতিক্রম নয় । ছোট্ট পাহাড়ের উপর কাঠের নির্মিত তিনতলার এই দুর্গের স্থাপত্য দেখার জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী সেখানে ভিড় জমান  ।  প্রথমেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় দুর্গের সীমানাতে অবস্থিত মিউজিয়ামে । সেখানে রক্ষিত সে যুগের সৈনিকদের বর্ম দেখে আমার ভিড়মি খাবার অবস্থা । বর্মের বিশালতা দেখেই মনে মনে কল্পনা করতে পারছিলাম সে যুগের সৈনিকদের দশাসই চেহারা । মিউজিয়াম দর্শন শেষে সোজা চলে এলাম দুর্গের পাদদেশে ।  দুর্গের ভেতরে অবস্থিত সিঁড়ি দিয়ে তিন



তলায় উঠে যাওয়া যায় আর সেখান থেকে হিকোন শহরের প্যানোরামিক ভিউএককথায় অপূর্ব । সবথেকে সুন্দর লাগে দূরে শুয়ে থাকা বিওয়া-হ্রদকে । এই মিষ্টি জলের হ্রদটি দুর্গ থেকে দেখলে সমুদ্র বলে ভ্রম হয় । ৬৭০ বর্গকিলোমিটারের এই হ্রদটিই জাপানের সবথেকে বড় হ্রদ ।  আর ভৌগলিক ভাবে হ্রদের পাশে ক্যাসেলটির অবস্থানও খুব গুরুত্বপূর্ণ । ঘোড়ার জন্য তৈরী কাঠের আস্তাবল এই দুর্গের এক বিশেষত্ব । সৈনিকেরা ঘোড়ার সাহায্যে দূর দূরান্তরে এখান থেকেই ছড়িয়ে পড়তেন । প্রায় চারশো বছর পুরানো এই দুর্গের স্থাপত্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম বললেও কম বলা



হয়।  অবশেষে নেমে এলাম দুর্গের নিচে যেখানে দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য জাপানের প্রিয় ম্যাসকট  সামুরাই ক্যাট  নৃত্য প্রদর্শন করে । এই ম্যাসকট জাপানে খুব প্রসিদ্ধ । চাবির রিং থেকে শুরু করে নানা রকম পুতুল কিংবা খেলনা সবকিছুতেই এই ম্যাসকটের রমরমা । ক্যাসেল থেকে বেরিয়ে আসার পথে চোখে পড়লো চেরি ব্লসমের বাগান । বসন্ত ঋতুতে এই বাগানের  প্রায় এক হাজার চেরি গাছ লাল চেরির রঙ্গিন চোলিতে সেজে উঠে । সে এক দেখার মত দৃশ্য ।  সময় কম থাকায় সমগ্র অঞ্চল আর আমাদের ঘুরে দেখা হলনা । দুপুর আড়াইটেয় আবার বেরিয়ে পড়া । বিকেল পাঁচটায় আমাদের  বাস এসে থামে তাকোয়ামা মাতসুরি মিউজিয়ামে । এই মিউজিয়ামে এসেই জানতে পারলাম আগামী ৯ ও ১০ অক্টোবর তাকোয়ামা শহরে জাপানিদের চিরাচরিত উৎসব উদযাপন হতে যাচ্ছে । এই উৎসবে ঐতিহ্যময় বিশাল বিশাল কাঠের রথ শহর পরিক্রমা করে । রঙ বেরঙের কাগজ আর কাপড়ে এই রথ গুলো হয়ে উঠে সুসজ্জিত । সেই ১৬৯২ সাল থেকে এই উৎসবের সূচনা, যার পরম্পরা আজও চলছে । এই তাকোয়ামা মিউজিয়ামেই সেই সব রথ সাজিয়ে রাখা আছে । কাঠের সুসজ্জিত রথে রয়েছেন নানা দেবতা ।  আশেপাশে রয়েছে বিশাল বিশাল ঢাক আর ড্রামের সম্ভার । তিনতলা উঁচু এই মিউজিয়ামে জাপানের চিরাচরিত লোকসংস্কৃতির পরিচয় পেয়ে আমরা বিস্ময়ে নির্বাক । কিছুক্ষণ সেখানে থাকার পর মিউজিয়াম সংলগ্ন রেস্টুরেন্টে আমাদের রাতের ডিনার পর্ব সেরে নিলাম । তারপর তাকোয়ামা শহরেরই এক অভিজাত হোটেল তাকায়ামাউসান-এ আজকের মত আমাদের যাত্রার সমাপ্তি  । তখন রাত আটটা বেজে গেছে । এই হোটেলে এসে আমাদের জন্য আর এক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল । কারণ আর কিছুই নয় এখানে হোটেলের প্রবেশ পথেই জুতো খুলে গ্রাউন্ড ফ্লোরের লকারে জমা দিয়ে দিতে হয় তারপর  খালি পায়ে হোটেলে চেক ইন করতে হয়  । কারণ এখানের ফ্লোরের টাইলসগুলো বিশেষ জাপানি প্রথায় তৈরি । জুতোর ঘর্ষণে টাইলসগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা থাকে বলেই হোটেলের বিশেষ রবারের সোলের জুতো পড়াটা এখানে বাধ্যতামূলক । দেখা গেল আমাদের মালপত্রও হোটেলে চলে এসেছে আর হোটেলের এক কর্মচারী ব্যাগগুলো পরিষ্কারে ব্যস্ত । পরিষ্কার পরিচ্ছন্নের দিকে হোটেল কর্তৃপক্ষের বিশেষ নজর ছিল ।  শহরের তাপমাত্রা তখন ছিল প্রায় ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস । খুব শীত লাগছিল, তবে সঙ্গে জ্যাকেট থাকায় তেমন অসুবিধে হয়নি । হোটেলে গরম জলের বিশেষ পাবলিক হট স্প্রিং আছে । গরম জলের গণ সুইমিং পুলে স্নান করাটা জাপানের এক রেওয়াজ বলা যায় । বৃদ্ধ, যুবক সবাই মিলে আড্ডা দিয়ে স্নান করা এখানে খুব জনপ্রিয় । তবে ক্লান্ত থাকায় আমাদের এই অভিজ্ঞতার স্বাদ নেওয়া হলনা, হোটেলের বাথরুমেই ফ্রেশ হয়ে নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম ।      
