Wednesday, September 29, 2010

মোবাইল আতঙ্ক ভিত্তিহীন


“অনুগ্রহ করে ৯৮৮৮৩০৮০০১, ৯৩১৬০৪৮১২১, ৯৮৭৬২৬৬২১১, ৯৮৮৮৮৫৪১৩৭ এবং ৯৮৭৬৭১৫৫৮৭ মোবাইল নাম্বারগুলো থেকে কোন ফোন আসলে ধরবেন না । নাম্বারগুলো সেলফোনে আসলে লাল হয়ে যায় । উচ্চ কম্পনাঙ্কের এই ফোন কল গুলো ধরলে মস্তিষ্কক্ষরণ হতে পারে । ২৭জন মানুষের ইতিমধ্যে মৃত্যু হয়ে গেছে । বিস্তারিত জানার জন্য ডিডি নিউজ, আজতক চ্যানেলে চোখ রাখুন” ।
     আজব এই এস এম এসটি আমার সেলফোনে আসার পর অন্য ফালতু ম্যাসেজের মতই সে মোবাইলের এক বটনের চাপে ‘ডিলিট’ হয়ে গেল । কিন্তু চমক বাকি ছিল ! এই ‘সন্দেশ’-টি যে অনেকের বদহজম হয়েছে তা মিডিয়ার দৌলতে জানতে আর দেরি হয়নি । গুজব আর আতঙ্কের ককটেলে যে এই ‘সন্দেশ’ খবরের শিরোনাম হয়ে যেতে পারে তা বোঝা যায় নি, বা এই মুছে যাওয়া সন্দেশকে নিয়ে যে কলম ধরতে হবে তাও স্বপ্নে ভাবিনি । নিছক একটি ম্যাসেজ, সমস্যা জর্জরিত উত্তরপূর্বে আতঙ্কের নবতম সংযোজন । অলিক আতঙ্কের এই ম্যাসেজ পুজোর আগে আমজনতার কাছে পুজোর চাঁদার থেকেও ভয়ঙ্কর এক জুজু হয়ে ধরা দিয়েছে ।
     বিশ্লেষণে যাবার আগে বলে নেওয়া ভাল যে কোন অপ্রত্যাশিত ফোন কল থেকে মস্তিষ্কক্ষরণ বা মোবাইল ফোনের ব্যাটারি বিস্ফোরণ হবার কোন সম্ভাবনা নেই । আর এটা বিজ্ঞানসম্মত সত্য । 
     মোবাইল ফোনে যখন দুজন ব্যক্তি কথা বলেন তখন উচ্চ কম্পনাঙ্কের (৮০০-১০০০ মেগাহার্জ) বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গের জাদুতেই সেটা সম্ভব হয়, যাকে ‘বাহক তরংগ’ ও বলা হয়ে থাকে । আমাদের কথাবার্তার তরঙ্গকে এই বাহক তরঙ্গ এক মোবাইল ফোন থেকে আর এক ফোনে বহন করে নিয়ে যায় । মানুষের শ্রাব্যতীব্রতা মাপার জন্য একটি একক ব্যবহার করা হয় যাকে ‘ডেসিবেল’ বলা হয় যা শব্দচাপের একক । সাধারণতঃ দু’জন মানুষ যখন কথা বলেন তখন তীব্রতা প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ ডেসিবেল হয় । বিজ্ঞানীদের মতে মানুষের সাধারণ শ্রাব্যসীমা হল প্রায় ৮৫ ডেসিবেল । এর থেকে বেশী হলে মানুষের বধির হবার আশঙ্কা থাকে । এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বজ্রপাতের শব্দ প্রায় ১২০ ডেসিবেল হয়ে থাকে । মোবাইল