Thursday, September 25, 2014



মঙ্গলময় মঙ্গল অভিযান
'তোমাদের মঙ্গলযান মিশন অবশ্যই সফল হবে। ভারতীয় বিজ্ঞানীদের প্রতি আমার দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে '
          একবছর আগের কথা, আজও যেন কানের পাশে গুনগুন করছে। আমেরিকার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী তথা অধ্যাপক ড. জেসিকা সানশাইনের এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট ভারতীয় বিজ্ঞানীদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার মনোভাব গত বছর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অবস্থানকালে নাসা-এর সেই বিখ্যাত বিজ্ঞানীর সঙ্গে এই মিশন নিয়ে নানা আলোচনা হয়, আর আনন্দিত হই তাঁর ভারত প্রীতি মনোভাব দেখে।
          এখন মঙ্গলযান মিশন নিয়ে আলোচনার আগে কিছু মজার তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
১) এশিয়া থেকে এই প্রথম কোনও দেশ মঙ্গল গ্রহে এমন সাফল্যসূচক মিশন সফল করতে সমর্থ হয়েছে। জাপান ১৯৯৮ সালে আর চীন ২০১১ সালে মঙ্গল মিশনে অসফল হয়। এমন কি প্রথম বারের চেষ্টায় আমেরিকা কিংবা রাশিয়াও মঙ্গল মিশনের অভিযানে সাফল্য পায়নি।
২) মঙ্গল মিশনের বাজেট ছিল মাত্র ৪৫০ কোটি টাকা! যেখানে হলিউডের ব্লকবাস্টার মুভি 'গ্র্যাভিটি' এর বাজেট ছিল এর থেকে বেশী, প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা। এমন কি মাত্র দু'দিন আগেই মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশ করা নাসার মহাকাশ যান 'মাভেন'-এর বাজেট আমাদের মঙ্গলযান থেকে নয় গুন বেশী ছিল।
৩) ইসরো হচ্ছে চতুর্থ মহাকাশ সংস্থা যে কিনা সাফল্যমূলক ভাবে মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে মহাকাশযান প্রেরণ করতে পেরেছে। এর আগে আমেরিকার 'নাসা', রাশিয়ার 'রাশিয়ান ফেডারেল স্পেস এজেন্সি' আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের 'ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি' এই সাফল্য পেয়েছিল।
৪)  মঙ্গলযান তৈরি করতে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের সময় লেগেছে মাত্র ১৫ মাস, সেখানে নাসার 'মাভেন' মহাকাশযান তৈরি করতে সময় লেগেছিল সুদীর্ঘ পাঁচ বছর।
৫) ভারতের জনসংখ্যা ১২০ কোটির নিরিখে হিসেব করলে এর জন্য প্রতি ভারতীয়ের পকেট থেকে ব্যয় হয়েছে মাত্র চার টাকা
৬) পৃথিবী থেকে মঙ্গল পর্যন্ত দূরত্ব ৬৭ কোটি কিলোমিটার অতিক্রম করতে প্রতি কিলোমিটারে মাত্র ৭ টাকা খরচ হয়েছে মঙ্গলযানের যা ভারতের বিভিন্ন শহরের অটোরিকশার ভাড়া থেকেও কম!
