-“আপনার কাছে কি ভারতীয় টাকা আছে?”
ডিনার টেবিলে অপ্রত্যাশিত প্রশ্নটি শুনে অবাকই হলাম । প্রশ্নকর্তা জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ হিরোশি শিবাই । হতাশ হয়ে জানাতেই হল যে নেই । কারণ জাপানের ফ্লাইটে ওঠার আগে নতুন দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভারতীয় টাকার বদলে জাপানি মুদ্রা ‘ইয়েন’ এক্সচেঞ্জ করার ফলে তখন আমার পার্সে শুধুই ইয়েন । অবশেষে আমাদের টেবিলেরই অপর এক ভারতীয় বন্ধুর কাছে মিললো একটি একশো টাকার নোট । সেই টাকাটি ডঃ শিবাইর হাতে তুলে দিতেই তিনি তার ছাত্রের হাতে সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে বললেন, -“ভারতকে জানতে হলে এই একশো টাকার নোটের মধ্যে কতগুলো ভারতীয় ভাষা আছে সেটা আগে দেখে নাও । বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, এটাই ভারতীয় ঐতিহ্যের মূল মন্ত্র ।”
ওসাকার মিনামি আওয়াজি রয়েল হোটেলে প্রথম সন্ধ্যায় ভারত থেকে চব্বিশজন গবেষকদের নিয়ে ডিনার পার্টিতে পরিচয় বিনিময়ের সময় জাপানের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ভারত নিয়ে উৎসাহ দেখে খুব ভাল লাগলো । ডিনার টেবিলে নানা বার্তালাপের পর ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পি এচ ডি স্কলার হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করে যে ভারতীয় ঐতিহ্যের আলাদা কোন বৈশিষ্ট্য আছে কি না !
ভাবছি কোথা থেকে শুরু করা যায় -তখনই পাশে বসা ডঃ শিবাই আমার কাছে ভারতীয় টাকা চাইলেন । একটি ভারতীয় একশো টাকার সাহায্যে দারুণ সিক্সার মেরে খুব স্বল্প কথায় ভারত নিয়ে অনেককিছুই তিনি বলে ফেললেন । ভারতের ঐতিহ্য নিয়ে অনেক পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা এর আগেও অনেক বক্তার মুখে শুনেছি, কিন্তু শিবাইর এই অল্প কথায় ভারতের বিশেষত্বকে তুলে ধরার এই যে অসাধারণ প্রয়াস এককথায় তা অ-পূর্ব । ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা এশিয়া অ্যাকাডেমিক সেমিনারের কোঅর্ডিনেটর ডঃ হিরোশি শিবাইর এই ভারত প্রীতিতে আমরা মুগ্ধ । স্বাভাবিকভাবেই সদা হাস্যময় সেই মানুষটির প্রথম দিন থেকেই ফ্যান হয়ে গেলাম ।
৩০ শে মে, ২০১১ । দুপুর তিনটেয় গতানুগতিক ভাবে ই-মেলের ইনবক্সে খুঁজে বেড়াচ্ছি কোন গুরুত্বপূর্ণ মেল এসছে কি না ! হঠাৎই চোখ পড়ে যায় একটি মেলে । প্রেরকের নাম আর মেলের বিষয় দেখে স্বভাবতই উত্তেজিত । “আপনি জে এস পি এস-ডি এস টি সেমিনারে জাপান যাবার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন ...” – তারপর কি লেখা আছে সেদিকে আর চোখ পড়েনি । প্রেরক আর কেউ নন, প্রোফেসর অজিত কেমভাবি, যিনি পুনের ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি এন্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আয়ুকা) –এর ডিরেক্টর । আমার স্বপ্ন তখন হাতের মুঠোয় । কারণ জাপান নিয়ে আমার আগ্রহ সেই বাল্যকাল থেকেই । প্রযুক্তির তীর্থক্ষেত্র নিয়ে অনেক বই পড়েছি । কল্পনার ক্যানভাসে এঁকেছি জাপানকে নিয়ে কত ছবি । আর অবশেষে কি না সেই স্বপ্নের দেশের দিকেই পা বাড়াতে চলেছি, ভাবতেই কেমন লাগছিল । আমার তখন নতুন মিশন - সূর্যোদয়ের দেশ । ভারত আর জাপানের যৌথ উদ্যোগে ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাপানের ওসাকাতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর এক আন্তর্জাতিক সেমিনার হবে । ভারত থেকে মোট ২০ জন গবেষক নির্বাচিত হয়েছেন । সেমিনারের বিষয় ‘রিসেন্ট এন্ড ফিউচার অ্যাডভান্সেস ইন অবজার্ভেশনাল অ্যাস্ট্রোনমি’ । ভারত সরকারের ‘ডিপার্টমেন্ট অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি’ (ডি এস টি) আমাদের জাপান যাত্রার খরচ এবং জাপান সরকারের ‘জাপান সোসাইটি ফর দ্য প্রমোশন অব সায়েন্স’ (জে এস পি এস) সেখানে ভারতীয় গবেষকদের থাকা এবং খাওয়ার বন্দোবস্ত করবে । তারপর সময় কিভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না, যাবার দিন খুব দ্রুত ঘনিয়ে এলো । বিমান টিকিট এবং ভিসাতেও কোন ঝামেলা হলনা ।
২৪ সেপ্টেম্বর রাত ঠিক সাড়ে এগারোটায় নুতন দিল্লী থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ছাড়লো জাপানের ওসাকা নগরীর উদ্দেশ্যে । যাত্রার সময় সুদীর্ঘ তেরো ঘণ্টা । মধ্যে হংকং-এ এক ঘন্টার বিরতি । জাপান নিয়ে আগাম কিছু পড়াশোনাও করেছিলাম, সেটা ভাবতে ভাবতেই চোখে ঘুম জড়িয়ে এল । হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল ৭ টা । বিমান সেবিকারা প্রাতরাশ পরিবেশন শুরু করেছেন । আমার পাশে বসা এক জাপানি যুবকের হাতের ‘রোলস রয়েস’ ঘড়িটির দিকে নজর গেল । তার ঘড়িতে সময় তখন সাড়ে দশটা । রোলস রয়েসের এই সময়টাই মনে করিয়ে দিলো যে জাপানের সঙ্গে আমাদের সময়ের ব্যবধান সাড়ে তিন ঘণ্টা । সঙ্গে সঙ্গে আমার নিজের ঘড়ি বাবাজীকে জাপানের টাইম সিস্টেমে সেট করতে গিয়ে দেখি চাবি জ্যাম হয়ে গেছে । বোধহয় ভারতের সময় সে তার হৃদয়ে রেখে দিতে চায় । যাই হোক তখন থেকেই জাপানের সময়ের সঙ্গে মানসিকভাবে আমার পথযাত্রা শুরু হল।
