পিটার হিগ্স্ |
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন আর সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখরের সঙ্গে
পিটার হিগ্সের এক অদ্ভুত মিল ! এই তিনজন পদার্থবিদ তাঁদের জীবদ্দশায় এমন থিওরির
কথা বলেছিলেন যা বিজ্ঞানের জগতে আলোড়ন জাগায় । আইনস্টাইনের ‘সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ’,
চন্দ্রশেখরের ‘নক্ষত্রের বিবর্তন তত্ত্ব’
আর হিগ্সের ‘গজ বোসনের ভর
তত্ত্ব’- এগুলোর পরীক্ষামূলক প্রমাণ করাটাও বিজ্ঞানীদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল । ১৯১৬ সালে
আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের কথা বললেও ১৯১৯ সালে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ
অধ্যয়ন করার পর তা পরীক্ষামূলক ভাবে প্রমাণিত হয় । এই বিখ্যাত বিজ্ঞানী ১৯২১ সালে
নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন । ভারতীয়-আমেরিকান বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ১৯৩০ সালে
নক্ষত্রের বিবর্তন রহস্যের উপর গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, আর তখন ‘চন্দ্রশেখর লিমিট’
এর ধারণাও সৃষ্টি হয় । একটি নক্ষত্রের মৃত্যু হবার পর সেটি ‘ওয়াইট ডুয়ার্ফ’,
‘নিউট্রন স্টার’ না ‘ব্ল্যাকহোল’ হবে সেটা নির্ভর করে নক্ষত্রের ভরের উপর । ১৯৭১
সালে ‘ব্ল্যাকহোল’ আবিষ্কৃত হলেও চন্দ্রশেখর ১৯৮৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান । উল্লেখ্য যে পিটার হিগ্সের পূর্বসূরি দু’জন
বিখ্যাত বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হলেও তাঁর ভাগ্যে কিন্তু এখনও নোবেলের
শিকে ছিঁড়েনি । তবে ৪ জুলাইর পর বিশ্বের সব দিক থেকেই আওয়াজ উঠছে এই জীবন্ত
কিংবদন্তীকে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করার । কি হবে, সেটা সময় বলবে ।
গত কয়েকমাস ধরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে বিজ্ঞানীদের
আনাগোনায় আসর গরম । সেখানেই বিশাল এক কর্মযজ্ঞ চলছে ‘এল এইচ সি’ (লার্জ হ্যাডরন
কলাইডার) নামক যন্ত্রে । ‘দ্য ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ’
(সার্ন) এর বদান্যতায় তৈরি এটিই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ যন্ত্র ! ফ্রান্স এবং
সুইজারল্যান্ডের সীমানার ২৭ কিলোমিটার পরিধির বৃত্তাকার এক সুরঙ্গের মধ্যেই তার
আবাস । গত ৪ঠা জুলাই-এ সার্নের বিজ্ঞানীরা যখন ঘোষণা করলেন যে অবশেষে পাওয়া গেছে
‘ঈশ্বর কণা’, তখন সারা বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে এক খুশির বাতাবরণ সৃষ্টি হয় । পঁয়তাল্লিশ বছরের সুদীর্ঘ যাত্রাপথ পাড়ি দেওয়ার
ফলশ্রুতিতেই বিজ্ঞানীদের কাছে এই চরম সাফল্য ধরা দিয়েছে ।
লার্জ হ্যাডরন কলাইডার |
প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল যে বিজ্ঞানের জগতের ঈশ্বর কণার সঙ্গে
আধ্যাত্মিক জগতের ঈশ্বরের কোনও সম্পর্ক নেই । এই কণা শনাক্তকরণের সঙ্গে ভগবানের উপস্থিতি গুলিয়ে ফেললে
চলবে না । বিজ্ঞানীদের অভিধানে ‘ঈশ্বর কণা’ বা ‘গড পার্টিকেল’ বলেও কোনও শব্দ নেই
। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘হিগ্স্ বোসন পার্টিকেল’ বা ‘হিগ্স্ বোসন কণা’ । আসলে নোবেল
পদার্থবিজ্ঞানী লীয়ন লেডারম্যান তাঁর ১৯৯৩ এর জনপ্রিয় বই – “The
God Particle: If the Universe Is the Answer, What is the Question?” তে হিগ্স্ বোসন
কণাকে ঈশ্বর কণা বলে উল্লেখ করায় সাধারণ ভাষায় এই নামকরণ স্থান পেয়ে গেছে । কিন্তু
এই বই প্রকাশের অনেক পর নাস্তিক লেডারম্যান স্বীকার করেছিলেন যে তিনি আসলে গড
পার্টিকেলের বদলে ‘গডড্যাম পার্টিকেল’ (Goddamn Particle) প্রস্তাব করেছিলেন, কারণ তাঁর
মতে সেটাই ছিল সবথেকে যুক্তিযুক্ত । কিন্তু প্রকাশক তা মানতে রাজী হননি বইয়ের
কাটতির কথা ভেবে । তবে এটাও ঠিক যে ‘হিগ্স্ বোসন কণা’-কে সাধারণ মানুষের মধ্যে
ছড়িয়ে দেবার প্রয়োজনে ‘ঈশ্বর কণা’ নামকরণেরও দরকার ছিল । যেমন স্টিফেন হকিং তাঁর
বিখ্যাত বই “A Brief history of
time” এর মাধ্যমে বিশ্বতত্ত্বের মত
দুরূহ বিষয়কে চায়ের টেবিলে নিয়ে আসলেন । এই বইটির মাধ্যমেই ‘ব্ল্যাক হোল’ বা
‘কৃষ্ণ গহ্বর’-এর নাম মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে লাগলো । যাই হোক আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা সেই আবিষ্কৃত
কণাকে আর ঈশ্বর কণা বলে অভিহিত করবোনা, বরং তাঁকে ‘হিগ্স্ বোসন কণা’ বলেই
সম্বোধন করবো ।
সত্যেন্দ্র নাথ বসু |
শুরুতেই জেনে নেওয়া যাক হিগ্স্ বোসন কণা
সম্পর্কে । এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির নেপথ্যে রয়েছে নানাবিধ কণার সংমিশ্রণ । যেমন –
ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন । এ ছাড়াও রয়েছে আরও অনেক কণা । একটি মানুষ সৃষ্টির
নেপথ্যেও রয়েছে লক্ষকোটি কণার সমন্বয় । এই কণাদের জগতটাও বড় বিচিত্র আর রহস্যময় !
এর কুহেলি ভরা চরিত্র মোহিত করে রেখেছে গবেষকদের । আসলে এই কণাগুলির চরিত্রের
গভীরেই লুকিয়ে রয়েছে মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্যের চাবিকাঠি । প্রকৃতির সকল
জানা পদার্থ এবং শক্তি যে সব মৌলিক কণা দিয়ে গঠিত তাদের শ্রেণীবিন্যাসের নাম
‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’ । কণা দুই ধরণের হয়ে থাকে – ‘ফার্মিয়ন’ (বিখ্যাত বিজ্ঞানী
এনরিকো ফার্মির নামে) আর ‘বোসন’ (বিখ্যাত ভারতীয় বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্র নাথ বোসের
নামে) । এ যেন কিছুটা শ্রেণী বিভাগের মত । যেমন - আমেরিকার দুইটি
রাজনৈতিক দল হল ‘রিপাবলিকান’ আর ‘ডেমোক্রেটিক’, এর বাইরে কোনও দল নেই । তাই
আমেরিকার জনগণ এই দু’টি দল ছাড়া অন্য দলে যেতে পারেন না । মহাবিশ্বে অজস্র কণা
থাকলেও তাঁদের দু’টি শ্রেণীতে নাম লেখাতে হয় । হয় ‘ফার্মিয়ন’ নতুবা ‘বোসন’ । সব ফার্মিয়নের ভর
বা ‘মাস্’ আছে, আর কিছু বোসনের ভর আছে । স্ট্যান্ডার্ড মডেল দিয়ে কিছুতেই
ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিলোনা এই ভরের উৎপত্তি কিভাবে হয়েছে । অবশেষে ১৯৬৪ সালে
পিটার হিগ্স্ আর তাঁর পাঁচ সমসাময়িক বিজ্ঞানী প্রস্তাব করেন যে এক অদৃশ্য
ক্ষেত্র (বা ‘ফিল্ড’) এই মহাবিশ্বের সর্বত্র বিরাজমান আছে যে নাকি মৌলিক কণাগুলিকে
ভর প্রদান করেছে । এই ক্ষেত্রকে পরবর্তীতে ‘হিগ্স্ ক্ষেত্র’ নাম দেওয়া হয়েছে