     দোসরা অক্টোবর, সকাল সাড়ে আটটা । সকালে জাপানের খাঁটি চা পান করার পর বেশ ফ্রেশ লাগছে । জাপানে চা খুব জনপ্রিয় । ব্রেকফাস্ট টেবিলে মেড ইন জাপান খাবারের পাশে মেড ইন ইন্ডিয়া এক আইটেম দেখে খুব ভাল লাগলো । লিপটন দার্জিলিং চা । ভারতের চা-এর প্রতি জাপানিদের দুর্বলতা নানা সময় প্রকাশ পেয়েছে । যখনই জাপানের কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করতো যে ভারতের কোন অঞ্চল থেকে এসেছি, তখন আমার উত্তর পাবার পর ওরা জেনে নিতো যে সেই চা-এর দেশ থেকে আসছি কি না ! আমাদের  বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের আগে আসাম থাকায় এর ব্রান্ড ভ্যালুও তাহলে জাপানে পরিচিত । ভারতবর্ষের উত্তর পূর্বাঞ্চলের এই অবহেলিত রাজ্যটি দূর বিদেশের বিদেশীদের কাছে এত পরিচিত তা কে জানতো ! কিন্তু এই চায়ের গুনে অপরিচিতের অভিগাথা থাকলোনা । এই প্রথম আসামের এই চা-এর জন্য মনে মনে এক গর্বই হলো । 

আজ আমাদের গন্থব্যস্থল শিরাকাওয়া-গো নামক একটি গ্রাম যা গিফু আর তোয়ামা পার্ফেকচারের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত । এই গ্রামকে  ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে  ঘোষণা করে যা সাংস্কৃতিক হেরিটেজ সাইটের ক্যাটাগরি ভুক্ত। খুব খুশি হলাম কমিটির পক্ষ থেকে এমন একটি জায়গা নির্বাচিত করার জন্য ।  জাপানে ইউনেস্কোর ঘোষণা করা আরো পনেরোটি হেরিটেজ সাইট রয়েছে । কিন্তু ভারতে রয়েছে ২৮ টি । এর মধ্যে আমাদের আসামের কাজিরাঙ্গা আর মানস অভয়ারণ্য হেরিটেজ সাইট হিসেবে নথিভুক্ত । এছাড়াও উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আগ্রার তাজমহল, দিল্লির কুতুবমিনার, মহারাষ্ট্রের অজন্তা-ইলোরা গুহা ইত্যাদি ।  শিরাকাওয়া-গো গ্রামটি আমাদের হোটেল থেকে মাত্র এক ঘণ্টার রাস্তা । সকাল দশটায় এসে সেখানে আমরা উপস্থিত হলাম । সমুদ্র থেকে প্রায় পাঁচশত মিটার উঁচুতে অবস্থিত পাহাড় ঘেরা এই গ্রামটির পাদদেশে বয়ে চলেছে শোগাওয়া নদী । এই গ্রাম উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১.৫ কিলোমিটার, আর  পূর্ব-পশিমে ৩৫০ মিটার  পর্যন্ত বিস্তৃত । এই গ্রামের  কাঠ আর খড় দিয়ে বানানো বাড়িগুলো দৃষ্টি আকর্ষণ করে । এই বাড়িগুলো দেখতে ইংরেজি বর্ণমালার A অক্ষরের মত । এই বাড়িগুলোর  ছাদে খড় এত পুরু করে দেওয়া হয়ে  থাকে যে শীতকালে তুষারপাতের সময় বরফ ঘরের ভেতরে ঢুকতে পারেনা । বেশীর ভাগ বাড়িই তিনতলা থেকে চারতলা । ঘরের চাল প্রায় ষাট ডিগ্রী পর্যন্ত হেলানো থাকে, যার ফলে ছাদে বরফ জমতে পারেনা । বাড়িগুলোকে দূর থেকে দেখে অনেকটা আমাদের গ্রাম বরাকের কুড়ে ঘরের মত লাগছিল । একশো চৌদ্দটি A টাইপের ঘরে প্রায় ছয়শোজন লোক ওই গ্রামে থাকেন । তাদের জীবনশৈলী দেখে মুগ্ধ হতে হয় বৈ কি ! গ্রামে রয়েছে ছোট ছোট অনেক দোকান, যেখানে রয়েছে কাঠের তৈরি নানা সামগ্রী ।  সারাটা দুপুর আমরা এই মনোরম গ্রামেই কাটিয়ে দিলাম ।  
     বিজ্ঞানের জগতের প্রায় সবাই জানেন যে  জাপানে বিজ্ঞানের এক বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে  । খুব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যন্ত্র তৈরিতে জাপানিদের তুলনা নেই । বিজ্ঞানমনস্ক ভারতীয় অতিথিদের জাপানের বিজ্ঞানের স্বাদই যদি না দেওয়া যায় তবে আর কী হল ! শিবাই তাই আমাদের জন্য এক অভিনব দর্শনের ব্যবস্থা করলেন । তার মুখে কেমিওকা অবজারভেটরিতে আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে শুনে তখন আমরা সবাই উল্লসিত । টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে চলা এই অবজারভেটরিতে খুব কম মানুষকেই যাবার অনুমতিপত্র দেওয়া হয় । সে হিসেবে আমরা  ভাগ্যবানই বলতে হয় । তেসরা অক্টোবরের সকালে আমরা বেরিয়ে পড়লাম কেমিওকার উদ্দেশ্যে । পাহাড় ঘেরা পথে যেতে যেতে পাইন গাছের বিস্তীর্ণ জঙ্গল দেখে শিলং-এর কথা  মনে পড়ছিল খুব । আসলে জাপানের পাহাড় গুলোতে পাইন গাছের আধিক্য অন্যান্য গাছের তুলনায় অনেক বেশী । আমাদের বাস যখন কেমিওকাতে এসে পৌছায় তখন তাপমাত্রা ছিল তেরো ডিগ্রি সেলসিয়াস । কনকনে বাতাস আর শান্ত নীরব পাহাড় ঘেরা অঞ্চল দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম । অবজারভেটরির অবস্থান মোজুমি মাইনের প্রায় এক কিলোমিটার গভীরে ।  