২৫শে সেপ্টেম্বর দুপুর ঠিক সাড়ে বারোটায় কাঁশাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমাদের বিমান নামলো । তখন থেকেই জাপানের ‘টেকনো লাইফ’এর সঙ্গে হাত মেলানো শুরু হল । যাবার পথে স্বয়ংক্রিয় এক কামরার ট্রেন আমাদের নিয়ে চললো ইমিগ্রেশনের চেকিং এর পথে । যেখানে প্রায় সহজেই পঁচিশ-ত্রিশ জন যাত্রী ভালভাবেই যেতে পারে । তারপর বলতে গেলে খুব তাড়াতাড়ি আমাদের মালপত্র ডিপারচার গেটে চলে এলো । জাপানের মাটিতে পা রাখার পর থেকেই দেখেছি খুব নীরবে আর নিয়মতান্ত্রিক ভাবে সবাই কাজ করছে । অভ্যর্থনার জন্য ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা সেমিনারের কোঅর্ডিনেটর ডঃ হিরোশি শিবাই নিজে তাঁর দু’জন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। আমাদের পরবর্তী গন্থব্যস্থল ‘আওয়াজি দ্বীপ’ । বিমানবন্দর থেকে যেতে সময় লাগবে তিন ঘণ্টা । সেখানেই মিনামি আওয়াজি রয়েল হোটেলে যেখানে আমাদের থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে । আগামী কয়েকদিন সেমিনার এই হোটেলেরই কনফারেন্স রুমে হবে ।
এরপর শুরু হল অত্যাধুনিক বাসে চেপে যাত্রা । বিমান যাত্রার ক্লান্তি সত্ত্বেও জানালা দিয়ে জাপানের যে টুকরো ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক কথায় চোখ জুড়ানো ও আবেশময় । শিল্প আর প্রযুক্তির প্রকৃত মেলবন্ধনের দেশে এসে আমরা তখন অভিভূত । ভারতীয় বন্ধুদের প্রায় প্রত্যেকের হাতেই তখন ক্যামেরা ঝলসে উঠছে । আমি আর তখন ছবি তুলে দেখার মজাটা মাটি করলাম না,আর মনও সায় দিচ্ছিলনা । কারণ জানতাম জাপানের এই সৌন্দর্যের তিলমাত্রও ক্যামেরায় বন্দী করা সম্ভব নয় । প্রকৃতি প্রদত্ত ক্যামেরার সাহায্যে সৌন্দর্যের সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ নয় কি? রাস্তার আশে পাশে নানা আকৃতির মনোহরণকারী উঁচু উঁচু অট্টালিকা দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেল । একটা জিনিষ দেখলাম জাপানে ঝুলন্ত ব্রিজের খুব রমরমা । আসলে জাপান একটি দ্বীপ রাষ্ট্র হওয়ায় সেখানে ছোট বড় দ্বীপের সংখ্যা অসংখ্য, আর পাহাড়ি অঞ্চলের ক্ষেত্রফলও অনেক বেশী । সমুদের ঠিক পাশ দিয়েই আমাদের গাড়ি ছুটছিল । নীল আকাশ আর নীল জলের ব্যাকগ্রাউন্ডে ছোট্ট ছোট্ট সাদা ডিঙি নৌকাগুলো দূর থেকে দূরান্তরে মিলিয়ে যাচ্ছে । সমুদ্রের পাশে সৈকতে বাচ্চাদের কেউ কেউ ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, আবার কেউবা বিজ্ঞের মত বড়দের নকল করে তাঁদের পাশে বসে মাছ ধরছে । এক্সপ্রেস হাইওয়েতে এত গাড়ি চলছে কিন্তু কোন গাড়ির হর্ন শুনা যাচ্ছেনা । সবাই নীরবে যে যার গাড়ি নিয়ে আপন গন্থব্যস্থলের দিকে ছুটে চলছে । বিদেশের অনেক উন্নত দেশের মতই জাপানেও হর্ন বাজানোটা অসভ্যতার পর্যায়ে পড়ে । সবথেকে ভাল লাগছিল স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থার ভেলকি দেখে । লাল, হলুদ আর সবুজ আলোর কেরামতিতে রাস্তার ট্রাফিক সুনিয়ন্ত্রিত । আইনের সম্মান জানাতে অভ্যস্ত জাপানিরা আইন ভঙ্গের কথা ভাবতেও পারে না । রাস্তায় তেমন ট্রাফিক পুলিশও নজরে পড়ছিলনা । পরবর্তীতেও জাপানের নানা অঞ্চলে ভ্রমণ কালে দেখেছি যে ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা খুবই নগণ্য । আর একটি লক্ষণীয় ব্যাপার হল রাস্তার বাঁকের মোড়ে-মোড়ে বড় বড় উত্তল দর্পণ লাগানো আছে, যার সাহায্যে বাঁকের ঐ পাশ থেকে কোন গাড়ি আসছে কিনা সহজেই বোঝা যায় । ফলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও কম । ধীরে ধীরে আমাদের বাস শহর থেকে দূরে পল্লী অঞ্চলে প্রবেশ করে । চারপাশে পিকচার পোস্ট কার্ডের মত সুদৃশ্য কাঠের ছোট ছোট ঘর । সেখানকার ছিমছাম রাস্তা দেখে মন ভরে যায় । শহরের নাগরিক জীবনের সৌন্দর্য থেকে এর রূপ ভিন্ন-সহজেই মন কাড়ে । আমাদের দেশের গ্রামের কথা ভেবে দুঃখ হচ্ছিল । গ্রামের সমতল জমিতে প্রচুর সোনালি ধান খেত দেখতে পেলাম । স্বস্তি পেলাম যে বিদেশে এসেও বাঙালির রসনায় ডাল (!) ভাতের অভাব হবে না । কিন্তু খাওয়া নিয়ে আগামীতে কী যে দুর্ভোগ আছে মুগ্ধ মন তখন তা কল্পনাও করতে পারেনি !
