Saturday, June 12, 2010

রাতের আকাশে ম্যাকনটের মায়াবী রূপ

“মুসাফির হু ইয়ারো
না ঘর হ্যায় না ঠিকানা
মুঝে বস চলতে জানা ...”

      কিশোরকুমারের গানটি এই নায়কের আবির্ভাবের সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে যায় । রাতের আকাশে তার আকস্মিক আগমন যুগযুগান্তর ধরে মোহিত করে রেখেছে পৃথিবীবাসিদের । সূর্যের অমোঘ আকর্ষণে লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এই পরিযায়ি মহাজাগতিক বস্তু হাজির হয় সৌরজগতে । পৃথিবীর পাশ দিয়ে হাসতে হাসতে হাত নেড়ে যাবার সময় সে দৃশ্যমান হয় এই গ্রহ থেকে । মায়াময় জগৎ থেকে সৌরজগতে ধূমকেতুর আগমনকে নাটকীয় ছাড়া আর কী বলা যায় ! আগামী ১৩ জুন থেকেই রাতের আকাশে এক নুতন হার্টথ্রব নায়ক ‘ধূমকেতু ম্যাকনট’-এর লাইভ শো শুরু হবে ।


           
         
              ৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৯ । রোজকার মতই দূরবীন নিয়ে রাতের আকাশের মনোরম দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত এক জ্যোর্তিবিদ । হঠাৎ চমকে উঠলেন তিনি ! পরিচিত আকাশের এক কোনে নুতন অতিথিকে দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না । ইতিহাসের পাতায় আবারও কী নাম উঠতে যাচ্ছে নাকি ! সঙ্গে সঙ্গে ফটো সহ বিস্তারিত রিপোর্ট তিনি পাঠিয়ে দেন ইন্টারন্যাশনেল অ্যাস্ট্রোনোমিকেল ইউনিয়ন পরিচালিত ‘মাইনর প্ল্যানেট সেন্টার’-এ । সেখান থেকে খবর আসার পর আনন্দে আত্মহারা অস্ট্রেলিয়ান জ্যোর্তিবিদ রবার্ট ম্যাকনট -- নুতন ধূমকেতু সৌরজগতে ।  প্রথা অনুযায়ী আবিষ্কারকের নামেই ধূমকেতুর নাম হল ‘ধূমকেতু ম্যাকনট’ । এর আগেও ২০০৬ সালে আরো একটি ধূমকেতু আবিষ্কার করে রীতিমত হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন ম্যাকনট ।  

              ধূমকেতু হল একটি মহাজাগতিক বস্তু যার ব্যাসার্দ্ধ ১ থেকে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে । মূলতঃ বরফ, পাথর আর অরগ্যানিক পদার্থ দিয়েই তৈরী সে । ধূমকেতুর বিশেষত্ব হল সূর্যের নিকটে আসলেই তার দুটি লেজ গজায় । একটিকে বলা হয় ‘আয়ন টেল’ আর অপরটিকে ‘ডাস্ট টেল’ ।  লেজগুলো সবসময় সূর্যের বিপরীতে থাকে । আবার যখন সে সূর্যের আকর্ষণ থেকে দূরে চলে যায় তখন লেজও গায়েব !

              ধূমকেতুর আবির্ভাবে লুকিয়ে রয়েছে নানা গল্প । প্রাচীনকালে এর আবির্ভাবে মানুষ হয়ে উঠতো শঙ্কিত । অনাবৃষ্টি, খরা, ভূমিকম্প ইত্যাদি নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ধূমকেতুর আকস্মিক আগমনকেই দায়ী করা হত । কিন্তু সময় বদলেছে, কারণ বিজ্ঞানের দৌলতে সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে কুসংস্কার মুক্ত । এখন তাই রাতের আকাশে ধূমকেতুর আবির্ভাবে তারা কোন অমঙ্গলের ছায়া দেখতে পাননা । 