টানেলের ভেতর দিয়ে আমাদের যেতে যেতে মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমরা পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রবেশ পড়ছি ।  ভেতরে রয়েছে দুটি প্রধান ল্যাবরেটরি । একটিতে নিউট্রিনো কণা ডিটেকশনের যন্ত্রপাতি রয়েছে । ১৯৯৮ সালে যখন প্রথম সৌর নিউট্রিনোর পরীক্ষামুলক উপস্থিতি এই ল্যাবরেটরিতে প্রমাণিত হয় তখন সারা পৃথিবীতে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল । আসলে বেয়াদপ নিউট্রিনো কণাকে ল্যাবরেটরিতে এর আগে কিছুতেই শনাক্ত করা যাচ্ছিলনা । এই নিউট্রিনো অবজারভেটরিকে সুপার কেমিওকন্ডা বলা হয়ে থাকে । এর ঠিক পাশেই রয়েছে গ্র্যাভিটি ওয়েব বা মাধ্যাকর্ষণ  তরঙ্গ ডিটেকশনের ওপর ল্যাবরেটরি । এই তরঙ্গের তীব্রতা খুব কম হবার জন্য আজ পর্যন্ত একে শনাক্ত করা যায়নি । তবে আগামী পাঁচ ছয় বছরের মধ্যে এই সফলতাও আসবে বলে আশাবাদী সেখানকার জাপানি বিজ্ঞানীরা । কেমিওকা সম্বন্ধে বলতে গেলে আরো অনেক কথা বলতে হয় সেই প্রসঙ্গে আর যাচ্ছিনা ।
     জাপানে গিয়ে ট্রেন না চড়লে যাত্রাই অসমাপ্ত থেকে যায় । যদিও বুলেট ট্রেনে চাপা হয় নি, কিন্তু থান্ডার বার্ড এক্সপ্রেস চড়ার সৌভাগ্য হল । তোয়ামা ষ্টেশন থেকে আমরা ওসাকা ষ্টেশনে যাই । তারপর সেখান থেকে লোকাল ট্রেনে রিংকু ষ্টেশনে যেতে হবে যা কাঁশাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের খুব কাছেই । ওসাকা ষ্টেশন থেকেই শিবাই বিদায় নিলেন । তাঁর দায়িত্ব শেষ । বিদায় বেলায় মনটা ভারি হয়ে গেল । স্বল্প পরিচয়েই এই ব্যক্তির সঙ্গে  হৃদয়ের এক বন্ধন স্থাপিত হয় যা থেকে যাবে আজীবন । 
আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে কাঁশাই এয়ারপোর্ট ওয়াশিংটন হোটেলে । পাঁচ তারিখেই আমাদের ফেরার টিকিট ।      চার অক্টোবর সারাদিন ফাঁকা থাকার কারণে আমরা সবাই মিলে ঠিক করলাম যে সকালে কায়ুকান একোরিয়াম দেখতে বেরিয়ে যাব যা ওসাকা বন্দরের খুব কাছেই । এই একুরিয়াম পৃথিবীর বৃহত্তম একোরিয়ামের মধ্যে একটি । ভেতরে রয়েছে নানা সামুদ্রিক মাছ যে গুলির মধ্যে হাঙর, তিমি, সিল, জেলি ফিস ইত্যাদি উল্লেখ যোগ্য । পেঙ্গুইনের জন্য রয়েছে আলাদা একটি স্থান যেখানে কৃত্রিমভাবে বরফ বৃষ্টি হচ্ছে । এই বিশাল একুরিয়ামে কেমন করে সারাটা দিন কেটে গেল বউঝতেই পারলাম না । 
     পাঁচ অক্টোবর  । অবশেষে  চলে আসলো যাবার দিন । দুপুর দুটো দশে আমাদের ফ্লাইট । একদিনে যে এত দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ হবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি । বিদায় বেলায় প্রোফেসর শিবাইর একটা কথাই মনে পড়ছে জাপানকে যারা ভালবাসে, জাপান আবার তাদের ডেকে নিয়ে আসে ।   
     আবারও জাপান যাবার সুপ্ত বাসনা মনে রেখে উড়ে চললাম ভারতের দিকে ।

Sunday, August 28, 2011

তোমরা কেউ কি ওখানে আছো ?

উত্তেজনায় নড়েচড়ে বসলেন জোসলিন বেল বারনেল । রেডিও টেলিস্কোপে ধড়া পড়েছে এক আজব রেডিও তরঙ্গ । অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠলো সদ্য গবেষণায় পা রাখা মেয়েটির । সত্যিই কি ভিনগ্রহের কেউ  পৃথিবীতে বার্তা প্রেরণ করছে ? ব্যাপারটি তিনি জানালেন তাঁর সুপারভাইজার অ্যান্টনি হেউইস-কে ।  খবরটি পেয়ে তিনিও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন । তারপর দুজনে মিলে বহির্বিশ্বের নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে আসা তরঙ্গকে  কয়েকদিন ধরে অধ্যয়ন করেই চললেন । কিন্তু বার্তার পাঠোদ্ধার হয়ে উঠলোনা । অবশেষে গাইড আর ছাত্রী উভয়েই সেই রেডিও তরঙ্গের উৎসের এক জম্পেশ নামও দিলেন ছোট সবুজ মানুষ উনারা ধরে নিলেন যে কোনো ভিন গ্রহের মানুষ এই তরঙ্গ প্রেরণ করছে । কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী যেন জোসলিনের হাতের স্পর্শে জীবন্ত হয়ে উঠলো ।  এলিয়েনদের নিয়ে গুল গল্পের তাহলে এতদিনে অবসান ঘটতে চলল ! কিন্তু কে ভেবেছিল ২৮ নভেম্বর ১৯৬৭ সালের সেই দিনটিতে এক অভাবনীয় আবিষ্কার করে ফেলবেন জোসলিন ! 