“আজ থেকে ঠিক সতেরো বছর আগে এই ঘরে যখন বসে আছি তখন আচমকা ভূমিকম্পে আমরা ভয়ার্ত হয়ে উঠি । পাশের ঘরেই আমার নাতি নাতনিরা বসে পড়াশোনা করছিল । একটা ভীষণ শব্দ শুনে ছুটে গিয়ে দেখতে পাই তাদের উপরেই প্রায় একটি আলমারি কাত হয়ে পড়ে আছে । সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাই । সৌভাগ্যবশত সামান্য আহত হওয়া ছাড়া ওদের কোন বিপদ ঘটেনি । চারিদিকে তখন ভীত ত্রস্ত হাহাকার । কয়েক সেকেন্ডের কম্পনে আমাদের এই হকুদান শহর তছনছ হয়ে যায় । ”
কথা হচ্ছিল ৮৭ বছরের জনৈক এক জাপানি বৃদ্ধের সঙ্গে । সেদিনের ভূমিকম্পের বর্ণনা দিতে গিয়ে এত বছর পরও তাঁর চোখে আতঙ্কের ছবি । বয়স তার স্মৃতিকে ম্লান করতে পারেনি । বৃদ্ধ জাপানি ভাষাতেই বলছিলেন আর শিবাই আমাদের ইংরেজিতে সব বুঝিয়ে বলেন । স্থান-হকুদান ভূমিকম্প স্মারক পার্ক । আমাদের হোটেল থেকে মাত্র এক ঘন্টার পথ । জাপানের ভূমিকম্প নিয়ে আমাদের কৌতূহলের ব্যাপারটা শিবাই বুঝতে পেরেছিলেন । সেমিনারের অনবরত বক্তৃতা থেকে অব্যাহতি দিতে তিনি ২৯ সেপ্টেম্বরের বিকেলটা আমাদের আশেপাশে দর্শনীয় স্থানে বেড়াতে নিয়ে গেলেন । হোটেল থাকে যাত্রা শুরু করে দুপুর ঠিক তিনটেতে স্মারক স্থলে পৌঁছে গেলাম । সেখানেই রয়েছে ১৭ জানুয়ারি ১৯৯৫ সালের ভূমিকম্পের কিছু ভয়াবহ স্মৃতি । সে সময় নানা স্থানে ফাটল দেখা দেয় । তেমনই এক বিখ্যাত ফাটলের নাম ‘নজিমা ফল্ট’ যা হকুদান শহরের এই স্মারক স্থলেই রয়েছে । একটি ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িও রয়েছে যার মালিক কখনো কখনো দর্শনার্থীদের সেদিনের ভয়াবহ স্মৃতির রোমন্থন করে থাকেন । ভাগ্যক্রমে সেদিন সেই ৮৭ বছরের যুবকের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে যায় ! ঘরের ভেতরে এখনো ধ্বংসের চিত্র স্পষ্ট । রান্না ঘরে রান্নার বাসনপত্র অবিন্যস্ত ভাবে পড়ে রয়েছে, চেয়ার টেবিলও উলটে আছে । সেদিনের সেই ভূমিকম্পকে ‘গ্রেট হানশিন-আওয়াজি আর্থকুয়েক ডিসেস্টার’ বলা হয়ে থাকে । ১৭ জানুয়ারির অভিশপ্ত দিনে কোবে অঞ্চল ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল, রিক্টার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৬.৯ । বিস্তর সম্পত্তির লোকসানের পাশাপাশি ৩৯ জন মানুষ সেদিন মারা যায়, আর আহত হয়েছিল অগুনতি মানুষ । প্রতি বছর ১৭ জানুয়ারি জাপানের এই শহরের প্রবীণ নাগরিকদের বিভীষিকা তাড়া করে বেড়ায় । আসলে ভূমিকম্পের সঙ্গে জাপানের তিক্ত সম্পর্কের ইতিহাস অনেক পুরনো । সারা বছরই ভূমিকম্পের সঙ্গে জাপানের খিটিমিটি লেগেই থাকে । আবার কখনো বা ভূমিকম্পের বেয়াদপি এমন পর্যায়ে চলে যায় যে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিশাল ধ্বংসের কারিগর হয়ে যায় সে । সড়ক, রেলপথ, উঁচু উঁচু ইমারতকে ধূলিসাৎ করে মানব সভ্যতাকে যেন সে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় । আর জাপানের মানুষ সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে আবার নুতন করে নিজেদের গড়ে তোলে । কারণ এই প্রাকৃতিক দুর্যোগই জাপানকে শিখিয়েছে প্রকৃতির কোলে বেঁচে থাকার জন্য কিভাবে লড়াই করতে হয় ।
জল কিনতে গিয়ে আঁতকে উঠলাম ! এক লিটার মিনারেল ওয়াটার বোতলের দাম ২০০ জাপানি ইয়েন, ভারতীয় টাকায় মূল্য প্রায় ১৪০ টাকা ! হোটেলে কোন পানীয় জলের ফিল্টার বা একোয়া গার্ড খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলনা, রিসেপশনে প্রশ্ন করে জানলাম যে এসবের কোন ব্যবস্থা এখানে নেই । এই মূল্যে যদি জল কিনে খেতে হয় তাহলে আমাদের মত শিক্ষকদের পকেটের অবস্থা যে কি হবে ভাবতেই অসহায় লাগছিল । হঠাৎ করে এই বিপদের সম্মুখীন হয়ে শিবাই এর শরণাপন্ন হলাম । তিনিও সহজে সমস্যার সমাধান করে দিলেন । অভয় দিয়ে জানালেন যে হোটেলের বাথরুমের জল আমরা নির্দ্বিধায় পান করতে পারি । কারণ জাপানের যেকোনো জায়গায় জলের গুণমান নিয়ে কোন সন্দেহ নেই । এও জানা গেল যে জাপানের লোকেরা খাবার জিনিষের গুণমানের উপর কোন সমঝোতা করে না তা যেকোনো খাবারই হোক না কেন । শপিং মলে গিয়েও উন্নত মানের খাবারের সন্ধান পেয়েছি । কিন্তু দাম আমাদের ভারতের তুলনায় বেশীই । ওদের টাকার