Wednesday, January 25, 2012

পৃথিবীতে আছড়ে পড়লো বৃহৎ সৌরঝড়




সূর্যের এই আজব ব্যামো হলেই চঞ্চল হয়ে ওঠে পৃথিবী । কারণ সূর্যের এই সাময়িক রোগ হলে  পৃথিবীকে যে নানা অশান্তির সম্মুখীন হতে হয় ! তাঁর এই ব্যাধি নিয়ে আবার চিন্তিত ধরিত্রীর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও আসলে সূর্য বাবাজির হাঁচির এক ব্যামো আছে যা কিছু বছর পর পর ঘুরে ফিরে আসে । গত ২৩ জানুয়ারি ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে নয়টায় তাঁর এক বিকট হাঁচি অশান্তির ঝড় তুললো পৃথিবীতে ।
পৃথিবীর সবথেকে কাছের নক্ষত্র সূর্য আমাদের সব শক্তির উৎস । সূর্যের অন্দরে পরমাণুর প্রতিনিয়ত বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে অফুরন্ত শক্তি । প্রায় পনেরো কোটি কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে বিকিরণের মাধ্যমে মাত্র ৮.৩ মিনিটে সূর্য থেকে সেই ভাণ্ডার পৃথিবীতে চলে আসে । পাশাপাশি ক্ষতিকারক রশ্মিও পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এসে পৌছায়, কিন্তু ওজোনস্তরের উপস্থিতির জন্য সেগুলো পৃথিবীতে পৌছাতে পারেনা । এ ছাড়া পৃথিবীর নিজস্ব চৌম্বকক্ষেত্রও এক্ষেত্রে বর্মের মত কাজ করে । তাই সভ্যতার শুরুয়াত থেকেই জীবজগত সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে সুরক্ষিত আছে । কিন্তু কখনো কখনো সূর্যের সরবরাহকৃত শক্তির যোগান হঠাৎ বেড়ে যায়, আর তখনই হয় বিপত্তি । বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ‘সৌরঝড়’ তবে এই ঝড় একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর হয় ।
     সূর্যের উপর নজরদারি করার জন্য মহাকাশ বিজ্ঞানীরা নানা কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে প্রেরণ করেছেন । সেই মহাকাশযানগুলো থেকে পাঠানো তথ্য সমৃদ্ধ করেছে সৌরবিজ্ঞানকে । সৌরজগতের সবথেকে কাছের নক্ষত্র হল-প্রক্সিমা সেন্টরাইসূর্য থেকে এর গড় দূরত্ব হল প্রায় ৪.২ আলোকবর্ষ (এক আলোকবর্ষ = ৯৫০০০০ কোটি কিলোমিটার)এত দূরত্বে তার এই অবস্থানের জন্য পৃথিবী থেকে শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেও তাকে বৃহদাকারে দেখা সম্ভব হয় না । তাই আমাদের সবথেকে কাছের তারা সূর্যের জন্মবৃত্তান্ত অধ্যয়ন করলেই জানা যাবে দূরবর্তী নক্ষত্র সম্বন্ধে নানা অজানা তথ্য । দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় তার গাত্রে নানা দাগ । যাকে সৌরকলঙ্ক (‘সানস্পট’) বলা হয় । গ্যালিলিও সর্বপ্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্রের দ্বারা এই দাগ দেখতে পান । এই দাগের সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট সময় পর বেড়ে যায় আর এর সময়কাল হচ্ছে এগারো বছর ! ২০০১ সালে সৌরকলঙ্কের উপস্থিতি  সবথেকে বেশী ছিল । আর তাই এই বছর স্বাভাবিক ভাবেই সৌর দাগের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান । মজার ব্যাপার হল  সেই সময় সূর্যের চঞ্চলতাও বেড়ে যায় যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে পৃথিবীতে ।      
নাসার বিজ্ঞানীরা গত ২৩ জানুয়ারি সূর্যের আকস্মিক বিস্ফোরণ ‘সোলার ডাইনামিকস অবজারভেটরি স্পেস ক্রাফট’-এ বিদ্যমান উচ্চ প্রযুক্তির ক্যামেরার সাহায্যে ভিডিও রেকর্ড করেছেন । বিজ্ঞানের ভাষায় এই বিস্ফোরণকে ‘করন্যাল মাস ইজেকশন’ বলা হয় । এই ইজেকশন হলে সূর্য থেকে আগত বিকিরণের মাত্রাও তখন বেড়ে যায় । এ যেন সূর্যের হাঁচি দেওয়ার মত ঘটনা । আর সূর্যের এই হাঁচিতে সৃষ্টি হয় ‘সৌরঝড়’ আগামী বুধবার পর্যন্ত এই ঝড়ের প্রকোপ থাকবে । এখানে উল্লেখ্য যে সৌর বিকিরণ ঝড়ের ফলে মূলত: সূর্য থেকে উচ্চ শক্তির প্রোটন কণা নির্গত হয় । ‘এই ঝড়ের প্রকোপ ২০০৫ সালের মে মাসে হওয়া করন্যাল মাস ইজেকশন থেকেও অনেক বেশী’ – বলেছেন নাসার বিজ্ঞানি ডঃ ডউগ বিসেকার সূর্যের আবহমণ্ডল অধ্যয়ন করার জন্য ১২টি কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবী থেকে প্রেরণ করা হয়েছে যারা প্রতিনিয়ত সূর্যের উপর নজরদারি রাখছে ।
     সৌরঝড়ের আবির্ভাবে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয় । আমাদের বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগে যেসব ‘কমুনিকেশন স্যাটেলাইট’ রয়েছে সেগুলোর উপর সব থেকে বেশী প্রভাব পড়ে । সূর্য থেকে আসা উচ্চশক্তির কণার আঘাতে ঐ স্যাটেলাইট গুলোর নানা যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে যায়,  যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থায়মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত টিভি চ্যানেল, বিমান পরিষেবা, ব্যাংকিং পরিষেবা ইত্যাদি মারাত্মক ভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয় ।  বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়ে । ২০০৫ সালের মে মাসেও তেমন সৌরঝড়ের ঘটনা ঘটেছিল । এছাড়া রয়েছে ক্ষতিকারক রশ্মির পৃথিবীতে ঢুকে পড়ার আশঙ্কা । আসলে বায়ুমণ্ডলে ওজোনস্তরের উপস্থিতির জন্য অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে পৌছাতে পারেনা । কিন্তু পরিবেশ প্রদূষণের ফলে ওজোনস্তরে দেখা দিয়েছে ফুটো, আর এ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন বিজ্ঞানীরা । এই অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে এসে পৌঁছালে মানবদেহে নানারকম চর্মরোগ দেখা দেবে । এমনকি স্কিন ক্যান্সারও হতে পারে । এছাড়া আরও নানারকম সর্বনাশা রোগের জন্ম হবারও সম্ভাবনা রয়েছে । সূর্যের সুনামির জন্য তাই পৃথিবী বাসির আতঙ্কিত হওয়া স্বাভাবিক ।     
     সৌরঝড় একটি প্রাকৃতিক ঘটনা । একে নিয়ন্ত্রিত করার ক্ষমতা বিজ্ঞানেরও নেই ! কিন্তু পৃথিবীর পরিবেশকে নিয়ন্ত্রিত করার ক্ষমতা আমাদের আছে । ওজোনস্তরের প্রলেপকে রক্ষা করার দায়িত্বও তাই পৃথিবী বাসির । কিন্তু এনিয়ে ভাবার সময় কি আমাদের আছে?

No comments:

Post a Comment