৭) এখনও পর্যন্ত মঙ্গল মিশনে বিভিন্ন দেশ একান্ন বার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একুশটি মিশন সফল। গর্বের ব্যাপার আমাদের প্রচেষ্টা প্রথম বারেই সফল।      
          বলতে দ্বিধা নেই যে মঙ্গল মিশন মহাকাশ গবেষণায় বিশ্বের দরবারে আমাদের সাফল্যের সূচক একটু বাড়িয়ে দিল। এই মিশন নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। মঙ্গল গ্রহে মিথেন গ্যাসের সন্ধান করার পাশাপাশি সেখানের বায়ুমণ্ডলে ডিউটেরিয়াম আর হাইড্রোজেন গ্যাসের সন্ধান করবে 'মারস অরবিটার মিশন'এই অধ্যয়ন করতে দু'টি স্প্রেকটোমিটার, একটি ফটোমিটার, একটি মারস কালার ক্যামেরা আর একটি মিথেন সেন্সর ব্যবহৃত হবে। অতীতে এই গ্রহে জল আছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখবে সে। এর থেকেই জানা যাবে মঙ্গল গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের খবর। এছাড়াও মঙ্গল পৃষ্ঠে খনিজ পদার্থের সন্ধান করাও এই মিশনের মূল লক্ষ্য।
          পি এস এল ভি-সি২৫ এর মাধ্যমে গত ৫ নভেম্বর ২০১৩ সালে  'মারস অরবিটার মিশন'-কে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। এই পি এস এল ভি বানাতেও ইসরোর ইঞ্জিনিয়ার এবং বিজ্ঞানীদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। বিশ্বের প্রথম সারির মহাকাশ সংস্থাগুলো এই ব্যাপারে ভারতকে তেমন সাহায্য করেনি। সম্পূর্ণ ভারতীয় প্রযুক্তিতে বানানো হয়েছিল 'পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল'মঙ্গল-যানের সফল উৎক্ষেপণের জন্য এর অবদানও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।  তাই ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সালে মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে এক ইতিহাস রচিত হল পি এস এল ভি-সি২৫ এর সৌজন্যে। মঙ্গল-যানের সঙ্গে পৃথিবীর কন্ট্রোলরুমের যোগাযোগ উন্নতমানের রেডিও সিগনালের সাহায্যেই হচ্ছে।  মঙ্গলযানে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা যা মিশনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।  সব মিলিয়ে এই মিশনে চেষ্টার কসুর রাখেননি ইসরোর বিজ্ঞানীরা।
          মিডিয়ার দৌলতে 'লাল গ্রহ' নিয়ে অনেক খবর পাঠকদের কাছে পৌঁছে গেছে। গবেষণার কারণ ছাড়াও রাজনৈতিক কারণে এই মিশন গুরুত্বপূর্ণ। আসলে আমাদের ইসরো ভবিষ্যতের মহাকাশ মিশনের রূপরেখা তৈরি করে রেখেছে। সেই দিন আর খুব দূরে নেই যখন মানুষ চন্দ্রে কিংবা মঙ্গল গ্রহে উপনিবেশ স্থাপন করবে। আমেরিকা কিংবা রাশিয়ার একচ্ছত্র অধিকারকে চ্যালেঞ্জ জনাতেই এই মিশন খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভবিষ্যতে অন্য গ্রহে মানব রহিত মহাকাশযান প্রেরণ করতেও এই মিশন সাহায্য করবে। সেই দিন আর দূরে নেই যখন মহাকাশ যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা আরও মুখ্য হয়ে উঠবে।