     জোসলিন এবং হেউইস এর আবিষ্কার ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হবার পর সারা বিশ্বে শোরগোল পড়ে গেল । ছোট সবুজ মানুষ নিয়ে নুতন বিতর্কের জন্ম হল । তবে এই বিতর্কের রেশ বেশীদিন স্থায়ী হয়নি, কারণ থমাস গোল্ড নামে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী সে বছরই প্রমাণ করলেন যে আসলে সেটা ছিল এক আবর্তনশীল নিউট্রন তারা বা পালসার (পালসেটিং স্টার) । কোন নিউট্রন তারা যখন খুব তীব্র গতিতে নিজ অক্ষে পাক খেতে থাকে তখন সে রেডিও তরঙ্গ বিচ্ছুরণ করে । আর রেডিও টেলিস্কোপে সেই তরঙ্গই ধরা পড়েছিল । এই পালসারের চরিত্র সমুদ্রে দাঁড়িয়ে থাকা লাইট হাউসের সঙ্গে দারুণভাবে মিলে যায় । লাইটহাউসে যেমন নির্দিষ্ট সময় পর পর আলো দেখা যায় ঠিক তেমনি পালসার এর তরঙ্গও নির্দিষ্ট সময় পর পর ধরা দেয় । মনে হবে যেন কোন সিগনাল প্রেরণ হচ্ছে । পি এইচ ডি স্কলার জোসলিন বেল বারনেলের নাম জুড়ে গেল প্রথম পালসার আবিষ্কারক হিসেবে । পালসার-টির নামকরণ হল -সি পি ১৯১৯ ।  ভিনগ্রহী জীবের উপস্থিতির ব্যাপারটা তখন জোর ধাক্কা খেল । বেলের আবিষ্কার থেমে থাকেনি, তারপর তিনি আরো কয়েকটি পালসার আবিষ্কার করেন । ১৯৭৪ সালে জোসলিনের সুপারভাইজার অ্যান্টনি হেউইস-কে পালসারের আবিষ্কারক হিসেবে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় । তিনি পুরস্কারটি স্যর মার্টিন রাইল-এর সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেন । নোবেল পুরষ্কারের ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে এই সম্মানে ভূষিত হন । কিন্তু দুঃখের ব্যাপার জোসলিনকে সেই সম্মান দেওয়া হয়নি, আর সেটা নিয়েও বিতর্ক কম হয়নি । একজন ট্র্যাজেডি নায়িকা হয়েও নোবেল কমিটির উপর জোসলিনের কোন ক্ষোভ ছিলনা ।
     আমাদের সৌরজগতের বাইরেও কি কোন গ্রহ আছে ? আর সেই গ্রহে কি প্রাণের স্পন্দন থাকতে পারে ? মানুষ থেকেও উন্নত প্রাণী বহির্বিশ্বে থাকা সম্ভব কি ? অগণিত নক্ষত্র খচিত রাতের আকাশের দিকে চোখ রাখলে এমন প্রশ্ন মনে আসা স্বাভাবিক ।  আর তাই মানুষের কল্পনার জগতে আগমন ঘটতে লাগলো ভিনগ্রহী মানুষ বা এলিয়েন যারা নাকি মানুষ থেকেও প্রখর বুদ্ধিমান । ধীরে ধীরে কল্পবিজ্ঞানের কাহিনীতে আবির্ভূত হতে লাগলো বিদঘুটে সব এলিয়েন । আর্থার সি ক্লার্ক, কলিন হার্ভে, উইলিয়াম হিগস্মিথ ইত্যাদি কল্পবিজ্ঞান খ্যাত লেখক লিখতে লাগলেন দমবন্ধ হীন অবিশ্বাস্য গল্প। কিছু লেখক আবার এলিয়েনদের নিয়ে বাস্তব ঘেঁষা বই লিখতে লাগলেন । এখানে উল্লেখ করতে হয় এরিক ভন দানিকেনের । তার বিতর্কিত বইয়ের শিরোনাম ছিল দেবতা কি গ্রহান্তরের মানুষ ?দানিকেন কিছু বৈজ্ঞানিক তত্বের উল্লেখ করে বলতে চেয়েছিলেন যে মিশরীয় সভ্যতা, মায়া সভ্যতা ইত্যাদি সভ্যতার অগ্রগতির পেছনে রয়েছে ভিনগ্রহী মানবের পৃথিবীতে আগমন । এছাড়া আরো নানা ঘটনার আলোচনা করে তিনি বাজারে এই থিওরি প্রচার করতে চেয়েছিলেন যে দেবতারা আসলে এলিয়েন । শুরু হল বিতর্ক । দানিকেনের যুক্তিতর্ক ধোপে টিকেনি । বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেন যে দানিকেনের তত্ব ভুয়ো । নিছক ব্যবসার জন্যই তিনি এই পথ অবলম্বন করেছিলেন । তারপর যে বিষয় নিয়ে একটা সময় গোটা বিশ্বে চাঞ্চল্য দেখা দেয় সেটা হল ইউ এফ ও (আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লায়িং অবজেক্ট) বা উড়ন্ত চাকি । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পৃথিবীর নানা স্থানে বিশাল মহাকাশযান দেখা যায়  যেগুলো নাকি প্লেটের মত দেখতে । এই উড়ন্ত চাকি নাকি হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে কিছুক্ষণ থেকে তারপর গায়েব হয়ে যেত । নানা প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে উড়ন্ত চাকির গল্প উপকথা হয়ে উঠল । এখনো পাশ্চাত্য দেশে ইউ এফ ও নিয়ে নানা চাঞ্চল্যকর গল্প শুনা যায় । কিন্তু বিজ্ঞানের পাতায় ইউ এফ ও আজ পর্যন্ত নাম নথিভুক্ত করতে পারেনি । উপকথা বাস্তব হয়ে উঠেনি ।  সাহিত্যের অঙ্গন ছেড়ে ধীরে ধীরে কল্পনার ভিনগ্রহী মানুষ সেলুলয়েডের পর্দায় জ্যান্ত হয়ে উঠলো । হলিউডের ক্যারিসমাটিক স্পর্শে ই টি, মেন ইন ব্ল্যাক ইত্যাদি মুভি বিশ্বের বাজার তোলপাড় করে তুলল । বলিউডের কোই মিল গেয়া সাম্প্রতিক সংযোজন । বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে পা মিলিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতূহলও বাড়তে লাগলো । এলিয়েনদের সঙ্গে যোগাযোগ করার কি কোনো উপায় নেই ?