ভ্যালু যে বেশী তা হাড়ে হাড়ে বোঝতে পারছি । এবার আসি জাপানের খাবার প্রসঙ্গে । খাবারের ডিশে সেদ্ধ শাক-সবজী আর সেদ্ধ মাছ-মাংসের উপস্থিতিই বেশী । নানা রকমের সুপও অবশ্যই ছিল । কিন্তু অবিশ্বাস্য ভাবে লবণের মাত্রা সব খাবারেই খুব কম । আমাদের রসনা প্রথম ক’দিন ওদের খাবারের স্বাদ নিতে রাজীই ছিলনা । এই অবস্থায় খাবারের মেনুতে সাদা চালের ভাত দেখে আমরা উল্লসিত । কিন্তু মুখে দিয়ে উৎসাহ হারালাম । এ যেন অনেকটা আমাদের বিন্নী চালের ভাত বা ‘বিরইন’ ভাতের মত আঠালো । তেমন কোন সবজী বা মাছের ঝোলও চোখে পড়লোনা যে ভাতের সঙ্গে মেখে খাব । কিন্তু জাপানীরা সামান্য কিছু সবজি দিয়ে ঐ ভাত ‘চপ স্টিক’ (সত্যি দর্শনীয়) দিয়ে দারুণ তৃপ্তিতে খাচ্ছিল । এই ‘চপ স্টিক’ দিয়ে খেতে গিয়ে আমাদের যে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় সে আর এক গল্প । তবে ছুড়ি আর কাঁটাচামচ এই যাত্রায় আমাদের কিছুটা হলেও রক্ষা করেছে । হোটেলের রেস্টুরেন্টে নানা খাবার সাজানো থাকতো । প্লেট নিয়ে প্রথম কয়েকদিন খুব উৎসাহের সঙ্গে নিত্যনুতন মেনুর দিকে এগিয়ে গিয়েছি । মনে পড়ছিল কোন এক বিজ্ঞানীর বলা একটি কথা –“নতুন ডিশ আবিষ্কার, নতুন নক্ষত্র আবিষ্কারের থেকেও আনন্দদায়ক” । কিন্তু সেই আনন্দ ম্লান হয়ে যেত যখন কিছু নুতন মেনু আমাদের দিকে ‘গুগলি’ ছুঁড়ে মারতো । ‘ক্লিন বোল্ড’ হয়ে অবশেষে ফলের স্যালাড রাখা টেবিলে চলে যেতাম । সেদিনের মত আবিষ্কারের আনন্দে সেখানেই ইতি ঘটতো । পরদিন আবার নুতন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়া নতুন খাবারের খোঁজে । এভাবেই একদিন অক্টোপাসের মাংসের স্বাদ নিলাম । ভালই খেতে । বাঙালি হবার সুবাদেই মাছের টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতাম । সামুদ্রিক মাছের মধ্যে ‘ম্যাকারেল’, ‘স্যামন’ মাছের স্বাদ কিছুটা হলেও ইলিশ মাছের কথা মনে করিয়ে দিত । সেদ্ধ মাছের টুকরো গুলোকে গরম তাওয়ার মধ্যে সামান্য তেলে ফ্রাই করে রাখা থাকতো, আর সেই মাছগুলো নিয়ে ভাতের সঙ্গে মিলিয়ে খাবার চেষ্টা করতাম । জাপানের খাবারে লবণের পরিমাণ কম থাকার কারণ তার চারিপাশের সমুদ্র । আসলে শাক সবজী থেকেই জাপানিরা তাদের খাবারের নির্দিষ্ট লবণ পেয়ে যায়, তাই আলাদাভাবে সেটার দরকার হয় না । কিন্তু আমাদের রসনা তো সেই সত্যটা বুঝেনা । তাই লবণের সন্ধানে রেস্টুরেন্টে আমাদের চোখ এদিক ওদিক ঘুরতে থাকতো । তবে এ ব্যাপারে ভাগ্য আমাদের খুবই অপ্রসন্ন । লবণহীন খাবারই আমাদের কপালে জুটেছে বেশী । লবণকে যে এত ভালবাসি কই আগে তো এটা জানতাম না !
এক অক্টোবর-সকাল ন’টা । সেমিনার পর্ব গতকালই শেষ হয়ে গেছে । এখন তিনদিন ধরে জাপানের ঐতিহাসিক অঞ্চলে চলবে ভ্রমণ । জাপানের সেমিনার কমিটির পক্ষ থেকেই এই ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছে । যাত্রা শুরু হবে তাকোয়ামা নগর দিয়ে । এই নগর কাঠের নানা রকম তৈজস পত্র তৈরীর জন্য বিখ্যাত । যাওয়ার পথে পড়বে বিখ্যাত ঐতিহাসিক দূর্গ - নাম ‘হিকোন ক্যাসল’ । গত ছ’দিন মিনামি আওয়াজি হোটেলের কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে নিচুস্তরের কর্মচারি পর্যন্ত সবার কাছ থেকেই শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পেয়েছি । হোটেল ছাড়ার সময়ও এর ব্যতিক্রম হলনা । ম্যানেজার,সেফ থেকে বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মচারিরা চিরাচরিত জাপানি প্রথা অনুযায়ি মাথা হেট করে বিদায় জানাচলেন (যাকে জাপানিতে বলা হয় ‘বো’) । গাড়ি ছাড়ার পরও যতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল সবাই দাড়িয়ে আমাদের দিকে হাত নাড়ছিল । সত্যি, এমন অতিথি বৎসল দেশ সম্বন্ধে আর কি বলবো ! এখানে আসার পর থেকে ভাষা নিয়ে একটা সমস্যা ছিল । জাপানের খুব কম মানুষই ইংরেজি বুঝতে পারেন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ভাষা আমাদের কাছে আবেগ বিনিময়ের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাড়ায়নি । ইশারায় উভয় পক্ষই জেনে গেছি নিজেদের বক্তব্যের বিষয় বা প্রয়োজনীয়তার কথা । রাস্তায় হোক কিংবা ট্রেনেই হোক যখনই প্রয়োজন পড়েছে সাহায্যের জন্য সবাই প্রস্তুত । বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও সেই অর্থে ইংরেজিতে দক্ষ নয় । ওদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম জাপানে সবকাজই জাপানী ভাষাতেই হয় । পি এচ ডি থিসিসও এর ব্যতিক্রম নয় । নিজ ভাষার প্রতি এতটাই তাদের সম্মান ও ভালবাসা । বিশেষ কোন প্রয়োজন না পড়লে অন্য ভাষা শিখতে তার আগ্রহী হয়ে ওঠেনা । ইউরোপীয় ভাষাচর্চা না করার দরুণ সভ্যতার অগ্রগতির পথযাত্রায় খুব একটা অসুবিধে হয়েছে, দেখে তা মনে হলনা । আমাদের দেশের ভাষা বৈচিত্র দৈনন্দিন জীবনে কোন জটিলতার সৃষ্টি করে কি না এ নিয়ে তাদের খুব কৌতূহলের ব্যাপার ছিল । হিন্দি এবং ইংরেজি এই দু’টি ভাষা জানলে আমাদের এখানে ভাষাগত কোনো সমস্যা থাকেনা একথা জানতে পেরে তাঁরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো । যাই হোক দুপুর সাড়ে বারোটায় আমাদের বাস হিকোন শহরে এসে পৌঁছালো । হিকোন শিগা পারফেকচার (রাজ্যে)-এর একটি শহর । এই শহরেই অবস্থিত সেই বিখ্যাত ‘হিকোন ক্যাসল’ । লি নাওকাতসু ১৬০৩ সালে এই দুর্গটি তৈরীর নির্দেশ দেন । সুদীর্ঘ ১৯ বছর ধরে তৈরী হয় এই দুর্গ, সেইসঙ্গে এর আশেপাশের অঞ্চলগুলিও সেজে উঠে জাপানি স্থাপত্যকলায় । ১৬২২ সালে এই দুর্গের নির্মান কার্য সম্পন্ন হয় । ভূমিকম্পের দরুণ জাপানের প্রাচীন অট্টালিকা থেকে আধুনিক পাঁচতারা হোটেল সবকিছুই কাঠের তৈরী । হিকোন ক্যাসলও এর ব্যতিক্রম নয় । ছোট্ট পাহাড়ের উপর কাঠের নির্মিত তিনতলার এই দুর্গের স্থাপত্য দেখার জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী সেখানে ভিড় জমান । প্রথমেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় দুর্গের সীমানাতে অবস্থিত মিউজিয়ামে । সেখানে রক্ষিত সে যুগের সৈনিকদের বর্ম দেখে আমার ভিড়মি খাবার অবস্থা । বর্মের বিশালতা দেখেই মনে মনে কল্পনা করতে পারছিলাম সে যুগের সৈনিকদের দশাসই চেহারা । মিউজিয়াম দর্শন শেষে সোজা চলে এলাম দুর্গের পাদদেশে । দুর্গের ভেতরে অবস্থিত সিঁড়ি দিয়ে তিন
তলায় উঠে যাওয়া যায় আর সেখান থেকে হিকোন শহরের ‘প্যানোরামিক ভিউ’এককথায় অপূর্ব । সবথেকে সুন্দর লাগে দূরে শুয়ে থাকা ‘বিওয়া’-হ্রদকে । এই মিষ্টি জলের হ্রদটি দুর্গ থেকে দেখলে সমুদ্র বলে ভ্রম হয় । ৬৭০ বর্গকিলোমিটারের এই হ্রদটিই জাপানের সবথেকে বড় হ্রদ । আর ভৌগলিক ভাবে হ্রদের পাশে ক্যাসেলটির অবস্থানও খুব গুরুত্বপূর্ণ । ঘোড়ার জন্য তৈরী কাঠের আস্তাবল এই দুর্গের এক বিশেষত্ব । সৈনিকেরা ঘোড়ার সাহায্যে দূর দূরান্তরে এখান থেকেই ছড়িয়ে পড়তেন । প্রায় চারশো বছর পুরানো এই দুর্গের স্থাপত্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম বললেও কম বলা
হয়। অবশেষে নেমে এলাম দুর্গের নিচে যেখানে দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য জাপানের প্রিয় ম্যাসকট ‘সামুরাই ক্যাট’ নৃত্য প্রদর্শন করে । এই ম্যাসকট জাপানে খুব প্রসিদ্ধ । চাবির রিং থেকে শুরু করে নানা রকম পুতুল কিংবা খেলনা সবকিছুতেই এই ম্যাসকটের রমরমা । ক্যাসেল থেকে বেরিয়ে আসার পথে চোখে পড়লো চেরি ব্লসমের বাগান । বসন্ত ঋতুতে এই বাগানের প্রায় এক হাজার চেরি গাছ লাল চেরির রঙ্গিন চোলিতে সেজে উঠে । সে এক দেখার মত দৃশ্য । সময় কম থাকায় সমগ্র অঞ্চল আর আমাদের ঘুরে দেখা হলনা । দুপুর আড়াইটেয় আবার বেরিয়ে পড়া । বিকেল পাঁচটায় আমাদের বাস এসে থামে তাকোয়ামা মাতসুরি মিউজিয়ামে । এই মিউজিয়ামে এসেই জানতে পারলাম আগামী ৯ ও ১০ অক্টোবর তাকোয়ামা শহরে জাপানিদের চিরাচরিত উৎসব উদযাপন হতে যাচ্ছে । এই উৎসবে ঐতিহ্যময় বিশাল বিশাল কাঠের রথ শহর পরিক্রমা করে । রঙ বেরঙের কাগজ আর কাপড়ে এই রথ গুলো হয়ে উঠে সুসজ্জিত । সেই ১৬৯২ সাল থেকে এই উৎসবের সূচনা, যার পরম্পরা আজও চলছে । এই তাকোয়ামা মিউজিয়ামেই সেই সব রথ সাজিয়ে রাখা আছে । কাঠের সুসজ্জিত রথে রয়েছেন নানা দেবতা । আশেপাশে রয়েছে বিশাল বিশাল ঢাক আর ড্রামের সম্ভার । তিনতলা উঁচু এই মিউজিয়ামে জাপানের চিরাচরিত লোকসংস্কৃতির পরিচয় পেয়ে আমরা বিস্ময়ে নির্বাক । কিছুক্ষণ সেখানে থাকার পর মিউজিয়াম সংলগ্ন রেস্টুরেন্টে আমাদের রাতের ডিনার পর্ব সেরে নিলাম । তারপর