মিলনের চিত্রনাট্য ২০০৭-এই লেখা হয়ে গিয়েছিল । ২০১১ এর ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ তেই অভিনব সাক্ষাৎ হতে যাচ্ছে দু’জনের । প্রেমিকের বাড়ি পৃথিবীতে হলেও তার প্রেয়সী রয়েছেন মহাশূন্যে । ঈপ্সিত লক্ষ্যে যাত্রা শুরু হওয়ার সুদীর্ঘকাল পর আজ রাত্রি আটটা সাইত্রিশে (প্যাসিফিক স্ট্যান্ডার্ড টাইম মতে) আসছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন প্রেমিকবর খুব কাছাকাছি হতে পারবেন তার প্রেমিকার । আর তারপরই তাদের প্রেম কাহিনী ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেবে ।
কে বলে বিজ্ঞানীরা প্রেমের ব্যাপারে নিরস ? না হলে কি এমন দিন বেছে নিতেন মিলনের জন্য ? প্রেমিকের পরিচয় ? মানবসৃষ্ট এক অত্যাধুনিক মহাকাশযান ! আর প্রেয়সী ? ধূমকেতু - রাতের আকাশে যার মনমাতানো রূপ দেখে সম্মোহিত হয়ে যেতে হয় ! নাসার বিজ্ঞানীরা নির্ভুল অঙ্ক কষে ‘ষ্টারডাস্ট নেক্সট’ মহাকাশযানটি প্রেরণ করেছেন ‘টেম্পল-১’ নামক ধূমকেতুর দিকে যেটি আজ মাত্র দু’শো কিলোমিটার কাছাকাছি চলে আসবে । তারপর আকুল ভরে সে তার প্রেমিকাকে উচ্চপ্রযুক্তির ক্যামেরা দিয়ে দেখবে, আর ফটো তুলে পৃথিবীতে প্রেরণ করতে থাকবে । লাজুক প্রেমিকার অবশ্য এই ফটো সেশনে আপত্তি নেই ! কারণ তাকে নিয়ে আগ্রহের কারণ যে বিজ্ঞানীদের অনেকদিনের পুরানো সেটা সে ভালই জানে ।
রাতের আকাশে ধূমকেতুর আকস্মিক আগমন যুগযুগান্তর ধরে মোহিত করে রেখেছে পৃথিবী-বাসিদের । সূর্যের অমোঘ আকর্ষণে লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এই পরিযায়ী মহাজাগতিক বস্তু হাজির হয় সৌরজগতে । পৃথিবীর পাশ দিয়ে হাসতে হাসতে হাত নেড়ে যাবার সময় সে দৃশ্যমান হয় এই গ্রহ থেকে । মায়াময় জগৎ থেকে সৌরজগতে ধূমকেতুর আগমনকে নাটকীয় ছাড়া আর কী বলা যায় ! কিছু বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন পৃথিবীতে প্রাণের বীজ বপন করেছিল ধূমকেতু । অতীত কালে পৃথিবীর খুব নিকট দিয়ে এক ধূমকেতু যাবার সময় পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের ফলে সে প্রাণহীন গ্রহটিতে আছড়ে পড়ে । আর তারপরই অনুঘটকের মত প্রাণের প্রাথমিক বীজ সে বপন করে । সৃষ্টি হয় অ্যামিনো এসিড যা প্রাণের জন্য একান্ত আবশ্যক । এককোষী প্রাণী সৃষ্টির মাধ্যমেই বিবর্তনের পথ শুরু হয়, আর তারপর কেটে গেছে কয়েক লক্ষ বছর । মানব সভ্যতা উন্নত হয়েছে আর এখন এই কয়েক ফুট উচ্চতার এক প্রাণীর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে একটি প্রশ্নই – প্রাণ সৃষ্টির নেপথ্য কারণ কি ?