     ভাবতেই অবাক লাগে যে মাত্র একশো বছর আগেও কিছু বিজ্ঞানী বিশ্বাস করতেন যে মঙ্গল গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণী রয়েছে । ১৮৯৬ সালে নিকোলা টেসলা প্রথম প্রস্তাব দেন যে রেডিও-এর সাহায্যে ভিনগ্রহী প্রাণীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে । তারপর কিছু বিজ্ঞানীরাও টেসলার এই প্রস্তাবে সায় দেন । ১৯০০ সালের প্রথমদিকে বিখ্যাত বিজ্ঞানী মার্কোনি ভেবে বসেছিলেন যে তার রেডিওতে মঙ্গল গ্রহের প্রাণীদের পাঠানো বার্তা ধরা পড়ছে যা পাঠোদ্ধার করা যাচ্ছেনা । মজার ঘটনা হল ২১-২৩ আগস্ট, ১৯২৪ সালে যখন মঙ্গল গ্রহ পৃথিবীর সব থেকে নিকটে আসে তখন সারা বিশ্বে এক আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রশাসন, ন্যাভাল অবজারভেটরির বিজ্ঞানীরা মঙ্গলের উপর কড়া নজর রেখেছিলেন পাছে সেখানের প্রাণীরা পৃথিবী আক্রমণ করে না বসে । কিন্তু মঙ্গল কোন অমঙ্গলের বার্তা নিয়ে আসলনা । বিজ্ঞানীদের যৌথ  প্রয়াসে অবশেষে গড়ে উঠল -সার্চ  ফর এক্সট্রা টেরিস্ট্রিয়েল ইন্টেলিজেন্স (সেটি) ইন্সটিটিউট । প্রাথমিক পর্যায়ে বহির্বিশ্বে প্রাণের সন্ধান করাই মূল কাজ হয়ে উঠলো । ১৯৬০ সালে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রাঙ্ক ড্রেক প্রথম সেটি-এর জন্য  ২৬ মিটার ব্যাসের একটি রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করেন । প্রজেক্টটির নাম ছিল –‘প্রজেক্ট ওজমা মহাবিশ্বের নানা স্থানে রেডিও তরঙ্গ সন্ধান করাই ছিল এই টেলিস্কোপের মূল কাজ । ফ্রাঙ্ক ড্রেক অঙ্ক কষে একটি ফর্মুলা বের করেছিলেন যা ড্রেক সমীকরণ নামে পরিচিত এই সমীকরণের সাহায্যে মহাবিশ্বে কতটি গ্রহে প্রাণ থাকতে পারে তার একটা আভাস ছিল । সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা ড্রেক সমীকরণ-এর সাহায্যে তেমন কটি গ্রহে পৃথিবীর মত প্রাণ থাকতে পারে তার একটি হিসেব কষেছেন । সংখ্যা প্রায় ৬৩ কোটি ! তবে কিছু বিজ্ঞানীরা এই সমীকরণের বিরুদ্ধেও তাদের যুক্তি তুলে ধরেছেন ।  বর্তমানে উন্নত যন্ত্রপাতির সাহায্যে সেটি তাদের অনুসন্ধান চালিয়েই যাচ্ছে ।
     আমাদের সূর্যের সবথেকে কাছের নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টরাই প্রায় ৪.২ আলোকবর্ষ দূরে  রয়েছে । এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে আলোর গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার । এই আলোর এক বৎসর অতিক্রম করাকেই এক আলোকবর্ষ বলা হয় । তার মানে পৃথিবী থেকে যদি আমরা বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের মাধ্যমে ঐ  নক্ষত্রে বার্তা প্রেরণ করতে চাই হ্যালো আমরা পৃথিবী নামক এক গ্রহ থেকে বলছি, তোমাদের খবর বল! , তাহলে সেটা পৌছাতে সময় লাগবে ৪.২ বছর ! আর যদি উত্তর আসে তাহলে আরো ৪.২ বছর । সর্বমোট ৮.৪ বছর ! যদি আমরা মহাকাশযান নিয়ে ঐ গ্রহের দিকে ধেয়ে যাই তবে আমাদের জীবদ্দশাতেও ওই নক্ষত্রে পৌছাতে পারবোনা । তাই বিজ্ঞানীরা পৃথিবী থেকে বহির্বিশ্বের নানা দিকে বার্তা পাঠানোর ব্যাপারটাকেই  সঠিক ভেবেছেন । যদি ধরে নেওয়া যায় যে এলিয়েন মানুষের মতই বুদ্ধিমান তবেই আমাদের পাঠানো বার্তা তারা পাঠোদ্ধার করতে পারবে । আর এই যুক্তিকে সামনে রেখেই একটি রেডিও বার্তা বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন যা অরেসিবো বার্তা নামে পরিচিত অরেসিবো রেডিও টেলিস্কোপ থেকে ১৬ নভেম্বর ১৯৭৪ সালে প্রথম ঐ বার্তা এম ১৩ নামক এক তারকাপুঞ্জের দিকে প্রেরণ করা হয় যা সূর্য থেকে ২৫০০০ আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে । এই বার্তার মধ্যে মানব সভ্যতার নানা তথ্য ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে । যেমন-১ থেকে ১০ নম্বরের উপস্থিতি, জীব সৃষ্টির মূল উপাদান ডি এন এ এর আবিষ্কার, মানুষের পরিচিতি, সৌরজগতের গ্রহের সংখ্যা, টেলিস্কোপের আবিষ্কার ইত্যাদি । তবে এখনো পর্যন্ত কোনো জবাব আমরা পাইনি কারণ সেই বার্তা এতদিনে মাত্র ৩৭ আলোকবর্ষ দূরত্ব অতিক্রম করেছে ।
     আমাদের সৌরজগতের বাইরের নক্ষত্রগুলিতে কি গ্রহ আছে ? এ প্রশ্নটাই বিজ্ঞানীদের ভাবিত করে তুলেছিল । দূরবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কার রাতের আকাশকে নামিয়ে আনল মাটিতে । নিত্যনুতন আবিষ্কার পুলকিত করে তুলল আমাদের তথ্য ভাণ্ডারকে । ধীরে ধীরে মহাবিশ্বের কিছু কিছু রহস্য আমাদের কাছে পরিষ্কার হতে লাগলো ।  কিন্তু বহির্বিশ্বে গ্রহের উপস্থিতি পরীক্ষামূলক ভাবে প্রমাণ করা যাচ্ছিলোনা ।  কারণটা অবশ্যই দূরত্ব । আসলে একটি তারার আলোতেই আলোকিত হয়ে উঠে গ্রহ । আর দূরত্ব বাড়লে অতি শক্তিশালী দূরবীন দিয়েও গ্রহকে চিহ্নিত করা যায়না । তখন পরোক্ষ উপায়ের উপর নির্ভর করতে হয় । বিজ্ঞানীরা উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে ১৯৮৮ সালে প্রথম সৌরজগতের বাইরে গ্রহের সন্ধান পান । শুরু হয় এক নুতন অধ্যায় । তারপর গ্রহ আবিষ্কারের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান । সৌরজগতের বাইরে গ্রহের অস্তিত্ব জানার তাগিদেই কেপলারের জন্ম । জন্মের পর থেকেই সে  বহির্বিশ্বের দিকে ক্রমাগত নজর রেখে চলেছে । ওহ বলতেই ভুলে গেছি আসলে কেপলার কোন মানুষ নয়, সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা প্রেরিত একটি মহাকাশযান । জার্মানির বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী কেপলারের নামানুসারেই তার এই নাম যাকে গত ৭ মার্চ ২০০৯ সালে পৃথিবী থেকে প্রেরণ করা হয়েছিল । তারপর থেকেই তার জয়যাত্রা অব্যাহত । তার ঝুলিতে এখন ১২২টি  গ্রহ আবিষ্কারের কৃতিত্ব । এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত ৫৭৩টি বহির্বিশ্বের মধ্যে কিছু গ্রহ আবার আমাদের পৃথিবীর মতই । বিজ্ঞানীরা কোন কোন গ্রহে জলের অস্তিত্বের কথাও বলছেন । জল থাকলেই যে প্রাণের সম্ভাবনা প্রবল । তাই গবেষকেরা উৎফুল্লিত হয়ে উঠেছেন । হয়তো প্রাণের বীজ বপন হয়ে গেছে  সেইসব গ্রহতে । আসলে নুতন গ্রহের সন্ধান পেলেই দেখে নেওয়া হয় যে প্রাণ সৃষ্টির প্রাথমিক কাঁচামাল ঐ গ্রহে আছে কি না ।