কোম্পানীদের জন্য সরকারী তরফ থেকে একটা সীমা নির্ধারণ করা থাকে যা কোনমতেই ৮৫ ডেসিবেলের বেশী হতে পারবেনা । তার মানে কোন ক্ষতিকারক উচ্চ কম্পনাঙ্কের তরঙ্গ আমাদের মোবাইল সেটে এসে পৌছাতে পারবেনা । মোদ্দা কথায় মস্তিষ্কক্ষরণের কোন আশঙ্কাই নেই । তাই যে কোন নাম্বার থেকেই ফোন কল আসুক না কেন সেই কল থেকে অন্ততঃ হার্টের সমস্যা, কান দিয়ে রক্ত বের হওয়া ইত্যাদি আজব ঘটনা ঘটার বাস্তব কোন কারণ নেই । আর এটা বিজ্ঞানসম্মত সত্য । 
     মোবাইল বিস্ফোরণ নিয়ে গুজব বর্তমানে চরমে । মোবাইলের ব্যাটারি কখনো কখনো বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে তবে তা কখনো বৃহদাকারে হয়না । নানা কারনে সেটা হতে পারে । ২০০৬ সালে নোকিয়া কোম্পানীর ‘বি এল ৫ সি’ সিরিজের ব্যাটারিতে সমস্যা দেখা গিয়েছিল । ভারতের নানা প্রান্ত থেকে মৃদু বিস্ফোরণের খবরও শুনা যাচ্ছিল । যাই হোক সেই সমস্যা কোম্পানী অচিরেই সমাধান করতে পেরেছিল । টেকনোলজি এক্সপার্টদের মতে কখনো কখনো ব্যাটারি খুব বেশী চার্জিং করলে, অথবা পুরানো ব্যাটারি থেকেও মৃদু বিস্ফোরণ হতে পারে । তবে সেই বিস্ফোরণে ক্ষতির সম্ভাবনা খুব কম । আর কোন ফোনকলের মাধ্যমে মোবাইল বিস্ফোরণ ঘটানো অসম্ভব । 
     এবার আসি মোবাইল ভাইরাস প্রসঙ্গে । ‘মোবাইল ভাইরাস’ হল এক উন্নতমানের প্রোগ্রাম যে নিজে রক্তবীজের মত বংশবৃদ্ধি করে মোবাইলের সফটয়ারের প্রভূত ক্ষতিসাধন করতে পারে । মানুষ যেমন মোবাইল সৃষ্টি করেছে ঠিক তেমনি মোবাইল ভাইরাস সৃষ্টির পুরো কৃতিত্বও কিন্তু কিছু অপরাধপ্রবন মানুষেরই । এই ভাইরাস মোবাইলকে বিকল করে দিতে পারে । মূলতঃ ‘ব্লু টুথ’ এর সাহায্যে গান এবং ভিডিও ডাউনলোড করার সময় ভাইরাসগুলি এক মোবাইল থেকে অন্য মোবাইলে ছড়িয়ে পড়ে । পাশাপাশি ইন্টারনেট থেকেও ছড়িয়ে পড়তে পারে ভাইরাস । সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাতে দেখা গেছে যে কিছু মোবাইল লাল হয়ে গেছে, অথবা নানা আজব নাম্বার মোবাইলের স্ক্রিনে চলে আসছে, এর পেছনেও কিন্তু ভাইরাসের নেপথ্য ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না । তবে কোন ভাইরাস মোবাইলের বিস্ফোরণ অথবা আমাদের দৈহিক অসুস্থতার জন্য কোন ভাবেই দায়ী নয় ! 