। কিন্তু কি দিয়ে এই ক্ষেত্র গঠিত ? বলা হল যে একটা কণা থাকতে হবে যা দিয়ে এই
ক্ষেত্র গঠিত । পরবর্তীতে সেই কণার নাম দেওয়া হল ‘হিগ্স্ বোসন কণা’ যে নাকি
‘বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স্’ মেনে চলে । পিটার হিগ্সের লেখা “ব্রোকেন
সিমেট্রিস এন্ড দ্য মাসেস অব গজ বোসনস্” নামক গবেষণাপত্রটি বিখ্যাত ফিজিক্যাল
রিভিউ লেটারস জার্নালে ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল । মাত্র দেড় পাতায় লেখা গবেষণা
পত্রটি বিজ্ঞানের জগতে এক উল্লেখযোগ্য মার্গ দর্শন ঘটিয়েছিল । তবে ঐ জার্নালের একই
ভলিউমে হিগ্সের সমসাময়িক পাঁচজন বিজ্ঞানী হিগ্স্ বোসন নিয়ে আরও দু’টি পেপার
লিখেছিলেন । তাই তাঁদের অবদানও ভুলবার নয় ।
এবার সাধারণ ভাষায় ‘হিগ্স্ বোসন কণা’ সম্পর্কে জানা যাক । যদিও পদার্থবিদ
ব্যতীত সাধারণ মানুষের পক্ষে ‘হিগ্স্ তত্ত্ব’ বোঝা বেশ মুশকিল । তবুও উপমার
সাহায্যে অনেক বিজ্ঞানীরাই সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপারটা তোলে ধরার চেষ্টা করেছেন
। ধরে নেওয়া যাক শহরের এক অভিজাত হোটেলে উঠতি ক্রিকেটারদের নিয়ে এক পার্টির আয়োজন
করা হয়েছে । সেই পার্টিতে মুখ্য অতিথি সৌরভ গাঙ্গুলি । একজন ক্রীড়া সাংবাদিক
হিসেবে সেই পার্টিতে আমিও নিমন্ত্রিত । তিনি যখনই পার্টিতে হাজির হলেন, তখন তাঁর
চারিদিকে ক্রিকেটাররা জটলা পাকিয়ে এক গোলাকার আবরণ সৃষ্টি করলো । যার ফলে সৌরভের
পক্ষে সামনে এগিয়ে যেতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে । কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছেনা ।
আমি বিনা বাধায় সবদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছি । একজন হালকা ওজনের মানুষের থেকে একজন অধিক
ওজনের মানুষের নড়াচড়ায় কষ্ট হয় । সৌরভের ক্ষেত্রেও তা হয়েছে । আসলে সৌরভের ওজন
তাঁর ভক্তদের জটলা পাকানোর কারণে বেড়ে গেছে । এই উপমাতে হিগ্স্ বোসন কণা হচ্ছে ঐ
উঠতি ক্রিকেটারদের মত, যার কারণে ভরহীন কণা ভর অর্জন করে । যেহেতু আমার জনপ্রিয়তা সৌরভের ধারে কাছেও নেই,
তাই ওর থেকে আমার ভর কম হবে । একইভাবে মৌলিক কণাগুলো হিগ্স্ ক্ষেত্রের সাথে
ক্রিয়া করে সমান ভর লাভ করে না, জনপ্রিয়তার মত সবার ভর এক হয় না । স্বভাবতই সৌরভ হচ্ছেন অধিক ভরের কণা আর আমি
হচ্ছি কম ভরের কণা । আর একটি সুন্দর উপমার প্রসঙ্গ এখানে করবো । ধরে নেওয়া যাক এই
মহাবিশ্ব অদৃশ্য ক্ষীরে পরিপূর্ণ । আমরা এঁকে ‘হিগ্স্ ক্ষীর’ বলে আখ্যায়িত করতে
পারি । প্রকৃতিতে মৌলিক কণাগুলি হল নানা আকারের চামচের মত । কোনটি
বা বড় আর কোনটি ছোট । এখন যদি একটি বড় চামচ হিগ্সের ক্ষীরে ডুবিয়ে নেওয়া যায় তবে
সে বেশী ক্ষীর নিতে পারবে ছোট চামচ থেকে । যত বেশী ক্ষীর তত বেশী ভর । আর চামচটি
যদি ডুবিয়ে নেওয়া না হয় তবে সেটি থাকবে ক্ষীর শূন্য অর্থাৎ ভর শূন্য । ভর যত কম হবে
গতিবেগ তত বেশী । আমরা সবাই জানি যে আলোর গতিবেগ সবথেকে বেশী । আলো বা ‘ফোটন’
যেহেতু একটি কণা, আর তাঁর ভর শূন্য হবার কারণে সে সব কণার থেকে বেশী গতিবেগে ছুটতে
থাকে । মোদ্দা কথায় বলতে গেলে হিগ্স্ বোসন কণার জন্যই প্রকৃতির নানা কণা