সম্প্রতি আবার একটি খবর জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের চমকে দিয়েছে । সৌরজগত থেকে প্রায় ৭৫০ আলোকবর্ষ দূরে একটি নুতন গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে যা নাকি কয়লার থেকেও কালো । সৌরজগতের সব থেকে বড় গ্রহ বৃহস্পতির মতই তার আকার । এই জাম্বো গ্রহের এক পোশাকি নামও দিয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা - টি আর ই এস-২বি সৌরজগতের বাইরে এমন কৃষ্ণতম গ্রহের আবিষ্কারে আশ্চর্যান্বিত হয়ে উঠেছেন বিজ্ঞানীরা । কয়লার থেকেও কালো এই গ্রহের ঔজ্জ্বল্য খুবই কম । গ্রহটির দূরত্ব তার নিকটবর্তী নক্ষত্র থেকে মাত্র ৩০ লক্ষ মাইল  । যেখানে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব প্রায় ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল ! এত কম দূরত্বের অবস্থানের জন্য এই জাম্বো গ্রহের তাপমাত্রা প্রায় ১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস । গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে সোডিয়াম,পটাসিয়াম,টাইটানিয়াম অক্সাইড ইত্যাদি উপস্থিতির প্রমাণ রয়েছে ।  বিজ্ঞানীরা এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না তার এত কালো হয়ে উঠার মূল কারণ । আসলে এখনো পর্যন্ত ৫৭৩ টি আবিষ্কৃত বহির্গ্রহের সঙ্গে এর চরিত্র যে কিছুতেই মিলছেনা । গ্রহটির কৃষ্ণাঙ্গ হবার নেপথ্য কারণ অনুসন্ধানই হবে আগামীতে সবথেকে বড় আবিষ্কার । এই গ্রহটি গত ২১শে আগস্ট ২০০৬ এ আবিষ্কৃত হয়েছিল ট্রান্স-আটলান্টিক এক্সো প্ল্যানেট সার্ভের মাধ্যমে । মজার ব্যাপার হল গ্রহটি তখন আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে মহাকাশযান কেপলার চলতি মাসে তাকে বিশ্লেষণ করে এমন বিস্ফোরক তথ্য দিতে পারে । যেহেতু ঐ গ্রহে জল থাকার সম্ভাবনা খুবই কম, তাই প্রাণের উপস্থিতি সেখানে প্রায় নেই বললেই চলে ।  গ্রহটি কালো হলেও তার প্রতি বিজ্ঞানীদের আকর্ষণ কিন্তু এতটুকুও কমেনি ।   
     এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর বাইরে প্রাণের উপস্থিতির কোন পরীক্ষামূলক প্রমাণ নেই । কে জানে হয়তো আগামীতে সেটা সম্ভব হবে । তবে চিন্তার ব্যাপার যেভাবে কিছু ক্ষমতাধর অসৎ ব্যক্তি বিজ্ঞানের অপব্যবহার করে পৃথিবীর ধংসলীলায় মত্ত হয়েছে, এতে মানবসভ্যতার স্থায়িত্বের প্রশ্ন থেকেই যায় । পারমানবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমার আঘাতে মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে পৃথিবী । কে বলতে পারে হয়তো আগামী শতাব্দীতে উড়ন্ত চাকী চেপে একদল এলিয়েন এসে এই গ্রহে উপস্থিত হতে পারে ।  কিন্তু প্রাণহীন গ্রহের ধ্বংস স্তূপে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তখন তাদের আর কিছুই করার থাকবেনা ।

Saturday, August 20, 2011

সৌরজগতের বাইরে সবথেকে কৃষ্ণতম গ্রহ আবিষ্কৃত



যুগান্তকারী আবিষ্কার করে খবরের শিরোনামে কেপলার । সৌরজগত থেকে প্রায় ৭৫০ আলোকবর্ষ দূরে একটি নুতন গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে যা নাকি কয়লার থেকেও কালো । সৌরজগতের সব থেকে বড় গ্রহ বৃহস্পতির মতই তার আকার । এই জাম্বো গ্রহের এক পোশাকী নামও দিয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা - টি আর ই এস-২বি ।     
আমাদের সৌরজগতের বাইরেও কি কোন গ্রহ আছে ? অগনিত নক্ষত্র খচিত রাতের আকাশের দিকে চোখ রাখলে এমন প্রশ্ন মনে আসা স্বাভাবিক । তারপর আবার যে প্রশ্ন মস্তিষ্কের দরজায় নক করবে  সেটা হল এই মহাবিশ্বের কোন একটি গ্রহে কি আমাদের পৃথিবীর মতই প্রাণের স্পন্দন আছে ? এর উত্তর আজও আমরা জানিনা । দূরবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কার রাতের আকাশকে নামিয়ে আনলো মাটিতে । নিত্যনুতন আবিষ্কার পুলকিত করে তুললো আমাদের তথ্য ভাণ্ডারকে । ধীরে ধীরে মহাবিশ্বের কিছু কিছু রহস্য আমাদের কাছে পরিষ্কার হতে লাগলো । কিন্তু বহির্বিশ্বে গ্রহের উপস্থিতি পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করা যাচ্ছিলনা ।  কারণটা অবশ্যই দূরত্ব । আসলে একটি তারার আলোতেই আলোকিত হয়ে উঠে গ্রহ । আর দূরত্ব বাড়লে অতি শক্তিশালী দূরবীন দিয়েও গ্রহকে চিহ্নিত করা যায়না । তখন পরোক্ষ উপায়ের উপর নির্ভর করতে হয় । বিজ্ঞানীরা উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে ১৯৮৮ সালে প্রথম সৌরজগতের বাইরে গ্রহের সন্ধান পান । শুরু হয় এক নুতন অধ্যায় । তারপর গ্রহ আবিষ্কারের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান । সৌরজগতের বাইরে গ্রহের অস্তিত্ব জানার তাগিদেই কেপলারের জন্ম । জন্মের পর থেকেই সে  বহির্বিশ্বের দিকে ক্রমাগত নজর রেখে চলেছে । তার ঝুলিতে এখন ১২২টি  গ্রহ আবিষ্কারের কৃতিত্ব । ওহ বলতেই ভুলে গেছি আসলে কেপলার কোন মানুষ নয়, সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা প্রেরিত একটি মহাকাশযান । জার্মানির বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী কেপলারের নামানুসারেই তার এই নাম যাকে গত ৭ মার্চ ২০০৯ সালে পৃথিবী থেকে প্রেরণ করা হয়েছিল । তারপর থেকেই তার জয়যাত্রা অব্যাহত । কেপলার বেঁচে থাকলে সাম্প্রতিক আবিষ্কারের খবরটা পেয়ে উল্লাসে তিনি মেতে উঠতেন সন্দেহ নেই ! 
