Wednesday, November 24, 2010

মহাযন্ত্রের আঁতুরঘরে অবশেষে জন্ম হল ‘অ্যান্টিম্যাটার’-এর


১৭ নভেম্বর ২০১০ । ‘নেচার’ সাময়িকীতে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হবার পর বিজ্ঞানের জগতে সেটি এক ‘মহাবিস্ফোরণ’ ঘটালো ! বিশ্বের সর্ববৃহৎ যন্ত্রের আঁতুরঘরে অবশেষে জন্ম হল ‘অ্যান্টিম্যাটার’ এর যা শুধু এতদিন তাত্বিক জগতে সীমাবদ্ধ ছিল । ডঃ জি বি অ্যান্ড্রিসেন আর তার সহযোগী ৪১ জন বিজ্ঞানীদের তপস্যায় মুগ্ধ হয়ে ‘অ্যান্টিহাইড্রোজেন’ স্বল্প সময়ের জন্য আবির্ভূত হলেন বিজ্ঞানীদের সম্মুখে ।
‘এল এইচ সি’ (লার্জ হ্যাডরন কলাইডার) নামটি অনেকআগেই বিজ্ঞানীদের গন্ডি অতিক্রম করে সাধারণ মানুষের অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছে । ‘দ্য ইউরোপিয়ান অর্গেনাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ’ (সার্ন) এর বদান্যতায় তৈরী এটিই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ যন্ত্র ! ফ্রান্স এবং স্যুইজারল্যান্ডের সীমানার ২৭ কিলোমিটার পরিধির বৃত্তাকার এক টানেলের মধ্যেই তার আবাস । সারা বিশ্বের প্রায় দশহাজার বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়ারদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই যন্ত্রটির অবস্থান মাটির তলায় ১৭৫ মিটার নিচে যা বানাতে খরচ হয়েছে প্রায় ৯০ কোটি ডলার ! মহাবিশ্বের জন্মরহস্য অনুসন্ধান, ‘ভগবান কণা’ (বা ‘হিগস কনা’) এর পরীক্ষামূলক অস্তিত্বের সন্ধান, ‘ডার্ক ম্যাটার’ আর ‘ডার্ক এনার্জি’ এর রহস্য উন্মোচনের পাশাপাশি ‘গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন থিওরি’ তৈরীর লক্ষেই ‘এল এইচ সি’ –এর জন্ম ।
          জন্মের মুহূর্ত থেকেই ‘এল এইচ সি’ বিতর্কের ঘেরাটোপে । খবরের শিরোনাম দখল করার এক অদৃশ্য তাগিদ যেন তার জন্ম কুন্ডলিতে লিখে রেখেছেন বিজ্ঞানীরা ! ১০ সেপ্টেম্বর, ২০০৮ এ তার আবির্ভাবেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ‘বিগব্যাং’ বা ‘মহাবিস্ফোরণ’-এর আতঙ্ক ছড়িয়ে যায় । এক মহল থেকে প্রচার করা হয়েছিল ‘এল এইচ সি’ তে যে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরিক্ষা করা হচ্ছে তার ফলে নাকি আমাদের গ্রহ চিরতরে নির্মূল হয়ে যেতে পারে । কিন্তু সেই অপপ্রচারে বিজ্ঞানের তেমন ক্ষতি হলনা । ‘এল এইচ সি’ এর বিজয় রথ এগিয়ে যেতেই লাগলো । ৩০শে মার্চ, ২০১০ সালে আবারও সে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসলো । প্রায় আলোর গতিতে ধেয়ে আসা দু’টি প্রোটনের সংঘর্ষে সর্বপ্রথম ৭ টেরা ইলেক্ট্রনভল্টের শক্তি সৃষ্টি হল মানবসৃষ্ট ল্যাবরেটরিতে । গবেষণার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এ ছিল এক অনন্য অগ্রসরতা । আর সাম্প্রতিক খবর তো অন্য সব খবরকে পিছনে ফেলে দিয়েছে ।