তাকোয়ামা শহরেরই এক অভিজাত হোটেল ‘তাকায়ামাউসান’-এ আজকের মত আমাদের যাত্রার সমাপ্তি । তখন রাত আটটা বেজে গেছে । এই হোটেলে এসে আমাদের জন্য আর এক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল । কারণ আর কিছুই নয় এখানে হোটেলের প্রবেশ পথেই জুতো খুলে গ্রাউন্ড ফ্লোরের লকারে জমা দিয়ে দিতে হয় তারপর খালি পায়ে হোটেলে চেক ইন করতে হয় । কারণ এখানের ফ্লোরের টাইলসগুলো বিশেষ জাপানি প্রথায় তৈরি । জুতোর ঘর্ষণে টাইলসগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা থাকে বলেই হোটেলের বিশেষ রবারের সোলের জুতো পড়াটা এখানে বাধ্যতামূলক । দেখা গেল আমাদের মালপত্রও হোটেলে চলে এসেছে আর হোটেলের এক কর্মচারী ব্যাগগুলো পরিষ্কারে ব্যস্ত । পরিষ্কার পরিচ্ছন্নের দিকে হোটেল কর্তৃপক্ষের বিশেষ নজর ছিল । শহরের তাপমাত্রা তখন ছিল প্রায় ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস । খুব শীত লাগছিল, তবে সঙ্গে জ্যাকেট থাকায় তেমন অসুবিধে হয়নি । হোটেলে গরম জলের বিশেষ ‘পাবলিক হট স্প্রিং’ আছে । গরম জলের গণ সুইমিং পুলে স্নান করাটা জাপানের এক রেওয়াজ বলা যায় । বৃদ্ধ, যুবক সবাই মিলে আড্ডা দিয়ে স্নান করা এখানে খুব জনপ্রিয় । তবে ক্লান্ত থাকায় আমাদের এই অভিজ্ঞতার স্বাদ নেওয়া হলনা, হোটেলের বাথরুমেই ফ্রেশ হয়ে নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম ।
তলায় উঠে যাওয়া যায় আর সেখান থেকে হিকোন শহরের ‘প্যানোরামিক ভিউ’এককথায় অপূর্ব । সবথেকে সুন্দর লাগে দূরে শুয়ে থাকা ‘বিওয়া’-হ্রদকে । এই মিষ্টি জলের হ্রদটি দুর্গ থেকে দেখলে সমুদ্র বলে ভ্রম হয় । ৬৭০ বর্গকিলোমিটারের এই হ্রদটিই জাপানের সবথেকে বড় হ্রদ । আর ভৌগলিক ভাবে হ্রদের পাশে ক্যাসেলটির অবস্থানও খুব গুরুত্বপূর্ণ । ঘোড়ার জন্য তৈরী কাঠের আস্তাবল এই দুর্গের এক বিশেষত্ব । সৈনিকেরা ঘোড়ার সাহায্যে দূর দূরান্তরে এখান থেকেই ছড়িয়ে পড়তেন । প্রায় চারশো বছর পুরানো এই দুর্গের স্থাপত্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম বললেও কম বলা
হয়। অবশেষে নেমে এলাম দুর্গের নিচে যেখানে দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য জাপানের প্রিয় ম্যাসকট ‘সামুরাই ক্যাট’ নৃত্য প্রদর্শন করে । এই ম্যাসকট জাপানে খুব প্রসিদ্ধ । চাবির রিং থেকে শুরু করে নানা রকম পুতুল কিংবা খেলনা সবকিছুতেই এই ম্যাসকটের রমরমা । ক্যাসেল থেকে বেরিয়ে আসার পথে চোখে পড়লো চেরি ব্লসমের বাগান । বসন্ত ঋতুতে এই বাগানের প্রায় এক হাজার চেরি গাছ লাল চেরির রঙ্গিন চোলিতে সেজে উঠে । সে এক দেখার মত দৃশ্য । সময় কম থাকায় সমগ্র অঞ্চল আর আমাদের ঘুরে দেখা হলনা । দুপুর আড়াইটেয় আবার বেরিয়ে পড়া । বিকেল পাঁচটায় আমাদের বাস এসে থামে তাকোয়ামা মাতসুরি মিউজিয়ামে । এই মিউজিয়ামে এসেই জানতে পারলাম আগামী ৯ ও ১০ অক্টোবর তাকোয়ামা শহরে জাপানিদের চিরাচরিত উৎসব উদযাপন হতে যাচ্ছে । এই উৎসবে ঐতিহ্যময় বিশাল বিশাল কাঠের রথ শহর পরিক্রমা করে । রঙ বেরঙের কাগজ আর কাপড়ে এই রথ গুলো হয়ে উঠে সুসজ্জিত । সেই ১৬৯২ সাল থেকে এই উৎসবের সূচনা, যার পরম্পরা আজও চলছে । এই তাকোয়ামা মিউজিয়ামেই সেই সব রথ সাজিয়ে রাখা আছে । কাঠের সুসজ্জিত রথে রয়েছেন নানা দেবতা । আশেপাশে রয়েছে বিশাল বিশাল ঢাক আর ড্রামের সম্ভার । তিনতলা উঁচু এই মিউজিয়ামে জাপানের চিরাচরিত লোকসংস্কৃতির পরিচয় পেয়ে আমরা বিস্ময়ে নির্বাক । কিছুক্ষণ সেখানে থাকার পর মিউজিয়াম সংলগ্ন রেস্টুরেন্টে আমাদের রাতের ডিনার পর্ব সেরে নিলাম । তারপর তাকোয়ামা শহরেরই এক অভিজাত হোটেল ‘তাকায়ামাউসান’-এ আজকের মত আমাদের যাত্রার সমাপ্তি । তখন রাত আটটা বেজে গেছে । এই হোটেলে এসে আমাদের জন্য আর এক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল । কারণ আর কিছুই নয় এখানে হোটেলের প্রবেশ পথেই জুতো খুলে গ্রাউন্ড ফ্লোরের লকারে জমা দিয়ে দিতে হয় তারপর খালি পায়ে হোটেলে চেক ইন করতে হয় । কারণ এখানের ফ্লোরের টাইলসগুলো বিশেষ জাপানি প্রথায় তৈরি । জুতোর ঘর্ষণে টাইলসগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা থাকে বলেই হোটেলের বিশেষ রবারের সোলের