     সৌরজগতের বাইরে এমন কৃষ্ণাকার গ্রহের আবিষ্কারে আশ্চর্যান্বিত হয়ে উঠেছেন বিজ্ঞানীরা । কয়লার থেকেও কালো এই গ্রহের ঔজ্বল্ল খুবই কম । গ্রহটির দূরত্ব তার নিকটবর্তী নক্ষত্র থেকে মাত্র ৩০ লক্ষ মাইল  । যেখানে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব প্রায় ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল ! এত কম দূরত্বের অবস্থানের জন্য এই জাম্বো গ্রহের তাপমাত্রা প্রায় ১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস । গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, টাইটানিয়াম অক্সাইড ইত্যাদি উপস্থিতির প্রমাণ রয়েছে ।  বিজ্ঞানীরা এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না তার এত কালো হয়ে উঠার মূল কারণ । আসলে এখনো পর্যন্ত ৫৭৩ টি আবিষ্কৃত বহির্গ্রহের সঙ্গে এর চরিত্র যে কিছুতেই মিলছেনা । গ্রহটির কৃষ্ণাঙ্গ হবার নেপথ্য কারণ অনুসন্ধানই হবে আগামিতে সবথেকে বড় আবিষ্কার । এই গ্রহটি গত ২১শে আগস্ট ২০০৬ এ আবিষ্কৃত হয়েছিল ট্রান্স-আটলান্টিক এক্সো প্ল্যানেট সার্ভের মাধ্যমে । মজার ব্যাপার হল গ্রহটি তখন আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে মহাকাশযান কেপলার এই মাসে তাকে বিশ্লেষণ করে এমন চমকপ্রদ তথ্য দিতে পারে । যেহেতু ঐ গ্রহে জল থাকার সম্ভাবনা খুবই কম, তাই প্রাণের উপস্থিতি সেখানে প্রায় নেই বললেই চলে ।  গ্রহটি কালো হলেও তার প্রতি বিজ্ঞানীদের আকর্ষণ কিন্তু এতটুকুও কমেনি । মহম্মদ রফি জীবিত থাকলে নায়কটি আর ই এস-২বি গ্রহটির লিপে অবশ্যই এই গান গাইতেন –‘হাম কালে হ্যায় তো কেয়া হুয়া... দিলওয়ালে হ্যায়। 

Wednesday, July 27, 2011

‘হ্যাকিং’ – ছায়া-যুদ্ধের এক নুতন নাম




থ্যাঙ্ক্‌ ইউ এন্ড গুডবাই
অপ্রত্যাশিত শব্দাঘাত ! ১০শে জুলাইর ঝলমলে সকালে এক সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের প্রচ্ছদের কিছু শব্দ হৃদয় কাঁপিয়ে তুলল ব্রিটেনের ২৬ লক্ষ পাঠকদের । তাদের প্রিয় পত্রিকা নিউজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড আর আগামীতে প্রকাশিত হবেনা ।
বয়স ? ১৬৮ বছর ! 
সেই ১ অক্টোবর ১৮৪৩ সাল থেকে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল । সুদীর্ঘ ১৬৮ বছরে  ব্রিটেনের নানা চমকপ্রদ তথ্য ছাড়াও সেখানের সেলিব্রেটি, রাজপরিবারের নানা কেচ্ছা কাহিনীর সাতকাহন বর্ণনা করে সে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে গিয়েছিল । বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাঠক-সমৃদ্ধ ইংরেজি পত্রিকাটির হঠাৎ এই ছন্দপতন তাই অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না । পত্রিকাটিকে পাঠক সমাজের কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য পত্রিকাগোষ্টী সেলিব্রেটিদের ফোনে আড়িপাতার মত অসদুপায় অবলম্বন করে । সম্প্রতি পত্রিকাগোষ্টীর বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে গুরুতর অভিযোগ প্রমাণ সহ নিয়ে আসা হয় । তাই এত জনপ্রিয়তার মধ্যেও পত্রিকাটিকে অবশেষে অবসরের পথে যেতে হয়েছে । ফোন হ্যাকিং কেলেঙ্কারির অভিযোগ নিয়ে সারা ব্রিটেন এখন তোলপাড় !  হয়ে গেছে নানা নাটক !