          চলে আসি জেসিকার প্রসঙ্গে। মহাকাশ নিয়ে গবেষণার কাজে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসে আমেরিকার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানেই জেসিকার সঙ্গে আলাপ। নাসার নানা মিশনের সঙ্গে মেয়েটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেখানেই মঙ্গলযান মিশন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। প্রতিদিন লাঞ্চের সময় নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হত। ওকে তিনমাস সহকর্মী হিসেবে পেয়ে  ভালই হয়েছিল। আমেরিকার বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে নানা চমকপ্রদ তথ্য ওর কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম। দিনটি আজও মনে আছে, ৫ নভেম্বর ২০১৩। জেসিকা এসে করমর্দন করে গেল, আর পাশাপাশি অভিনন্দন। সেদিন শ্রীহরিকোটা থেকে মঙ্গলযান সফলতার সঙ্গে ছুটে যায় মঙ্গলের দিকে। ভারতের বিজ্ঞানীদের প্রতি ওর অগাধ শ্রদ্ধা দেখে খুব ভাল লাগলো। এখন বিদেশে নানা কনফারেন্সে গেলে নানা দেশের বিজ্ঞানীরা আমদের কাছে ছুটে আসেন ভারতের মহাকাশ মিশনের ভবিষ্যৎ জানতে। ইসরোর এই প্রয়াসের প্রশংসা জানাবার ভাষা আজ নেই। জেসিকাকে এই প্রবন্ধ লেখা শুরু করার আগেই ই-মেল করেছিলাম। এই মাত্র উত্তর আসলো। 'অভিনন্দন ভারতীয় বন্ধু। তোমাদের দেশের আপামর জনসাধারণকে জানাই আমার তরফ থেকে শুভেচ্ছা। এক পদক্ষেপ আরও এগিয়ে গেলে...।'   


- 'দৈনিক যুগশঙ্খ' পত্রিকায় প্রকাশিত (২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪)

Saturday, June 28, 2014

শ্মশ্রু পুরাণ



আমার চার বছরের শান্তিপূর্ণ (!) বিবাহিত জীবনে হঠাৎ করেই ঝড় নেমে এসেছে। ঘরে এখন টিকে থাকাই মুশকিল ভেবেছিলাম গরমের বন্ধে মজা করে আম কাঁঠাল খাব আর আয়াস করে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখব। সারা রাত উল্লুকের মত জাগবো, আর দিনের বেলা শুধুই ঘুমকিন্তু, আমার গালে ইতস্তত গজিয়ে ওঠা দাড়ি যে সংসারে অশান্তির আগুন লাগাতে পারে তা কস্মিনকালেও ভাবিনি।
        এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের গরমের বন্ধে দাড়ি রাখার প্ল্যান হঠাৎ আমার মাথায় ঢুকেছে, বিশেষ একটি কারণে। মানসিক প্রস্তুতিও শেষ। ভাল দিন দেখে 'রেজার'-কে তালাবন্ধ করে রেখেছিলাম। তিন-চার দিন ভালই চলছিল, কিন্তু বাঁধ সাধল পঞ্চম দিনে। আমার সহধর্মিনি আমাকে বারংবার প্রশ্ন করে অতিষ্ঠ করে তুলল। কেন শেভ করছি না, কিংবা কবে সেটা করব ইত্যাদি হাজারো প্রশ্নের বাউন্সার সামলাতে সামলাতে আমার অবস্থা সঙ্গিন। কাঁচা পাকা দাড়ি  শ্রীমুখের সৌন্দর্য কেড়ে নিয়েছে, গিন্নির এই বিশ্বাসে কিছুতেই ফাটল ধরানো গেল নাআয়নায় অবশ্য এই নূতন আমিকে দেখে আমার ভালোই লাগছিল, কিন্তু এটা বোঝাবো কাকে? দাড়ি রাখার নেপথ্য কারণ না বলে শুধু বললাম যে  বন্ধ যেদিন শেষ হবে, সেদিন আবার আগের মুখশ্রী ফিরে আসবে। স্বাভাবিকভাবেই এতে আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল। কারণ বলার জন্য আবার পীড়াপীড়ি। কিন্তু সেটা বলা আমার সমীচিন মনে হলনা। হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো একটি বাক্য -'কারো ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়'ব্যস-তারপর আমার ইস্ত্রির মুখ দিয়ে কিছু সময়ের জন্য কথা বন্ধ। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় তিনি শুধু একটি কথা বলে আমাকে চিন্তায় ফেলে দিলেন যা ভবিষ্যতের জন্য আমার পক্ষে কোনভাবেই শুভ মনে হলনা। 'ব্যক্তি স্বাধীনতাকে আশা করি তুমিও ভবিষ্যতে সম্মান করবে'- স্ত্রীর মুখসৃত এই বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য আপাতত হজম করা ছাড়া আমার উপায় নেই। 
       নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কে আমার মাতৃদেবীর প্রবেশ। আমার ভীমরতির কারণ অনুসন্ধানে তিনি ছুটে এসেছেন। বুঝতে পারলাম যে রান্নাঘরে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। এবার তো মহা মুশকিল। আমার মৌনতা মা-এর কাছে অস্বাভাবিক লাগছেতিনি সিদ্ধান্তে আসলেন যে আমার আমার নাকি কিসের নজর লেগেছে। ঘরে পূজো না দিলে আমার এথেকে রেহাই নেই। পুরোহিতের সঙ্গে অতিসত্ত্বর যোগাযোগের কথা বলে তিনি আবার রান্না ঘরে চলে গেলেন। এর মানে শান্তি স্বস্তয়নের জন্য পকেট থেকে আবার নগদ টাকা বেরিয়ে যাবে। যাই হোক ঘরে একজন প্রাণী অন্তত: খুশি, আর সে হল আমার তিন বছরের মেয়ে ঐশী। মাথার চুল যে গালে গজাতে পারে সেটা জেনে তার খুব আনন্দঐশী তো ওর মা-কে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,'মা, তোমার মুখে তো বাবার মত চুল উঠছেনা!' এই কথা বলার পর আমি আর ঘরে না থেকে দ্রুত স্থানত্যাগ করলাম।
        প্রশ্ন শুধু ঘরেই সীমাবদ্ধ রইলনা। এবার দিবালোকেও প্রশ্ন ধেয়ে আসতে লাগলো বন্ধুবান্ধব আত্মীয় পরিজনদের কাছ থেকে। বাজার করতে বের হব হঠাৎ বাড়ির গেটেই দেখা বাড়ির মালিকের সঙ্গে। প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো 'অব কি বার...'ঘোর বিজেপির সমর্থক-কে প্রিয় নেতার চেহারা মনে করিয়ে দিতেই তিনি ঘায়েল। 'সাধু সাধু' বলেই তিনি অন্দর মহলে চলে গেলেন। গলি থেকে বেরিয়ে শঙ্কর-দার সঙ্গে দেখা। সৌজন্যমূলক আলাপের পর সেই প্রশ্ন। আমার উত্তর-'বর্তমানে তো রেলের ভাড়াই শুধু বৃদ্ধি হল, আগামীতে ব্লেড আর রেজার ছাড় পেয়ে যাবে বলছেন?' কথাটি বলতেই বামপন্থী শঙ্কর-দার মুখের 'জিওগ্রাফি' মুহূর্তে বদলে গেল। তারপর পাক্কা দশ মিনিট শাসক দলের বদনাম শুনতে হল। কোনরকমে তাঁর কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে বাজারের দিকে ছুটলাম। পান ক্রয় করেই আমার দৈনন্দিন বাজার শুরু হয়সেটারও এক সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আছে, যা এ মুহূর্তে আর বলছিনা। 'দাদা কি বিশ্বকাপ ফুটবলে  ইরান দলের সমর্থক নাকি?' পান দোকানির এমন প্রশ্ন শুনেই মুহূর্তে আমার প্রতিক্রিয়া,'গভীর রাত্রিতে খেলা বোধহয় খুব একটা দেখা হয় না। আর্জেন্টিনা বলেও একটা টিম আছে।' সে খুব চিন্তায় পড়ে গেল। আর্জেন্টিনাতে কোনও খেলোয়াড় দাড়ি রাখে কিনা এই ব্যাপারে সে শিওর নয়। অস্ত্র কাজে লাগলো। এরপর এগিয়ে গেলাম মাছের বাজারের দিকে। সেখানেই আমার সদ্য বিবাহিত বন্ধু দীপঙ্করের সঙ্গে দেখা। আমার দিকে চেয়ে হেসে কিছু বলার আগেই বললাম,'চার বছর পর এর উত্তর পাবে। ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের পরই তো শুরু হয় আসলো মজা। শুরুতে সব ঠিকঠাক চলে, তারপর...'দীপঙ্কর কথা না বাড়িয়ে কেটে পড়লো।