জুতো পড়াটা এখানে বাধ্যতামূলক । দেখা গেল আমাদের মালপত্রও হোটেলে চলে এসেছে আর হোটেলের এক কর্মচারী ব্যাগগুলো পরিষ্কারে ব্যস্ত । পরিষ্কার পরিচ্ছন্নের দিকে হোটেল কর্তৃপক্ষের বিশেষ নজর ছিল । শহরের তাপমাত্রা তখন ছিল প্রায় ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস । খুব শীত লাগছিল, তবে সঙ্গে জ্যাকেট থাকায় তেমন অসুবিধে হয়নি । হোটেলে গরম জলের বিশেষ ‘পাবলিক হট স্প্রিং’ আছে । গরম জলের গণ সুইমিং পুলে স্নান করাটা জাপানের এক রেওয়াজ বলা যায় । বৃদ্ধ, যুবক সবাই মিলে আড্ডা দিয়ে স্নান করা এখানে খুব জনপ্রিয় । তবে ক্লান্ত থাকায় আমাদের এই অভিজ্ঞতার স্বাদ নেওয়া হলনা, হোটেলের বাথরুমেই ফ্রেশ হয়ে নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম ।
দোসরা অক্টোবর, সকাল সাড়ে আটটা । সকালে জাপানের খাঁটি চা পান করার পর বেশ ফ্রেশ লাগছে । জাপানে চা খুব জনপ্রিয় । ব্রেকফাস্ট টেবিলে ‘মেড ইন জাপান’ খাবারের পাশে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ এক আইটেম দেখে খুব ভাল লাগলো । ‘লিপটন দার্জিলিং’ চা । ভারতের চা-এর প্রতি জাপানিদের দুর্বলতা নানা সময় প্রকাশ পেয়েছে । যখনই জাপানের কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করতো যে ভারতের কোন অঞ্চল থেকে এসেছি, তখন আমার উত্তর পাবার পর ওরা জেনে নিতো যে সেই চা-এর দেশ থেকে আসছি কি না ! আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের আগে ‘আসাম’ থাকায় এর ব্রান্ড ভ্যালুও তাহলে জাপানে পরিচিত । ভারতবর্ষের উত্তর পূর্বাঞ্চলের এই অবহেলিত রাজ্যটি দূর বিদেশের বিদেশীদের কাছে এত পরিচিত তা কে জানতো ! কিন্তু এই চায়ের গুনে অপরিচিতের অভিগাথা থাকলোনা । এই প্রথম আসামের এই চা-এর জন্য মনে মনে এক গর্বই হলো ।
আজ আমাদের গন্থব্যস্থল ‘শিরাকাওয়া-গো’ নামক একটি গ্রাম যা গিফু আর তোয়ামা পার্ফেকচারের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত । এই গ্রামকে ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করে যা সাংস্কৃতিক হেরিটেজ সাইটের ক্যাটাগরি ভুক্ত। খুব খুশি হলাম কমিটির পক্ষ থেকে এমন একটি জায়গা নির্বাচিত করার জন্য । জাপানে ইউনেস্কোর ঘোষণা করা আরো পনেরোটি হেরিটেজ সাইট রয়েছে । কিন্তু ভারতে রয়েছে ২৮ টি । এর মধ্যে আমাদের আসামের কাজিরাঙ্গা আর মানস অভয়ারণ্য হেরিটেজ সাইট হিসেবে নথিভুক্ত । এছাড়াও উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আগ্রার তাজমহল, দিল্লির কুতুবমিনার, মহারাষ্ট্রের অজন্তা-ইলোরা গুহা ইত্যাদি । শিরাকাওয়া-গো গ্রামটি আমাদের হোটেল থেকে মাত্র এক ঘণ্টার রাস্তা । সকাল দশটায় এসে সেখানে আমরা উপস্থিত হলাম । সমুদ্র থেকে প্রায় পাঁচশত মিটার উঁচুতে অবস্থিত পাহাড় ঘেরা এই গ্রামটির পাদদেশে বয়ে চলেছে শোগাওয়া নদী । এই গ্রাম উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১.৫ কিলোমিটার, আর পূর্ব-পশিমে ৩৫০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত । এই গ্রামের কাঠ আর খড় দিয়ে বানানো বাড়িগুলো দৃষ্টি আকর্ষণ করে । এই বাড়িগুলো দেখতে ইংরেজি বর্ণমালার ‘A’ অক্ষরের মত । এই বাড়িগুলোর ছাদে খড় এত পুরু করে দেওয়া হয়ে থাকে যে শীতকালে তুষারপাতের সময় বরফ ঘরের ভেতরে ঢুকতে পারেনা । বেশীর ভাগ বাড়িই তিনতলা থেকে চারতলা । ঘরের চাল প্রায় ষাট ডিগ্রী পর্যন্ত হেলানো থাকে, যার ফলে ছাদে বরফ জমতে পারেনা । বাড়িগুলোকে দূর থেকে দেখে অনেকটা আমাদের গ্রাম বরাকের কুড়ে ঘরের মত লাগছিল । একশো চৌদ্দটি ‘A’ টাইপের ঘরে প্রায় ছয়শোজন লোক ওই গ্রামে থাকেন । তাদের জীবনশৈলী দেখে মুগ্ধ হতে হয় বৈ কি ! গ্রামে রয়েছে ছোট ছোট অনেক দোকান, যেখানে রয়েছে কাঠের তৈরি নানা সামগ্রী । সারাটা দুপুর আমরা এই মনোরম গ্রামেই কাটিয়ে দিলাম ।