নাটকের নেপথ্যে রয়েছে হ্যাকিং এর কালো ছায়া । যার বিষাক্ত নিঃশ্বাসে সারা বিশ্বে ছায়া-যুদ্ধের আবহ তৈরি হয়ে গেছে । আজ কোন দেশই এর আওতা থেকে মুক্ত নয় । নুতন এই দৈত্যের বাড়বাড়ন্ত ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে ।  আসলে বর্তমান দুনিয়ায় চোরের চুরি করার ধরণও বদলেছে । তথ্য প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে চুরি করাকেই সোজাসাপটা ভাষায় হ্যাকিং বলা হয় । আর এই কর্মের সঙ্গে যারা যুক্ত থাকেন তাদের বলা হয় হ্যাকার।এই হ্যাকিং আবার জন্ম দিয়েছে সাইবার টেরোরিস্‌ম্‌কে । হাজার ক্রোশ দূরে থেকেও আক্রমণ করবার নুতন এই পদ্ধতি কালো জগতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের কাছে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে । হ্যাকিংয়ের সাধনায় মত্ত কিছু দুষ্ট ব্যক্তির মদমত্ততায় কেঁপে উঠেছে বিশ্ব ।  


 
প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য হ্যাকিংকে ব্যবহার করা হত । কোন ব্যক্তির অজান্তে তার বিস্তারিত তথ্য জেনে হ্যাকাররা তাকে নানাভাবে উত্যক্ত করার পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হবার চেষ্টা করতো । ঠিক সেই ভাবে নিউজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড এর সাংবাদিকেরা ফোন হ্যাকিং এর সাহায্যে সেলিব্রেটিদের ফোনে আড়ি পেতে জম্পেশ রিপোর্ট পরিবেশন করে পত্রিকাটিকে জনপ্রিয় করার মত অপরাধ করেছে । কিছু পুলিশ কর্মীর পরোক্ষ মদতে পত্রিকাগোষ্টী অনেকদিন ধরেই এই হ্যাকিং চালিয়ে যাচ্ছিল । অবশেষে সরকারের তরফ থেকে কঠিন অবস্থান নেওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে । বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে তথ্য চুরির অভিযোগ বাড়ছে । মূলত: আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোই সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয় । কখনো ব্যক্তিগত উদ্যোগে আর কখনো সমষ্টিগতভাবে নানা ওয়েবসাইট আক্রমণ করা হয় । কারণ ? ধ্বংসের ম্যাপ তৈরি করা ।
     মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার ঠাণ্ডা যুদ্ধের ছায়া যেন আবার ফিরে এসেছে । এবার আর সম্মুখ সমরে যুদ্ধ নয়, ইন্টারনেটের বিশাল সাম্রাজ্য সাইবার জগতে শুরু হয়েছে ঠাণ্ডা লড়াই । হ্যাকিংয়ের আঘাতে বিশ্বের জর্জরিত দেশগুলি মুক্তিলাভের উপায় খুঁজছে । আসলে হ্যাকিং এখন শুধু আর আতঙ্কবাদীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে এখন নানা রাষ্ট্রপ্রধানদের অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছে । হ্যাকিংকে হাতিয়ার করে এক অঘোষিত যুদ্ধও ঘোষণা হয়ে গেছে । কিছু কিছু দেশের বিরুদ্ধে তাই উঠেছে ইন্টারনেটে তথ্য চুরির অভিযোগ ।
     সম্প্রতি হ্যাকিং নিয়ে চীন-মার্কিন সম্পর্ক উত্তপ্ত হয়েছে । সাইবার জগতের সর্ববৃহৎ সার্চ ইঞ্জিন গুগল চীনের বিরুদ্ধে তথ্য চুরির অভিযোগ নিয়ে এসেছে । বিশ্বের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গুগলের ই-মেল সার্ভিস জি মেল-এর ব্যবহারকারীরা । এই বৃহৎ মার্কিন কোম্পানির অভিযোগ চীনে তাদের ই-মেল সার্ভিসের কয়েক হাজার গ্রাহক  হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছাড়াও রয়েছেন সরকারি, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা এবং সাংবাদিক মহল । অবশ্য চীন বরাবরের মতই হ্যাকিং নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন বলেছে । মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফ বি আই এরই মধ্যে অনুসন্ধানে নেমে পড়েছে । চীনা হ্যাকিংয়ের রেশ মিটতে না মিটতেই আবার হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । সেখানের প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন-এ ভয়াবহ সাইবার আক্রমণ চালানো হয়েছে । পেন্টাগনের কম্পিউটার থেকে প্রায় চব্বিশ হাজার নথি চুরি হয়ে গেছে । অনেক স্পর্শকাতর তথ্যও হ্যাকাররা গায়েব করে দিয়েছে । মার্কিন উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী উইলিয়াম লিন এই ঘটনাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ সাইবার হামলা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন । 


     ভারতেও ওয়েবসাইট শিকারের নানা ঘটনা সামনে এসেছে । মূলত: পাকিস্তান আর চীনের হ্যাকারদের তরফ থেকেই আক্রমণের খবর সবচেয়ে বেশী। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা সি বি আই-এর ওয়েবসাইটকে হ্যাকিং করে রীতিমত হইচই ফেলে দিয়েছিল হ্যাকাররা । এছাড়া নানা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটও হ্যাকারদের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । অনেক গ্রাহকের অনলাইন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকেও টাকা হাপিশ হয়ে যাবার নজিরও রয়েছে । ভারতের তরফ থেকে ওয়েবসাইটকে সুরক্ষা করার জন্য নানা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে । কিন্তু হ্যাকাররাও নিত্যনুতন কৌশল উদ্ভাবন করে ওয়েবসাইটের সিকিউরিটিকে বিধ্বস্ত করার কাজ করেই যাচ্ছে ।  
     মজার একটি ঘটনা বলেই ইতি টানবো নিবন্ধের ।  গত মাসে লুলজ সিকিউরিটি নামে একটি হ্যাকার গ্রুপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ, বহুজাতিক কোম্পানি সোনি, ব্রিটিশ পুলিশের ওয়েবসাইট ইত্যাদি হ্যাকিং করে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে । তাদের আক্রমণে বিশ্বের বৃহৎ বৃহৎ কোম্পানি আর সরকারি ওয়েবসাইটগুলো মুখ থবড়ে পড়ে । সাইবার জগতে রীতিমত চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পরিকল্পিত পঞ্চাশ দিনব্যাপী হ্যাকিংয়ের পর তারা অভিযানের সমাপ্তি টেনেছে ।  এখনো লুলজের বিস্তারিত খবর তেমনভাবে জানা যায়নি ।  তবে ধারণা করা হচ্ছে লুলজ বেনামি হ্যাকারদের একটি দল ।
     হ্যাকারদের প্রতিরোধের জন্য ইতিমধ্যে নানা দেশে গড়ে উঠেছে অ্যান্টি-হ্যাকারদের দল । যারা রীতিমত লড়াই করছে সাইবার জগতে । তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হয়তো হ্যাকারদের নির্মূল করা সম্ভব হবে । ওয়েবসাইটের সুরক্ষা আরো মজবুত হচ্ছে । সাইবার অপরাধে নানা আইনও বলবত হচ্ছে দেশে দেশে । সেদিন বোধহয় আর দূরে নেই যখন হ্যাকিংয়ের অন্তর্জলী যাত্রা হবে । তখন অ্যান্টি-হ্যাকারদের অবশ্যই বলবো  থ্যাঙ্ক্‌ ইউ আর হ্যাকারদের - গুডবাই