Sunday, July 15, 2012

ঈশ্বর কণার সন্ধানে

সুইজারল্যান্ডের জেনেভার ‘সার্ন সেন্টার’-এ অডিটোরিয়াম ভর্তি লোক । অন্যান্য বিশেষ নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮৩ বছরের এক পদার্থবিজ্ঞানীও দর্শকের আসনে চুপচাপ বসে রয়েছেন । সবার চোখ সেই বিজ্ঞানীর দিকে । আজ এমন এক ঘোষণা হতে চলেছে যা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা হবে । ১৯৬৪ সালে যে বিজ্ঞানী মানস চক্ষে দেখতে পেয়েছিলেন ভবিষ্যতের ‘চাপ্টার’, আজ ৪ঠা জুলাই ২০১২ সালে সার্নের বিজ্ঞানীরা জনসাধারণের সামনে সেটিই উন্মুক্ত করতে চলেছেনসেই পদার্থবিজ্ঞানীর কল্পনা আর গণিতের মেলবন্ধনের বাস্তব স্বরূপ দেখার জন্য সারা পৃথিবীর মানুষ অপেক্ষা করছেন । যথাসময়ে সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা হল, আর তারপর অডিটোরিয়াম ভর্তি মানুষের হাততালির ছন্দে সেই ভদ্রলোক কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন সাফল্যের খুশিতে ওনার চোখে জল । জীবন সায়াহ্নে এসে এমন খুশির খবর যে শুনবেন তা ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পিটার হিগ্‌স্‌ স্বপ্নেও ভাবেন নি । বিজ্ঞানের জগত তখন ঈশ্বরময় ! অদৃশ্য কোন এক জগত থেকে অবশেষে ‘ঈশ্বর কণা’ দৃশ্যমান জগতে আবির্ভূত হলেন । বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা আর জেদের কাছে তিনি পরাজিত হলেন । এই ধরাধামে ঈশ্বর কণাকে আনিয়েই ছাড়লেন বিজ্ঞানীরা । গণিতের মধ্যে যে লুকিয়ে আছে সৃষ্টি রহস্যের চাবিকাঠি তা আবারও পরীক্ষিত ভাবে প্রমাণিত হল । পিটার হিগ্‌সের গবেষণা থেকে জন্ম নেওয়া এক তাত্ত্বিক কণা অবশেষে গণিতের দুনিয়া থেকে বেরিয়ে এসে ল্যাবরেটরিতে জন্ম নিলোআর এটা হতেই সময় লেগে গেল সুদীর্ঘ ৪৮ বছর !      

পিটার হিগ্‌স্‌
      অ্যালবার্ট আইনস্টাইন আর সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখরের সঙ্গে পিটার হিগ্‌সের এক অদ্ভুত মিল ! এই তিনজন পদার্থবিদ তাঁদের জীবদ্দশায় এমন থিওরির কথা বলেছিলেন যা বিজ্ঞানের জগতে আলোড়ন জাগায় আইনস্টাইনের ‘সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ’, চন্দ্রশেখরের ‘নক্ষত্রের বিবর্তন তত্ত্ব’  আর  হিগ্‌সের ‘গজ বোসনের ভর তত্ত্ব’- এগুলোর পরীক্ষামূলক প্রমাণ করাটাও বিজ্ঞানীদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল১৯১৬ সালে আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের কথা বললেও ১৯১৯ সালে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ অধ্যয়ন করার পর তা পরীক্ষামূলক ভাবে প্রমাণিত হয় । এই বিখ্যাত বিজ্ঞানী ১৯২১ সালে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন । ভারতীয়-আমেরিকান বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ১৯৩০ সালে নক্ষত্রের বিবর্তন রহস্যের উপর গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, আর তখন ‘চন্দ্রশেখর লিমিট’ এর ধারণাও সৃষ্টি হয় । একটি নক্ষত্রের মৃত্যু হবার পর সেটি ‘ওয়াইট ডুয়ার্ফ’, ‘নিউট্রন স্টার’ না ‘ব্ল্যাকহোল’ হবে সেটা নির্ভর করে নক্ষত্রের ভরের উপর । ১৯৭১ সালে ‘ব্ল্যাকহোল’ আবিষ্কৃত হলেও চন্দ্রশেখর ১৯৮৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান ।  উল্লেখ্য যে পিটার হিগ্‌সের পূর্বসূরি দু’জন বিখ্যাত বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হলেও তাঁর ভাগ্যে কিন্তু এখনও নোবেলের শিকে ছিঁড়েনি । তবে ৪ জুলাইর পর বিশ্বের সব দিক থেকেই আওয়াজ উঠছে এই জীবন্ত কিংবদন্তীকে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করারকি হবে, সেটা সময় বলবে । 
 