(যেমন ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদি) তাদের ভর লাভ করেছে ।
হিগ্স্ কণার কথা ১৯৬৪ সালে বলা হলেও একে শনাক্ত করতে বিজ্ঞানীদের এত বছর
কেন লেগে গেল ? প্রচলিত থিওরি মতে এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমেই এই মহাবিশ্বের জন্ম
হয়েছিল যাকে ‘বিগ ব্যাং’ বলা হয়ে থাকে । বিজ্ঞানীদের ধারণা এই বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ
পর হিগ্স বোসন কণার সৃষ্টি হয় । এই কণা তৈরি হয় অনেক উচ্চ শক্তিতে যা
ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা বেশ মুশকিল । তবে বিজ্ঞানীরা হাল ছাড়েননি । হিগ্স্ বোসন কণাকে ল্যাবরেটরিতে সৃষ্টি করার
জন্য বিজ্ঞানীরা যন্ত্র তৈরিতে মনোনিবেশ করলেন । ‘দ্য ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর
নিউক্লিয়ার রিসার্চ’ (সার্ন) এর নেতৃত্বে তৈরি হল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ যন্ত্র - ‘এল
এইচ সি’ (লার্জ হ্যাডরন কলাইডার) ! সারা বিশ্বের প্রায় দশ হাজার বিজ্ঞানী এবং
ইঞ্জিনিয়ারদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই যন্ত্রটির অবস্থান মাটির তলায় ১৭৫ মিটার
নিচে যা বানাতে খরচ হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি ডলার ! মহাবিশ্বের জন্মরহস্য অনুসন্ধান,
হিগ্স্ বোসন কণার পরীক্ষামূলক অস্তিত্বের সন্ধান, ‘ডার্ক ম্যাটার’ আর ‘ডার্ক
এনার্জি’ এর রহস্য উন্মোচনের পাশাপাশি ‘গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন থিওরি’ তৈরির লক্ষেই
‘এল এইচ সি’ –এর জন্ম । আসলে এই মহাবিশ্বের যাবতীয় বস্তু, গ্যালাক্সি, গ্রহ
নক্ষত্র সব কিছু সৃষ্টির নেপথ্যে রয়েছে এই হিগ্স্ বোসন কণা । তাই এর শনাক্তকরণ
খুব জরুরী হয়ে পড়েছিল ।
বিস্তারিত না বলে এতটুকুই বলা যায় যে ‘এল এইচ
সি’-তে উচ্চ শক্তির একটি প্রোটনের সঙ্গে আর একটি উচ্চ শক্তির প্রোটনের সংঘর্ষ
ঘটিয়েই নূতন কণার সৃষ্টি করা হয়েছিল । ফলাফল হিসেবে এমন একটি কণা পাওয়া গেল যার
শক্তি প্রায় ১২৫ গিগা ইলেকট্রন ভোল্টের (আলোর গতির এককে) কাছাকাছি । বিজ্ঞানীদের
গণনা মতে হিগ্স্ বোসন কণার শক্তিও এমন হওয়ার কথা । এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে
যে প্রকৃতিতে বাকী মৌলিক কণার শক্তি এমন হওয়ার কথা নয় । এই পরীক্ষার জন্য দু’টি
পৃথক বিজ্ঞানীদের দল গঠন করা হয় । একটা দল হল ATLAS (A Toroidal LHC Apparatus), আর অপরটি CMS (Compact Muon Solenoid) । উভয় দল পরীক্ষার
পর একই ফলাফলে উপনীত হন । এখানে উল্লেখ্য যে কোন দলই অন্য দলের কার্য পদ্ধতি
সম্পর্কে জানতেন না । দুটি দলই তৈরি করার সময় নানা দেশের বিজ্ঞানীদের রাখা হয়েছিল
যাতে কোন পক্ষপাত না হয় । ফলাফলের পর সার্নের বিজ্ঞানীরা একমত হন যে ‘হিগ্স্ বোসন
কণা’ সদৃশ এক কণার সন্ধান পাওয়া গেছে । ৪ঠা জুলাই প্রেস কনফারেন্সে সেই সম্ভাবনার
কথাই জনসমক্ষে বলা হয় । “সঠিক কখনো কখনো খুব সুন্দর হয় !” হিগ্স্ বোসন কণা আবিষ্কারের পর এভাবেই
মনের ভাষা ব্যক্ত করেন পিটার হিগ্স্ ।
এবার জেনে নেওয়া যাক এই রাজসূয় যজ্ঞে ভারতের