বিজ্ঞানের জগতের প্রায় সবাই জানেন যে জাপানে বিজ্ঞানের এক বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে । খুব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যন্ত্র তৈরিতে জাপানিদের তুলনা নেই । বিজ্ঞানমনস্ক ভারতীয় অতিথিদের জাপানের বিজ্ঞানের স্বাদই যদি না দেওয়া যায় তবে আর কী হল ! শিবাই তাই আমাদের জন্য এক অভিনব দর্শনের ব্যবস্থা করলেন । তার মুখে ‘কেমিওকা অবজারভেটরিতে আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে শুনে তখন আমরা সবাই উল্লসিত । টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে চলা এই অবজারভেটরিতে খুব কম মানুষকেই যাবার অনুমতিপত্র দেওয়া হয় । সে হিসেবে আমরা ভাগ্যবানই বলতে হয় । তেসরা অক্টোবরের সকালে আমরা বেরিয়ে পড়লাম কেমিওকার উদ্দেশ্যে । পাহাড় ঘেরা পথে যেতে যেতে পাইন গাছের বিস্তীর্ণ জঙ্গল দেখে শিলং-এর কথা মনে পড়ছিল খুব । আসলে জাপানের পাহাড় গুলোতে পাইন গাছের আধিক্য অন্যান্য গাছের তুলনায় অনেক বেশী । আমাদের বাস যখন কেমিওকাতে এসে পৌছায় তখন তাপমাত্রা ছিল তেরো ডিগ্রি সেলসিয়াস । কনকনে বাতাস আর শান্ত নীরব পাহাড় ঘেরা অঞ্চল দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম । অবজারভেটরির অবস্থান মোজুমি মাইনের প্রায় এক কিলোমিটার গভীরে । টানেলের ভেতর দিয়ে আমাদের যেতে যেতে মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমরা পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রবেশ পড়ছি । ভেতরে রয়েছে দু’টি প্রধান ল্যাবরেটরি । একটিতে ‘নিউট্রিনো’ কণা ডিটেকশনের যন্ত্রপাতি রয়েছে । ১৯৯৮ সালে যখন প্রথম সৌর নিউট্রিনোর পরীক্ষামুলক উপস্থিতি এই ল্যাবরেটরিতে প্রমাণিত হয় তখন সারা পৃথিবীতে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল । আসলে বেয়াদপ নিউট্রিনো কণাকে ল্যাবরেটরিতে এর আগে কিছুতেই শনাক্ত করা যাচ্ছিলনা । এই নিউট্রিনো অবজারভেটরিকে ‘সুপার কেমিওকন্ডা’ বলা হয়ে থাকে । এর ঠিক পাশেই রয়েছে ‘গ্র্যাভিটি ওয়েব’ বা মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ ডিটেকশনের ওপর ল্যাবরেটরি । এই তরঙ্গের তীব্রতা খুব কম হবার জন্য আজ পর্যন্ত একে শনাক্ত করা যায়নি । তবে আগামী পাঁচ ছয় বছরের মধ্যে এই সফলতাও আসবে বলে আশাবাদী সেখানকার জাপানি বিজ্ঞানীরা । কেমিওকা সম্বন্ধে বলতে গেলে আরো অনেক কথা বলতে হয় সেই প্রসঙ্গে আর যাচ্ছিনা ।
জাপানে গিয়ে ট্রেন না চড়লে যাত্রাই অসমাপ্ত থেকে যায় । যদিও বুলেট ট্রেনে চাপা হয় নি, কিন্তু ‘থান্ডার বার্ড এক্সপ্রেস’ চড়ার সৌভাগ্য হল । তোয়ামা ষ্টেশন থেকে আমরা ওসাকা ষ্টেশনে যাই । তারপর সেখান থেকে লোকাল ট্রেনে রিংকু ষ্টেশনে যেতে হবে যা কাঁশাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের খুব কাছেই । ওসাকা ষ্টেশন থেকেই শিবাই বিদায় নিলেন । তাঁর দায়িত্ব শেষ । বিদায় বেলায় মনটা ভারি হয়ে গেল । স্বল্প পরিচয়েই এই ব্যক্তির সঙ্গে হৃদয়ের এক বন্ধন স্থাপিত হয় যা থেকে যাবে আজীবন ।
আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে ‘কাঁশাই এয়ারপোর্ট ওয়াশিংটন হোটেলে’ । পাঁচ তারিখেই আমাদের ফেরার টিকিট । চার অক্টোবর সারাদিন ফাঁকা থাকার কারণে আমরা সবাই মিলে ঠিক করলাম যে সকালে ‘কায়ুকান একোরিয়াম’ দেখতে বেরিয়ে যাব যা ওসাকা বন্দরের খুব কাছেই । এই একুরিয়াম পৃথিবীর বৃহত্তম একোরিয়ামের মধ্যে একটি । ভেতরে রয়েছে নানা সামুদ্রিক মাছ যে গুলির মধ্যে হাঙর, তিমি, সিল, জেলি ফিস ইত্যাদি উল্লেখ যোগ্য । পেঙ্গুইনের জন্য রয়েছে আলাদা একটি স্থান যেখানে কৃত্রিমভাবে বরফ বৃষ্টি হচ্ছে । এই বিশাল একুরিয়ামে কেমন করে সারাটা দিন কেটে গেল বউঝতেই পারলাম না ।
পাঁচ অক্টোবর । অবশেষে চলে আসলো যাবার দিন । দুপুর দু’টো দশে আমাদের ফ্লাইট । এ’কদিনে যে এত দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ হবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি । বিদায় বেলায় প্রোফেসর শিবাইর একটা কথাই মনে পড়ছে – “জাপানকে যারা ভালবাসে, জাপান আবার তাদের ডেকে নিয়ে আসে” ।
আবারও জাপান যাবার সুপ্ত বাসনা মনে রেখে উড়ে চললাম ভারতের দিকে ।
Excellent story... keep it up...
ReplyDeleteদারুণ লিখেছো ভ্রমণ কাহিনি! এটো বিচ্ছিন্ন থাকো কেন? একটু ছড়াও। বাংলা ভাষাতে যে বিজ্ঞানও লিখতে হবে তা জানাও, বোঝাও। ফেসবুকে এসো। আজকাল ঈশানের পুঞ্জমেঘ নামে একটা ব্লগ করেছি পূর্বোত্তরভারতের সমস্ত বাংলা ব্লগারদের এক মঞ্চে নিয়ে আসতে। ওখানেও এসো।
ReplyDelete