আমাদের এই বস্তু জগৎ সৃষ্টির নেপথ্যে রয়েছে নানাবিধ কণার সংমিশ্রণ । যেমন – ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন । এ ছাড়াও রয়েছে আরো অনেক কণা । একটি মানুষ সৃষ্টির নেপথ্যেও রয়েছে লক্ষকোটি কণার সমন্বয় । এই কণাদের জগৎটাও বড় বিচিত্র আর রহস্যময় ! এর কুহেলিভরা চরিত্র মোহিত করে রেখেছে গবেষকদের । আসলে এই কণাগুলির চরিত্রের গভীরেই লুকিয়ে রয়েছে মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্যের চাবিকাটি । প্রচলিত থিওরি মতে এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমেই এই মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল যাকে ‘বিগ ব্যাং’ বলা হয়ে থাকে । এই বিস্ফোরণের পর ‘ম্যাটার’ (বা ‘পদার্থ’) আর ‘অ্যান্টিম্যাটার’ (বা ‘বিপরীত পদার্থ’) দু’টিই তৈরী হয়েছিল । কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বর্তমান বিশ্ব ‘ম্যাটার’ দিয়েই তৈরী, আর আশ্চর্যজনকভাবে ‘অ্যান্টিম্যাটার’ অনুপস্থিত । যদি কখনো ‘ম্যাটার’ আর ‘অ্যান্টিম্যাটার’ এর মিলন হয় তখন বিস্ফোরণ হয়ে বিপুল পরিমানের শক্তি সৃষ্টি হয় । মজার ব্যাপার হল অ্যান্টিম্যাটারের অনুপস্থিতির জন্য আমরাও বহাল তবিয়তে রয়েছি এই ব্রহ্মান্ডে । এই অ্যান্টিম্যাটারের অস্তিত্বের কথা ১৯৩১ সালে সর্বপ্রথম পল ডিরাক নামক এক বিজ্ঞানী অনুমান করেছিলেন । সুদীর্ঘ ৬৯ বছর পর অ্যান্টিম্যাটারের পরীক্ষামূলক উপস্থিতি বিজ্ঞানীদের হিসেব নিকেশ অনেক পাকা করলো । বলা যায় মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে এটি এক ধাপ এগনো । ‘এল এইচ সি’ নির্মাণের এক গুরূত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল ল্যাবরেটরিতে অ্যান্টিম্যাটার সৃষ্টি করা । কারণ এর অধ্যয়ন এতদিন তত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল । আর পরীক্ষামূলকভাবে ল্যাবরেটরিতে এর সৃষ্টি করা এতদিন অধুরাই ছিল । কিন্তু বিজ্ঞানের জাদুতে অসম্ভবের সীমা অতিক্রম করে সম্ভবের মাইলস্টোন স্পর্শ ‘এল এইচ সি’ এর দৌলতেই অবশেষে সম্ভব হল । ডঃ জি বি অ্যান্ড্রিসেনের তত্বাবধানে ৪১ জন বিজ্ঞানীদের দল ‘এল এইচ সি’ তে ‘অ্যান্টিহাইড্রোজেন’ সৃষ্টি করলেন যার আয়ুকাল ছিল ১৭০ মিলি সেকেন্ড । ‘হাইড্রোজেন’ মৌলের ঠিক বিপরীত চরিত্রের অধিকারী এই ‘অ্যান্টিহাইড্রোজেন’ । খুব স্বল্প সময়ের জন্য একে সৃষ্টি করা হলেও এর আবির্ভাবে কিন্তু অনেক তত্বের প্রতিষ্ঠা পাকাপোক্ত হল । বিজ্ঞানীদের মতে এই অ্যান্টিম্যাটারের পরীক্ষামূলক অধ্যয়ন করে অনেক গুরূত্বপূর্ণ তথ্য জানাও ভবিষ্যতে সম্ভব হবে । মহাবিশ্বের জন্ম রহস্যের কুহেলিও ধীরে ধীরে আমাদের সামনে পরিস্কার হবে । তবে এর জন্য ‘এল এইচ সি’ এর অশ্বমেধ ঘোড়াকে অনেকদূর এগিয়ে যেতে হবে ।
          “আচ্ছা মশাই, ‘অ্যান্টি ইউনিভার্স’ থেকে আমার ‘বিপরীত সত্তা’ যদি আপনাদের সেই বিশাল যন্ত্রের সাহায্যে এই বিশ্বে চলে আসে তাহলে তো মুশকিল । কোথাও ওর সঙ্গে দেখা হবার পর করমর্দন হয়ে গেলে তো আমার অস্তিত্বই থাকবেনা” – বক্তা আমার বাড়ির মালিক । ‘ম্যাটার’ আর ‘অ্যান্টিম্যাটার’ এর মিলন হলে যে কি হবে সেই গূঢ় তত্ব তাহলে তিনি মিডিয়ার দৌলতে ভালই উপলব্ধি করতে পেরেছেন !