ধূমকেতু হল একটি মহাজাগতিক বস্তু যার নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ ১ থেকে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে । মূলতঃ বরফ, পাথর আর অরগ্যানিক পদার্থ দিয়েই তৈরী সে । ধূমকেতুর বিশেষত্ব হল সূর্যের নিকটে আসলেই তার দুটি লেজ গজায় । একটিকে বলা হয় ‘আয়ন টেল’ আর অপরটিকে ‘ডাস্ট টেল’ । লেজগুলো সবসময় সূর্যের বিপরীতে থাকে । আবার যখন সে সূর্যের আকর্ষণ থেকে দূরে চলে যায় তখন লেজও গায়েব ! ধূমকেতু সূর্যের সামনে আসলে তার আকার বাড়তে থাকে, তখন সে বেলুনের মত ফুলতে থাকে যাকে ‘কোমা’ বলা হয়ে থাকে । সাধারণতঃ কোমার আকার দশহাজার থেকে এক লক্ষ কিলোমিটার হয় । তবে কোমার এই আকার হলেও ধূমকেতুর ঘনত্ব এত কম হয় যে তাকে কখনো বলা হয় “বস্তা বোঝাই শূণ্যতা” । মূলতঃ গ্যাস, ধূলিকণার সমন্বয়ে তৈরি এই কোমার ক্লাউড ।
গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে ধূমকেতুর আর আমাদের সৌরজগতের বয়স প্রায় সমান – ৪৫ কোটি বছর । বিজ্ঞানীরা এই ব্যাপারটা ভালই বুঝতে পেরেছেন যে ধূমকেতু অধ্যয়ন করলে সৌরজগতের সৃষ্টি রহস্য উদঘাটন করার পাশাপাশি পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির কারণও জানা যাবে । তাই ১৯৮৬ সালে হ্যালির ধূমকেতু যখন পৃথিবীর খুব কাছে এসেছিল, তখন পৃথিবী থেকে পাঁচটি মহাকাশযান ধূমকেতুটির খুব কাছে গিয়ে নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করে । সম্প্রতি নাসার ‘স্টারডাস্ট মিশন’ এর উদ্দেশ্য ছিল ‘ওয়াইল্ড -২’ নামক ধূমকেতুর স্যাম্পল সংগ্রহ করে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেওয়া । ২০০৪ সালে সে লক্ষ্য সফল হয়, আর ধূমকেতু থেকে সংগৃহীত স্যাম্পল ২০০৬ সালে স্টারডাস্ট মহাকাশযান থেকে ক্যাপসুলের মাধ্যমে পৃথিবীতে পাঠানো হয় যা পরবর্তীতে ল্যাবরেটরিতে বিশ্লেষণ করা হয় । এই সাফল্যে খুশি হয়ে নাসার বিজ্ঞানীরা পরবর্তী মিশনের রূপরেখা তৈরি করলেন যার নাম - ‘ষ্টারডাস্ট নেক্সট মিশন’ । মহাকাশযানটির নুতন লক্ষ্য স্থির হল ‘টেম্পল-১’ ধূমকেতু । পৃথিবীতে ফিরে আসা তার হলনা, যানটিকে ২০০৭ সালেই ঘুরিয়ে দেওয়া হল তার নূতন বান্ধবীর দিকে । ধূমকেতুটির ব্যাস প্রায় ছয় কিলোমিটার, আর সূর্যের চারিপাশে প্রদক্ষিণ করতে তার সময় লাগে সাড়ে পাঁচ বছর । অবশ্য এই ধূমকেতুটিকে নাসার অপর একটি মিশন ‘ডিপ ইম্প্যাক্ট’ ও ২০০৫ সালে অধ্যয়ন করে । নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসে সেই মিশন থেকে । তবুও কিছু অপূর্ণতা থেকে যায় । আর সেটা পূরণ করতেই নাসার এই নূতন মিশন । প্যাসিফিক স্ট্যান্ডার্ড টাইম মতে ১৪ ফেব্রুয়ারি রাত আটটা সাইত্রিশে (ভারতীয় সময় মতে ১৫ ফেব্রুয়ারি সকাল দশটা সাতে) মহাকাশযানটি ‘টেম্পল–১’ ধূমকেতুটির প্রায় দু’শো কিলোমিটার নিকটে চলে আসবে । আর তারপরেই তাদের মিলনে রচিত হবে বিজ্ঞানের এক নূতন ইতিহাস ।
অবশেষে কিশোর আর আশার একটি কালজয়ী গান গুনগুন না করলে লেখাটা অসমাপ্তই থেকে যাবে –
‘এক ম্যায় অউর এক তু, দোনো মিলে ইস তরাহ ...’ ।
No comments:
Post a Comment