               তাইকো ব্রাহে নামক ডেনমার্কের এক জ্যোর্তিবিদ ১৫৭৭ সালে ইউরোপের নানা জায়গায়  যন্ত্রপাতির সাহায্যে প্রথম ধূমকেতুর পর্যবেক্ষণ করেন । তার পর্যবেক্ষণ থেকেই বেরিয়ে আসে নুতন তথ্য যে ধূমকেতু আমাদের সৌরজগতের সদস্য । তারপর শুরু হয় বিজ্ঞানীদের গবেষণা । আর এই গবেষণায় ইংল্যান্ডের অ্যাডমন্ড হ্যালির অবদান অনস্বীকার্য । হ্যালি ১৭০৫ সালে সর্বপ্রথম আইজাক নিউটনের বলতত্ত্ব ব্যবহার করে দেখান যে ইতিহাস বর্ণিত ১৪৫৬, ১৫৩১, ১৬০৭ আর ১৬৮২ সালে আবির্ভূত হওয়া ধূমকেতু গুলি আসলে একই  ধূমকেতু  যাদের পরিভ্রমন পথ ৭৬ বছর । তিনি ঘোষণা করেন যে ১৭৫৮ সালে ধূমকেতুটি আবার আসবে । অবশেষে বিজ্ঞানের জয় হল । ১৭৫৮ তে রাতের আকাশে আবার আগমন ঘটলো তার । কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল ঐ ঐতিহাসিক ঘটনার সত্যতা জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি হ্যালি ।  ১৭৪২ সালেই তার মৃত্যু হয় । অবশেষে হ্যালির সম্মানার্থে ধূমকেতুটির নাম রাখা হয় – ‘হ্যালির ধূমকেতু’ যা ১৯৮৬ সালে পৃথিবী থেকে শেষ দৃশ্যমান হয়েছিল । ধূমকেতু পুনরাবৃত্ত (Periodical) আর অপুনরাবৃত্ত (Non periodical) দু’রকমের হতে পারে । ‘পুনরাবৃত্ত ধূমকেতু’ একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর সূর্যকে পরিভ্রমন করে থাকে । যেমন – ‘ধূমকেতু হ্যালি’, ‘ধূমকেতু হেল-বপ’ ইত্যাদি । আর ‘অপুনরাবৃত্ত ধূমকেতু’-এর ক্ষেত্রে  আগমন একবারই ঘটে থাকে ।  যেমন – ‘ধূমকেতু লেভি’, ‘ধূমকেতু অস্টিন’ ইত্যাদি ।   

               ধূমকেতুর আবাসস্থল ঠিক কোথায় ? সূর্য থেকে অনেকদূরে বর্তুলাকার একটি দেশ আছে যাকে ‘উওর্ট ক্লাউড’ বলা হয় । বিখ্যাত জ্যোর্তিবিজ্ঞানী জেন হেনরিক উওর্ট প্রথম আবিষ্কার করেন ধূমকেতুর উৎপত্তিস্থল । সূর্য থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্ব ১৫ কোটি কিলোমিটার । এই দূরত্বকে এক ‘অ্যাস্ট্রোনোমিকেল ইউনিট’ বলা হয় । আর সূর্যকে আবৃত করে রাখা বর্তুলাকার ‘উওর্ট ক্লাউড’ প্রায় এক লক্ষ অ্যাস্ট্রোনোমিকেল ইউনিট দূরত্বে আছে,  কিন্তু তবুও সূর্যের আকর্ষণে আবদ্ধ সে ! সেই ক্লাউডেই রয়েছে অসংখ্য ধূমকেতু । বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে দেখেছেন যে সেখানে ১০ কোটি থেকে ১০০০ কোটি ধূমকেতু থাকতে পারে । সেই আবাসস্থল থেকে কিছু ধূমকেতু কখনো ঢুকে পড়ে সৌরমন্ডলের ভিতরে । আর তারপর শুরু হয়ে যায় সূর্যকে কেন্দ্র করে ওদের পরিভ্রমণ । সাধারণতঃ উপবৃত্তাকার (Elliptical)অথবা অধিবৃত্তাকার (Parabolic) পথেই ধূমকেতু সূর্যকে পরিভ্রমন করে । 

               ভোরের নির্মল হাওয়াতে যারা প্রাতঃকালীন সফরে অভ্যস্ত, তারাই লাইভ শো এর মজা উপভোগ করতে পারবেন । কারণ ‘ধূমকেতু ম্যাকনট’ ভোর চারটে থেকেই খালি চোখে পূর্বাকাশে বুধ গ্রহের একটু ওপরেই দেখা যাবে । বুধ গ্রহ চেনার উপায় হল এর ঔজ্জ্বল্যতা । এই জ্যোতিষ্কের আলো স্থির আর এটি তারার মত জ্বলজ্বল করবেনা । আনন্দের খবর হল  ১২ জুন অমাবস্যা থাকায় আগামী ১৩ জুন থেকে এই ধূমকেতু খুব ভাল ভাবে কয়েকদিন দৃশ্যমান হবে । ধীরে ধীরে এর ঔজ্জ্বল্যতা বাড়তে থাকবে । সবথেকে গুরূত্বপূর্ণ ব্যাপার হল এই ধূমকেতু আবার সৌরজগতে ফিরে আসবে কিনা তা বলা মুশকিল । কারণ প্রাথমিক তথ্যমতে  এই ধূমকেতু অপুনরাবৃত্ত । তাই বিজ্ঞানীদের কাছে  ম্যাকনট একটু বাড়তি সমাদর পাবে । 

                এখন আবহাওয়া দপ্তরকে প্রশ্ন – মেঘের আস্তরণ সরবে তো ?