গত কয়েকমাস ধরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে বিজ্ঞানীদের আনাগোনায় আসর গরম । সেখানেই বিশাল এক কর্মযজ্ঞ চলছে ‘এল এইচ সি’ (লার্জ হ্যাডরন কলাইডার) নামক যন্ত্রে । ‘দ্য ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ’ (সার্ন) এর বদান্যতায় তৈরি এটিই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ যন্ত্র ! ফ্রান্স এবং সুইজারল্যান্ডের সীমানার ২৭ কিলোমিটার পরিধির বৃত্তাকার এক সুরঙ্গের মধ্যেই তার আবাস । গত ৪ঠা জুলাই-এ সার্নের বিজ্ঞানীরা যখন ঘোষণা করলেন যে অবশেষে পাওয়া গেছে ‘ঈশ্বর কণা’, তখন সারা বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে এক খুশির বাতাবরণ সৃষ্টি হয়  পঁয়তাল্লিশ বছরের সুদীর্ঘ যাত্রাপথ পাড়ি দেওয়ার ফলশ্রুতিতেই বিজ্ঞানীদের কাছে এই চরম সাফল্য ধরা দিয়েছে  ।       

লার্জ হ্যাডরন কলাইডার

প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল যে বিজ্ঞানের জগতের ঈশ্বর কণার সঙ্গে আধ্যাত্মিক জগতের ঈশ্বরের কোনও সম্পর্ক নেই । এই কণা শনাক্তকরণের সঙ্গে ভগবানের উপস্থিতি গুলিয়ে ফেললে চলবে না । বিজ্ঞানীদের অভিধানে ‘ঈশ্বর কণা’ বা ‘গড পার্টিকেল’ বলেও কোনও শব্দ নেই । এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘হিগ্‌স্‌ বোসন পার্টিকেল’ বা ‘হিগ্‌স্‌ বোসন কণা’ আসলে নোবেল পদার্থবিজ্ঞানী লীয়ন লেডারম্যান তাঁর ১৯৯৩ এর জনপ্রিয় বই The God Particle: If the Universe Is the Answer, What is the Question?”  তে হিগ্‌স্‌ বোসন কণাকে ঈশ্বর কণা বলে উল্লেখ করায় সাধারণ ভাষায় এই নামকরণ স্থান পেয়ে গেছে । কিন্তু এই বই প্রকাশের অনেক পর নাস্তিক লেডারম্যান স্বীকার করেছিলেন যে তিনি আসলে গড পার্টিকেলের বদলে ‘গডড্যাম পার্টিকেল’ (Goddamn Particle) প্রস্তাব করেছিলেন, কারণ তাঁর মতে সেটাই ছিল সবথেকে যুক্তিযুক্ত । কিন্তু প্রকাশক তা মানতে রাজী হননি বইয়ের কাটতির কথা ভেবে । তবে এটাও ঠিক যে ‘হিগ্‌স্‌ বোসন কণা’-কে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার প্রয়োজনে ‘ঈশ্বর কণা’ নামকরণেরও দরকার ছিল । যেমন স্টিফেন হকিং তাঁর বিখ্যাত বই A Brief history of timeএর মাধ্যমে বিশ্বতত্ত্বের মত দুরূহ বিষয়কে চায়ের টেবিলে নিয়ে আসলেন । এই বইটির মাধ্যমেই ‘ব্ল্যাক হোল’ বা ‘কৃষ্ণ গহ্বর’-এর নাম মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে লাগলো ।  যাই হোক আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা সেই আবিষ্কৃত কণাকে আর ঈশ্বর কণা বলে অভিহিত করবোনা, বরং তাঁকে ‘হিগ্‌স্‌ বোসন কণা’ বলেই সম্বোধন করবো      