        মাছের দাম দিয়েই বাজারের বাজেট ঠিক হয়। তাই এবার সবজী কেনার পালা। গ্রামের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কম খরচে সবজি কিনতেই বাজারের শেষ সীমানায় এসে উপস্থিত হই।  আমার দরদাম করা বোধহয় বুড়ো সবজীওয়ালার পছন্দ হলনা। 'আরে ছোটে মিয়াঁ, গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে কি ভুলে গেলে সবজী ক্ষেতে কি লোকসান হয়? ঘরে গিয়ে আব্বাজান কে জিজ্ঞেস করবে'অবাক হলাম, আমার দাড়ি তো ধর্ম বদলে দিল! কথা না বাড়িয়ে চটপট সবজী কিনে বেরিয়ে পড়লাম। রিক্সায় এসে নামলাম বাড়ির সামনে। কলেজে যাচ্ছে পাশের বাড়ির রোহিত। চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে। বললাম 'নূতন ফ্যাশন'
        ঘরে ঢুকে অথিতিকে দেখে চক্ষু চড়ক গাছ। এখনও যে কি উত্তর দেব। আমার শাশুড়ি বসে আছেন। ভারিক্কি গলায় সেই অবধারিত প্রশ্ন আমার দিকে ধেয়ে আসল। 'আসলে সম্প্রতি চোখে কম দেখতে পাই', আমার এই উত্তরে তিনি বেশ অবাক হলেন। 'আসলে দাড়ি কাটলে চোখে এর সরাসরি প্রভাব পড়ে, তাই আপাতত কিছুদিন...'সন্তুষ্ট হলেন বলে মনে হলনা। ডাক্তারের নাম জিজ্ঞেস করলেন। শহরের বিখ্যাত এক চক্ষু বিশেষজ্ঞের নাম বলতেই তিনি জানালেন যে আগামী তিনদিন পর তিনিও সেখানে যাচ্ছেন চোখ দেখাতে।  আর যাচাই করে নেবেন এই আজব উত্তরের সত্যতা। যাই হোক কেটে পড়লাম সেখান থেকে। বিকেলে ঘরে এসে হাজির আমার সহকর্মীওকে বললাম যে শুধু ওকেই বলছি আসল সত্য। আমাদের ডিপার্টমেন্টে রয়েছে বুড়োর দল। তাই আমাদের মত কমবয়সীদের বিশেষ পাত্তা না পাওয়ার জন্য এই বুদ্ধি। সহকর্মীর মনে হয় খুব পছন্দ হল আমার কথা। সেই মুহূর্তে সেও ঠিক করল দাড়ি রাখবে। 'বিয়ে যখন করনি, তখন কোনও অসুবিধে নেই...'আমার অন্তর্নিহিত কথার মানে বোঝার আগেই চা মিষ্টি চলে এলো।
        সন্ধ্যাবেলা শ্বশুর বাড়িতে যেতেই শ্যালক-শ্যালিকা চেপে ধরল। বললাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক হতে চলেছে, আর এটাতে দেবদাসের ভূমিকায় আমি অভিনয় করতে চলেছি।  কিন্তু এসব বলে যে ওদের ঠকানো যাবেনা, সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছি। বাবা রামদেব, বাবা রামকৃষ্ণ ছাড়াও পাগড়ি-হীন লাদেন ইত্যাদি অদ্ভুত সব নতুন নামকরণ হল আমার। দাড়ি রেখে যে এমন ল্যাজে গোবরে হতে হবে এটা কখনো ভাবিনি। আমার স্মার্ট চেহারাকে নাকি বর্তমানএ দাড়ি গিলে খেয়েছে, এটাই ওদের ধারণা। যাই হোক সত্য কথা তাহলে এতদিনে বের হল ওদের মুখ থেকে। কারণ শ্যালক-শ্যালিকাদের চোখে তো এতদিন আমি ছিলাম পৃথিবীর সবথেকে 'আনস্মার্ট ম্যান'!    
        আমার দাড়ি পোষে রাখার কিছু সুফল পেলাম। চারিদিকে আমার গুরুত্ব যেন একটু বেড়ে গেছে। সবাই যেচে এসে আলাপ করছে। ডিপ্লোম্যাসি উত্তর দিয়ে কিভাবে সমাজে চলতে হয় সেটাও সামান্য আয়ত্ব করলামমোটামুটি সবাইকে খুশি করতে পেরেছি একমাত্র সহধর্মিনি ছাড়া। ষ্টিম ইঞ্জিনের হুইসলের মত হঠাৎ গর্জনের আওয়াজ দু'দিন ধরে শুনতে পাচ্ছি। এভাবে চললে বিশ্বকাপ অন্তত শান্তিতে দেখা হবেনা।
        স্মার্ট ফোনের দিকে এগিয়ে গেলাম। তারপর 'সেলফাই ফটো'ফটো আপলোড করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট করলাম- 'হিমাদ্রি উইথ বিয়ার্ড...ফার্স্ট এন্ড লাস্ট'ফেসবুকের প্রোফাইল ফটোর জন্যই যত কাণ্ড। সুদীর্ঘ পনেরো দিনের কৃচ্ছসাধন আজ সম্পূর্ণ হল। কাল সকালেই হয়ে যাবো- 'শেভড জেন্টলম্যান'  সংসার হয়ে উঠবে সুন্দর আর শান্তিপূর্ণ।

- বরাকের নুতন দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত (২৬ জুন, ২০১৪ ইং)