অবদান কতটুকু । ‘এল এইচ সি’-তে ২০০০ বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রায় ২০০ জন বিজ্ঞানীই
ভারতের । ভারত প্রায় আড়াই কোটি ডলার সাহায্য দিয়েছে সেই মেগা প্রজেক্টে । ‘এল এইচ
সি’-এর ২৭ কিলোমিটার বৃত্তাকার সুরঙ্গে রয়েছে প্রায় ১২৩২ টি ক্রায়ো ম্যাগনেট ।
সেগুলি সূক্ষ্মভাবে ঠিকঠাক জায়গায় বসানোর জন্য যে ‘পজিশনিং সিস্টেম’ এর দরকার তা
ইনডোরের ‘রাজা রামান্না সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড টেকনোলজি’-তে বানানো হয়েছে । ‘সি
এম এস ডিটেক্টর’-এর বিশেষ ‘সেন্সর’ গুলো দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে বানানো হয়েছে ।
উল্লেখ্য যে এই ডিটেক্টর হিগ্স্ বোসন কণা শনাক্তকরণে বিশেষ ভূমিকা নেয় । এছাড়াও
টাটা ইন্সটিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, মুম্বাই; ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ
সেন্টার, ট্রোম্বে; সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, কলকাতা; বেনারস হিন্দু
বিশ্ববিদ্যালয়; জয়পুর বিশ্ববিদ্যালয়; পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদির বিজ্ঞানীরা
‘ফাইবার অপটিক ক্যাবল্স্’ ডেভেলপমেন্টে সার্ন-কে নানা ভাবে সাহায্য করেন । ‘এল
এইচ সি’-এর ভেতরে যে সূক্ষ্ম পরীক্ষা নিরীক্ষা হচ্ছে সেগুলিকে বিশ্লেষণ করার জন্য
উন্নতমানের সফটওয়ার দরকার । ভারতের গবেষকেরা সেই বিশেষ সফটওয়ার বানাতে সার্ন-কে সাহায্য
করেছেন । ভারতীয় মূলের ব্রিটিশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক জিম ভির্ডি আবার ‘সি এম এস
ডিটেক্টর’-এর প্রতিষ্টাতা সদস্য । ভারতের অধ্যাপক অর্চনা শর্মা প্রায় ২৫ বছর ধরে সার্নের ঐ
ল্যাবে কাজ করছেন । সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এর অধ্যাপক বিকাস সিনহা
একটি বিশেষ ‘চিপ’ তৈরি করেন যা ‘এল এইচ সি’ তে সিগনাল প্রসেসিং এ ব্যবহৃত হয় ।
অধ্যাপক বিনোদ চৌহান কে কিছু বিজ্ঞানীদের গ্রুপ লিডার বানানো হয় যাদের কাজ ছিল ‘এল
এইচ সি’-এর ভেতরে সব ম্যাগনেট ঠিকঠাক ভাবে কাজ করছে কি না সেটার উপর নজর রাখা । ভারতের কিছু
বিশ্ববিদ্যালয়ের পি এইচ ডি স্কলাররাও সার্নের ল্যাবে গিয়ে তাঁদের গবেষণার কাজ
করেছেন । সবকিছু মিলিয়ে ভারতের অবদানও এই বিশাল কর্মকাণ্ডে নেহাত ফেলনা নয় ।
“হিগ্স্ বোসনের আবিষ্কারে হয়তো পিটার হিগ্স্
নোবেল পুরষ্কার পেতে পারে, কিন্তু আমার আর্থিক ক্ষতি হয়ে গেছে । আমি একশো ডলারের বাজী হেরে গেলাম” । উক্তি বিখ্যাত
ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-এর । কোনও
একটি কনফারেন্সে যুক্তরাষ্ট্রের মিচিগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী গর্ডন কেনের
কাছে হকিং বাজী ধরেছিলেন যে হিগ্স্ বোসন
কখনো শনাক্ত করা যাবে না । কিন্তু পিটার হিগ্সের ভক্ত গর্ডনের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল,
বাজী তিনি জিতবেনই ... ।
ভারতীয় আনবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ড.অনিল কাকোদকার ভারতে নির্মিত নটরাজ মূর্তিটি সার্নের ডিরেক্টর জেনারেল অধ্যাপক রবার্ট এমারকে উপহার হিসেবে দিচ্ছেন । |
No comments:
Post a Comment