সত্যেন্দ্র নাথ বসু
     শুরুতেই জেনে নেওয়া যাক হিগ্‌স্‌ বোসন কণা সম্পর্কে । এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির নেপথ্যে রয়েছে নানাবিধ কণার সংমিশ্রণ । যেমন – ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন । এ ছাড়াও রয়েছে আরও অনেক কণা । একটি মানুষ সৃষ্টির নেপথ্যেও রয়েছে লক্ষকোটি কণার সমন্বয় । এই কণাদের জগতটাও বড় বিচিত্র আর রহস্যময় ! এর কুহেলি ভরা চরিত্র মোহিত করে রেখেছে গবেষকদের । আসলে এই কণাগুলির চরিত্রের গভীরেই লুকিয়ে রয়েছে মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্যের চাবিকাঠি প্রকৃতির সকল জানা পদার্থ এবং শক্তি যে সব মৌলিক কণা দিয়ে গঠিত তাদের শ্রেণীবিন্যাসের নাম ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’কণা দুই ধরণের হয়ে থাকে – ‘ফার্মিয়ন’ (বিখ্যাত বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির নামে) আর ‘বোসন’ (বিখ্যাত ভারতীয় বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্র নাথ বোসের নামে) এ যেন কিছুটা শ্রেণী বিভাগের মত । যেমন - আমেরিকার দুইটি রাজনৈতিক দল হল ‘রিপাবলিকান’ আর ‘ডেমোক্রেটিক’, এর বাইরে কোনও দল নেই । তাই আমেরিকার জনগণ এই দু’টি দল ছাড়া অন্য দলে যেতে পারেন না । মহাবিশ্বে অজস্র কণা থাকলেও তাঁদের দু’টি শ্রেণীতে নাম লেখাতে হয় । হয় ‘ফার্মিয়ন’ নতুবা ‘বোসন’ সব ফার্মিয়নের ভর বা ‘মাস্‌’ আছে, আর কিছু বোসনের ভর আছে । স্ট্যান্ডার্ড মডেল দিয়ে কিছুতেই ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিলোনা এই ভরের উৎপত্তি কিভাবে হয়েছে । অবশেষে ১৯৬৪ সালে পিটার হিগ্‌স্‌ আর তাঁর পাঁচ সমসাময়িক বিজ্ঞানী প্রস্তাব করেন যে এক অদৃশ্য ক্ষেত্র (বা ‘ফিল্ড’) এই মহাবিশ্বের সর্বত্র বিরাজমান আছে যে নাকি মৌলিক কণাগুলিকে ভর প্রদান করেছে । এই ক্ষেত্রকে পরবর্তীতে ‘হিগ্‌স্‌ ক্ষেত্র’ নাম দেওয়া হয়েছে । কিন্তু কি দিয়ে এই ক্ষেত্র গঠিত ? বলা হল যে একটা কণা থাকতে হবে যা দিয়ে এই ক্ষেত্র গঠিত । পরবর্তীতে সেই কণার নাম দেওয়া হল ‘হিগ্‌স্‌ বোসন কণা’ যে নাকি ‘বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্‌স্‌’ মেনে চলে । পিটার হিগ্‌সের লেখা “ব্রোকেন সিমেট্রিস এন্ড দ্য মাসেস অব গজ বোসনস্‌” নামক গবেষণাপত্রটি বিখ্যাত ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারস জার্নালে ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল । মাত্র দেড় পাতায় লেখা গবেষণা পত্রটি বিজ্ঞানের জগতে এক উল্লেখযোগ্য মার্গ দর্শন ঘটিয়েছিল । তবে ঐ জার্নালের একই ভলিউমে হিগ্‌সের সমসাময়িক পাঁচজন বিজ্ঞানী হিগ্‌স্‌ বোসন নিয়ে আরও দু’টি পেপার লিখেছিলেন । তাই তাঁদের অবদানও ভুলবার নয় । 
  