     এই সরল মোবাইল সন্দেশটির জন্ম ২০০৭ সালে । আঁতুরঘর - পাকিস্থান । সেখান থেকে আতঙ্কের এই এস এম এস আফগানিস্থানেও আলোড়ন তুলে । গুজবের বিষাক্ত ঝড়ে সেখানের জনজীবন স্তব্ধ হয়ে পড়ে । ‘মোবাইল বিজনেস ম্যাগাজিন’ এর তথ্যমতে পাকিস্থান ও আফগানিস্থান সরকারের তরফ থেকে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে গুজব নিয়ে আতঙ্কিত না হবার কথা প্রচার করা হয় । আফগান টেলিভিশনে সরকারী আধিকারীকেরা সম্ভাব্য গুজব নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি জনসাধারণের সম্মুখে তুলে ধরেন । ৭ এপ্রিল ২০০৭ সালে এই এস এম এস কেসের নেপথ্য চার অপরাধীদের ধরা হয় । এই ‘সন্দেশ’ যে বর্তমানে উত্তরপূর্ব ভারতেই ঝড় তুলেছে এমন নয়, বিশ্বের নানা দেশেও তা ছড়িয়ে পড়েছে । সম্প্রতি সুদান, কেনিয়াতেও চলছে গুজবের রাজত্ব । সে দেশের সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রকের তরফ থেকেও গুজবে কান না দেবার কথা বহুলভাবে প্রচার করা হয়েছে । সবথেকে মজার ব্যাপার হল আমাদের এখানের মোবাইলে যে ম্যাসেজ এসেছে তা ২০০৭ সালের ম্যাসেজটির হুবহু নকল । শুধু স্থানকাল ভেদে নিউজ চ্যানেলের নাম পরিবর্তিত হয়েছে । সেই ম্যাসেজেও ২৭জন মানুষের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছিল । আর ম্যাসেজের ৫ টি নম্বরও অপরিবর্তিত । ম্যাসেজ একই, কিন্তু এখন সে দেশের সীমা অতিক্রম করেছে । এই প্রবন্ধ লেখার কারণে নানা মোবাইল ফোন পরিষেবা বিতরণকারীদের সঙ্গে ই-মেলে যোগাযোগ করা হলে তারাও সবাই এই গুজবে কান না দেবার কথা বলেছেন । আসলে এই ভুয়ো ম্যাসেজের বাড়বাড়ন্ত রুখতে আমাদের সম্মিলিত প্রয়াস দরকার ।
     মোবাইল ফোনের ক্ষতিকারক প্রভাব নিয়েও সারা বিশ্বে গবেষনা হচ্ছে । তবে তা মূলতঃ দীর্ঘসময় সেলফোন ব্যবহার কেন্দ্রিক । ২০০৫ সালে গবেষক এস লোন আর তার সহযোগীরা আমেরিকান জার্নাল অফ এপিডেমিওলোজিতে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন । গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল ‘লং টার্ম মোবাইল ফোন ইউস এন্ড ব্রেইন টিউমার রিস্ক’ । দেখা গেছে, যারা খুব বেশী মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন তাদের ব্রেন টিউমার হবার সম্ভাবনাও বেড়ে যায় । এ ছাড়া আরো ভয়ঙ্কর কথা শুনিয়েছেন বিজ্ঞানীরা । পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাবার সম্ভাবনাও বাড়ছে – ২০০৭ এ প্রকাশিত একটি গবেষনণাপত্রে এমনই আশঙ্কা করেছেন আর্থার ডোইয়াক আর তার সহযোগীরা । এছাড়া আরো অনেক অপকারিতার খবরও লুকিয়ে রয়েছে মোবাইল ফোনের ব্যবহারে । তবে এসব ক্ষেত্রে অনেকদিন ফোন ব্যবহার করলেই এই দুর্ভোগ দেখা দিতে পারে । তবে তাৎক্ষণিক ক্ষতির কথা বিজ্ঞানীরা একযোগে অস্বীকার করেছেন ।
     শেষ পাতে পরিবেশন ! গত তিনদিন আগে আমার মোবাইলে এক অজানা ফোন কল আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার মা আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েন । নাম্বারটি দেখে ‘ল্যান্ডলাইন নাম্বার’ বলে মা-কে আশ্বস্ত করলাম । অপরপ্রান্ত থেকে আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধুর পরিচিত কন্ঠস্বর –‘এখনই সেল স্যুইচ অফ কর । শুনিসনি যে কোন সময় অজানা ফোনকল এসে সেলফোনের বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে । আমাদের পাড়াতে ঘোষণা হয়ে গেছে । সবার সেল স্যুইচ অফ । তোর ফোন তো এখন তাজা বোমা’ । মা-কে কথোপকথনের রিপোর্ট দিলাম না । টেবিলের উপর চুপচাপ শুয়ে থাকা তাজা বোমাটির উপর চোখ পড়লো । সে নীরবে শুয়ে আছে, আর তাকে নিয়েই চলছে সারা বিশ্বে নানা খেলা !