রামেন্দু
স্যারকে নিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি লিখতে হবে সেটা কোনও দিন ভাবিনি। স্যারের অগণিত ছাত্রের
মতই আমিও শোকে মুহ্যমান। অকালে নক্ষত্র পতনে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শূণ্যতার সৃষ্টি
হয়েছে তা কিভাবে কাটিয়ে উঠবো তাই ভাবছি প্রতি মুহূর্তে।
শৈল শহর শিলং থেকে স্যারের শিলচর শহরে আগমন
সেই ১৯৯৭ সালে। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিভাগে রিডার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে
বরাক উপত্যকায় স্যারের কর্মজীবন শুরু। এর আগে তিনি শিলং এর স্যান্ট অ্যাডমন্ডস্
কলেজে অধ্যাপনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিভাগের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র ছিলাম
আমরা। আজও মনে আছে- স্যার প্রথম দিন ওনার ক্লাসে এসে 'তুই' বলে আমাকে সম্বোধন
করেছিলেন। প্রথম সাক্ষাতেই সবাইকে আপন করে নেবার এক অসাধারণ ক্ষমতা স্যারের ছিল।
রামেন্দু স্যারের সঙ্গে জীবনে যারা একবার কথা বলেছে তাকে কোনও দিন সে ভুলতে পারবে
না,
এমন ভাবেই মনে দাগ কাটতেন তিনি।
শিলং এর নর্থ ইস্টার্ন হিল ইউনিভার্সিটি
(নেহু) থেকে স্যারের পি এইচ ডি ১৯৮৬ সালে। মূলত: ইনফ্রা রেড আর রমণ এফেক্টের
ব্যবহারিক দিক নিয়েই তিনি গবেষণা করেন। তার গবেষণাপত্র দেশ বিদেশের বিখ্যাত
সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে গবেষণার
জন্য আই আই টি কানপুর এবং ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স, বেঙ্গালোর-এ যান। ১৯৯০
সালে তিনি মর্যাদাপূর্ণ 'ইনসা-জে এস পি এস' ফেলোশিপের জন্য মনোনীত হন, আর প্রযুক্তির তীর্থক্ষেত্র জাপানে যান। সেখানে ছয়মাস গবেষণা করে ভারতে ফিরে
আসেন। স্যারের কাজের মান দেখে বিখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক সি এন আর রাও এতই মুগ্ধ
হয়েছিলেন যে তিনি রামেন্দু স্যারকে নিজের ল্যাবরেটরিতে নিয়ে আসেন। সেই ল্যাবরেটরি
থেকেই সি এন আর রাওয়ের সঙ্গে তিনটি গবেষণাপত্র পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়। ২০১৩ সালে
অধ্যাপক সি এন আর রাও ভারত রত্ন পাবার পর স্যারের কি আনন্দ! সবাইকে গর্বের সঙ্গে
অধ্যাপক রাওয়ের কথা বলতেন আর নানা ঘটনার স্মৃতিচারণ করতেন।
২০০৭ সালে পদার্থ বিভাগে আমার শিক্ষকতা
শুরু। সেই সুবাদে স্যারকে আরও কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। স্যার সগর্বে
সর্বত্র বলতেন যে তাঁর ছাত্র একই বিভাগে অধ্যাপনা করছে এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কি
হতে পারে। কোনও শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেড়ে চলে যাবার সময় স্যারের খুব কষ্ট হত।
বলতেন,
তিল তিল করে গড়া এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে কখনো চলে যাবি না।
এই অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদেরকেই আগামীতে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব
নিতে হবে।
ভাল শিক্ষক আর গবেষকের পাশাপাশি স্যার একজন
ভাল সুশাসকও ছিলেন। স্যারের বৈচিত্র্য ভরা জীবনে খুব স্বল্প সময়ে ডিন স্টুডেন্টস
ওয়েলফেয়ার, প্রোক্টর, স্কুল অব টেকনোলজির ডিন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিফু ক্যাম্পাসের প্রো ভাইস চ্যান্সেলর আর অবশেষে শিলচর
ক্যাম্পাসের প্রো ভাইস চ্যান্সেলর-এর পদ অলঙ্কৃত করেন। প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর হয়ে
ডিফু ক্যাম্পাসে তিনি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন। সমস্যায় জর্জরিত সেই ক্যাম্পাসে
তিনি শৈক্ষিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনেন। পরবর্তীতে তিনি শিলচর ক্যাম্পাসে ফিরে আসেন
প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে। প্রতিটি পদেই ছিলেন তিনি সমান উজ্জ্বল। নানা
সমস্যাকে ম্যাজিক এর মত ভেনিশ করে দেবার এক সহজাত স্বভাব নিয়েই তিনি জন্মেছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনকে নানা সময়ে তিনি প্রতিহত করেন বিচার আর বুদ্ধির
সংমিশ্রণ ঘটিয়ে। তাঁর ফর্মুলা ছিল, ছাত্রদের সমস্যা শুনে যতদূর সম্ভব এর সমাধান করা। এতে উচ্চতর কর্তৃপক্ষের
সঙ্গে বাদানুবাদেও তিনি পেছোতেন না। ছাত্রদের পাশেই ছিলেন তিনি আজীবন। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও আন্দোলনের ঝড় উঠলেই এগিয়ে
যেতেন তিনি। সেই ঝড় স্যারের সামনে এলেই স্তিমিত হয়ে যেত। কি যে জাদুকাঠি ছিল তাঁর
কাছে ! তিনি ছিলেন মুশকিল আসানের মন্ত্র। এত বড় পদে গিয়েও স্যার ছিলেন খুব সাধারণ।
সাবলীল ভাবে সবার সঙ্গে মিশতেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, অশিক্ষক আর শিক্ষক সম্প্রদায়ের সবার কাছে রামেন্দু স্যার
সমান জনপ্রিয়। জীবন নিয়ে কৌতুক করতেন, আর বলতেন তাঁর জীবন এক খোলা বই। কৌতুক ভরা কথা দিয়ে সবার মন জয় করে নিতেন।
কর্মরত অবস্থাতেই তিনি গত ৩১ জানুয়ারি রাত আড়াইটায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন
করেন,
আর রেখে যান সবার জন্য হাজারো স্মৃতি।
স্যারের নেশা ছিল কবিতা লেখার। কবিতা লিখেই
ফোন করতেন প্রিয়জনদের, আর শোনাতেন কবিতা।
তাঁর চারটি কবিতার বইও প্রকাশিত হয়েছে। নিজেকে কবি বলে পরিচয় দিতে খুব ভালবাসতেন। স্যারের স্বহস্তে লিখিত এক কবিতা
আমার অফিসের রিডিং রুমের টেবিলের কাচের নীচে সেই ২০০৯ সাল থেকেই সযত্নে রাখা আছে।
সেই কবিতাটি এখানে তুলে দিলাম। এই কবিতার ভাব আজও যে কতটা সত্যি।
কে
বলে ও'রা
অতীতের কথা বলে?
না
অতীত
কথা বলে-
ও'দের
মুখে।
(যুগশঙ্খ পত্রিকায় প্রকাশিত - ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)