        এবার সাধারণ ভাষায় ‘হিগ্‌স্‌ বোসন কণা’ সম্পর্কে জানা যাক । যদিও পদার্থবিদ ব্যতীত সাধারণ মানুষের পক্ষে ‘হিগ্‌স্‌ তত্ত্ব’ বোঝা বেশ মুশকিল । তবুও উপমার সাহায্যে অনেক বিজ্ঞানীরাই সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপারটা তোলে ধরার চেষ্টা করেছেন । ধরে নেওয়া যাক শহরের এক অভিজাত হোটেলে উঠতি ক্রিকেটারদের নিয়ে এক পার্টির আয়োজন করা হয়েছে । সেই পার্টিতে মুখ্য অতিথি সৌরভ গাঙ্গুলি । একজন ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে সেই পার্টিতে আমিও নিমন্ত্রিত । তিনি যখনই পার্টিতে হাজির হলেন, তখন তাঁর চারিদিকে ক্রিকেটাররা জটলা পাকিয়ে এক গোলাকার আবরণ সৃষ্টি করলোযার ফলে সৌরভের পক্ষে সামনে এগিয়ে যেতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে । কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছেনা । আমি বিনা বাধায় সবদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছি । একজন হালকা ওজনের মানুষের থেকে একজন অধিক ওজনের মানুষের নড়াচড়ায় কষ্ট হয় । সৌরভের ক্ষেত্রেও তা হয়েছে । আসলে সৌরভের ওজন তাঁর ভক্তদের জটলা পাকানোর কারণে বেড়ে গেছে । এই উপমাতে হিগ্‌স্‌ বোসন কণা হচ্ছে ঐ উঠতি ক্রিকেটারদের মত, যার কারণে ভরহীন কণা ভর অর্জন করে ।  যেহেতু আমার জনপ্রিয়তা সৌরভের ধারে কাছেও নেই, তাই ওর থেকে আমার ভর কম হবে । একইভাবে মৌলিক কণাগুলো হিগ্‌স্‌ ক্ষেত্রের সাথে ক্রিয়া করে সমান ভর লাভ করে না, জনপ্রিয়তার মত সবার ভর এক হয় না  । স্বভাবতই সৌরভ হচ্ছেন অধিক ভরের কণা আর আমি হচ্ছি কম ভরের কণা । আর একটি সুন্দর উপমার প্রসঙ্গ এখানে করবো । ধরে নেওয়া যাক এই মহাবিশ্ব অদৃশ্য ক্ষীরে পরিপূর্ণ । আমরা এঁকে ‘হিগ্‌স্‌ ক্ষীর’ বলে আখ্যায়িত করতে পারিপ্রকৃতিতে মৌলিক কণাগুলি হল নানা আকারের চামচের মত । কোনটি বা বড় আর কোনটি ছোট । এখন যদি একটি বড় চামচ হিগ্‌সের ক্ষীরে ডুবিয়ে নেওয়া যায় তবে সে বেশী ক্ষীর নিতে পারবে ছোট চামচ থেকে । যত বেশী ক্ষীর তত বেশী ভর । আর চামচটি যদি ডুবিয়ে নেওয়া না হয় তবে সেটি থাকবে ক্ষীর শূন্য অর্থাৎ ভর শূন্যভর যত কম হবে গতিবেগ তত বেশী । আমরা সবাই জানি যে আলোর গতিবেগ সবথেকে বেশী । আলো বা ‘ফোটন’ যেহেতু একটি কণা, আর তাঁর ভর শূন্য হবার কারণে সে সব কণার থেকে বেশী গতিবেগে ছুটতে থাকে । মোদ্দা কথায় বলতে গেলে হিগ্‌স্‌ বোসন কণার জন্যই প্রকৃতির নানা কণা (যেমন ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদি) তাদের ভর লাভ করেছে ।    

          হিগ্‌স্‌ কণার কথা ১৯৬৪ সালে বলা হলেও একে শনাক্ত করতে বিজ্ঞানীদের এত বছর কেন লেগে গেল ? প্রচলিত থিওরি মতে এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমেই এই মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল যাকে ‘বিগ ব্যাং’ বলা হয়ে থাকে । বিজ্ঞানীদের ধারণা এই বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ পর হিগ্‌স বোসন কণার সৃষ্টি হয় । এই কণা তৈরি হয় অনেক উচ্চ শক্তিতে যা ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা বেশ মুশকিল । তবে বিজ্ঞানীরা হাল ছাড়েননি ।  হিগ্‌স্‌ বোসন কণাকে ল্যাবরেটরিতে সৃষ্টি করার জন্য বিজ্ঞানীরা যন্ত্র তৈরিতে মনোনিবেশ করলেন । ‘দ্য ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ’ (সার্ন) এর নেতৃত্বে তৈরি হল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ যন্ত্র - ‘এল এইচ সি’ (লার্জ হ্যাডরন কলাইডার) ! সারা বিশ্বের প্রায় দশ হাজার বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়ারদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই যন্ত্রটির অবস্থান মাটির তলায় ১৭৫ মিটার নিচে যা বানাতে খরচ হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি ডলার ! মহাবিশ্বের জন্মরহস্য অনুসন্ধান, হিগ্‌স্‌ বোসন কণার পরীক্ষামূলক অস্তিত্বের সন্ধান, ‘ডার্ক ম্যাটার’ আর ‘ডার্ক এনার্জি’ এর রহস্য উন্মোচনের পাশাপাশি ‘গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন থিওরি’ তৈরির লক্ষেই ‘এল এইচ সি’ –এর জন্ম । আসলে এই মহাবিশ্বের যাবতীয় বস্তু, গ্যালাক্সি, গ্রহ নক্ষত্র সব কিছু সৃষ্টির নেপথ্যে রয়েছে এই হিগ্‌স্‌ বোসন কণা । তাই এর শনাক্তকরণ খুব জরুরী হয়ে পড়েছিল । 

     বিস্তারিত না বলে এতটুকুই বলা যায় যে ‘এল এইচ সি’-তে উচ্চ শক্তির একটি প্রোটনের সঙ্গে আর একটি উচ্চ শক্তির প্রোটনের সংঘর্ষ ঘটিয়েই নূতন কণার সৃষ্টি করা হয়েছিল । ফলাফল হিসেবে এমন একটি কণা পাওয়া গেল যার শক্তি প্রায় ১২৫ গিগা ইলেকট্রন ভোল্টের (আলোর গতির এককে) কাছাকাছি । বিজ্ঞানীদের গণনা মতে হিগ্‌স্‌ বোসন কণার শক্তিও এমন হওয়ার কথা । এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে প্রকৃতিতে বাকী মৌলিক কণার শক্তি এমন হওয়ার কথা নয় । এই পরীক্ষার জন্য দু’টি পৃথক বিজ্ঞানীদের দল গঠন করা হয় । একটা দল হল ATLAS (A Toroidal LHC Apparatus), আর অপরটি CMS (Compact Muon Solenoid) উভয় দল পরীক্ষার পর একই ফলাফলে উপনীত হন । এখানে উল্লেখ্য যে কোন দলই অন্য দলের কার্য পদ্ধতি সম্পর্কে জানতেন না । দুটি দলই তৈরি করার সময় নানা দেশের বিজ্ঞানীদের রাখা হয়েছিল যাতে কোন পক্ষপাত না হয় ফলাফলের পর সার্নের বিজ্ঞানীরা একমত হন যে ‘হিগ্‌স্‌ বোসন কণা’ সদৃশ এক কণার সন্ধান পাওয়া গেছে । ৪ঠা জুলাই প্রেস কনফারেন্সে সেই সম্ভাবনার কথাই জনসমক্ষে বলা হয় । “সঠিক কখনো কখনো খুব সুন্দর হয় !” হিগ্‌স্‌ বোসন কণা আবিষ্কারের পর এভাবেই মনের ভাষা ব্যক্ত করেন পিটার হিগ্‌স্‌ ।

     এবার জেনে নেওয়া যাক এই রাজসূয় যজ্ঞে ভারতের অবদান কতটুকু । ‘এল এইচ সি’-তে ২০০০ বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রায় ২০০ জন বিজ্ঞানীই ভারতের । ভারত প্রায় আড়াই কোটি ডলার সাহায্য দিয়েছে সেই মেগা প্রজেক্টে । ‘এল এইচ সি’-এর ২৭ কিলোমিটার বৃত্তাকার সুরঙ্গে রয়েছে প্রায় ১২৩২ টি ক্রায়ো ম্যাগনেট । সেগুলি সূক্ষ্মভাবে ঠিকঠাক জায়গায় বসানোর জন্য যে ‘পজিশনিং সিস্টেম’ এর দরকার তা ইনডোরের ‘রাজা রামান্না সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড টেকনোলজি’-তে বানানো হয়েছে । ‘সি এম এস ডিটেক্টর’-এর বিশেষ ‘সেন্সর’ গুলো দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে বানানো হয়েছে । উল্লেখ্য যে এই ডিটেক্টর হিগ্‌স্‌ বোসন কণা শনাক্তকরণে বিশেষ ভূমিকা নেয় । এছাড়াও টাটা ইন্সটিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, মুম্বাই; ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার, ট্রোম্বে; সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, কলকাতা; বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়; জয়পুর বিশ্ববিদ্যালয়; পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদির বিজ্ঞানীরা ‘ফাইবার অপটিক ক্যাবল্‌স্‌’ ডেভেলপমেন্টে সার্ন-কে নানা ভাবে সাহায্য করেন । ‘এল এইচ সি’-এর ভেতরে যে সূক্ষ্ম পরীক্ষা নিরীক্ষা হচ্ছে সেগুলিকে বিশ্লেষণ করার জন্য উন্নতমানের সফটওয়ার দরকার ভারতের গবেষকেরা সেই বিশেষ সফটওয়ার বানাতে সার্ন-কে সাহায্য করেছেন । ভারতীয় মূলের ব্রিটিশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক জিম ভির্ডি আবার ‘সি এম এস ডিটেক্টর’-এর প্রতিষ্টাতা সদস্যভারতের অধ্যাপক অর্চনা শর্মা প্রায় ২৫ বছর ধরে সার্নের ঐ ল্যাবে কাজ করছেন । সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এর অধ্যাপক বিকাস সিনহা একটি বিশেষ ‘চিপ’ তৈরি করেন যা ‘এল এইচ সি’ তে সিগনাল প্রসেসিং এ ব্যবহৃত হয় । অধ্যাপক বিনোদ চৌহান কে কিছু বিজ্ঞানীদের গ্রুপ লিডার বানানো হয় যাদের কাজ ছিল ‘এল এইচ সি’-এর ভেতরে সব ম্যাগনেট ঠিকঠাক ভাবে কাজ করছে কি না সেটার উপর নজর রাখা ভারতের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের পি এইচ ডি স্কলাররাও সার্নের ল্যাবে গিয়ে তাঁদের গবেষণার কাজ করেছেন । সবকিছু মিলিয়ে ভারতের অবদানও এই বিশাল কর্মকাণ্ডে নেহাত ফেলনা নয় ।  

     “হিগ্‌স্‌ বোসনের আবিষ্কারে হয়তো পিটার হিগ্‌স্‌ নোবেল পুরষ্কার পেতে পারে, কিন্তু আমার আর্থিক ক্ষতি হয়ে গেছে ।  আমি একশো ডলারের বাজী হেরে গেলাম” উক্তি বিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-এর ।  কোনও একটি কনফারেন্সে যুক্তরাষ্ট্রের মিচিগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী গর্ডন কেনের কাছে হকিং বাজী ধরেছিলেন যে  হিগ্‌স্‌ বোসন কখনো শনাক্ত করা যাবে না । কিন্তু পিটার হিগ্‌সের ভক্ত গর্ডনের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, বাজী তিনি জিতবেনই ...


ভারতীয় আনবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ড.অনিল কাকোদকার ভারতে নির্মিত নটরাজ মূর্তিটি সার্নের ডিরেক্টর জেনারেল অধ্যাপক রবার্ট এমারকে উপহার হিসেবে দিচ্ছেন ।