Wednesday, July 27, 2011

‘হ্যাকিং’ – ছায়া-যুদ্ধের এক নুতন নাম




থ্যাঙ্ক্‌ ইউ এন্ড গুডবাই
অপ্রত্যাশিত শব্দাঘাত ! ১০শে জুলাইর ঝলমলে সকালে এক সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের প্রচ্ছদের কিছু শব্দ হৃদয় কাঁপিয়ে তুলল ব্রিটেনের ২৬ লক্ষ পাঠকদের । তাদের প্রিয় পত্রিকা নিউজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড আর আগামীতে প্রকাশিত হবেনা ।
বয়স ? ১৬৮ বছর ! 
সেই ১ অক্টোবর ১৮৪৩ সাল থেকে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল । সুদীর্ঘ ১৬৮ বছরে  ব্রিটেনের নানা চমকপ্রদ তথ্য ছাড়াও সেখানের সেলিব্রেটি, রাজপরিবারের নানা কেচ্ছা কাহিনীর সাতকাহন বর্ণনা করে সে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে গিয়েছিল । বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাঠক-সমৃদ্ধ ইংরেজি পত্রিকাটির হঠাৎ এই ছন্দপতন তাই অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না । পত্রিকাটিকে পাঠক সমাজের কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য পত্রিকাগোষ্টী সেলিব্রেটিদের ফোনে আড়িপাতার মত অসদুপায় অবলম্বন করে । সম্প্রতি পত্রিকাগোষ্টীর বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে গুরুতর অভিযোগ প্রমাণ সহ নিয়ে আসা হয় । তাই এত জনপ্রিয়তার মধ্যেও পত্রিকাটিকে অবশেষে অবসরের পথে যেতে হয়েছে । ফোন হ্যাকিং কেলেঙ্কারির অভিযোগ নিয়ে সারা ব্রিটেন এখন তোলপাড় !  হয়ে গেছে নানা নাটক !
নাটকের নেপথ্যে রয়েছে হ্যাকিং এর কালো ছায়া । যার বিষাক্ত নিঃশ্বাসে সারা বিশ্বে ছায়া-যুদ্ধের আবহ তৈরি হয়ে গেছে । আজ কোন দেশই এর আওতা থেকে মুক্ত নয় । নুতন এই দৈত্যের বাড়বাড়ন্ত ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে ।  আসলে বর্তমান দুনিয়ায় চোরের চুরি করার ধরণও বদলেছে । তথ্য প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে চুরি করাকেই সোজাসাপটা ভাষায় হ্যাকিং বলা হয় । আর এই কর্মের সঙ্গে যারা যুক্ত থাকেন তাদের বলা হয় হ্যাকার।এই হ্যাকিং আবার জন্ম দিয়েছে সাইবার টেরোরিস্‌ম্‌কে । হাজার ক্রোশ দূরে থেকেও আক্রমণ করবার নুতন এই পদ্ধতি কালো জগতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের কাছে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে । হ্যাকিংয়ের সাধনায় মত্ত কিছু দুষ্ট ব্যক্তির মদমত্ততায় কেঁপে উঠেছে বিশ্ব ।  


 
প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য হ্যাকিংকে ব্যবহার করা হত । কোন ব্যক্তির অজান্তে তার বিস্তারিত তথ্য জেনে হ্যাকাররা তাকে নানাভাবে উত্যক্ত করার পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হবার চেষ্টা করতো । ঠিক সেই ভাবে নিউজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড এর সাংবাদিকেরা ফোন হ্যাকিং এর সাহায্যে সেলিব্রেটিদের ফোনে আড়ি পেতে জম্পেশ রিপোর্ট পরিবেশন করে পত্রিকাটিকে জনপ্রিয় করার মত অপরাধ করেছে । কিছু পুলিশ কর্মীর পরোক্ষ মদতে পত্রিকাগোষ্টী অনেকদিন ধরেই এই হ্যাকিং চালিয়ে যাচ্ছিল । অবশেষে সরকারের তরফ থেকে কঠিন অবস্থান নেওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে । বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে তথ্য চুরির অভিযোগ বাড়ছে । মূলত: আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোই সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয় । কখনো ব্যক্তিগত উদ্যোগে আর কখনো সমষ্টিগতভাবে নানা ওয়েবসাইট আক্রমণ করা হয় । কারণ ? ধ্বংসের ম্যাপ তৈরি করা ।
     মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার ঠাণ্ডা যুদ্ধের ছায়া যেন আবার ফিরে এসেছে । এবার আর সম্মুখ সমরে যুদ্ধ নয়, ইন্টারনেটের বিশাল সাম্রাজ্য সাইবার জগতে শুরু হয়েছে ঠাণ্ডা লড়াই । হ্যাকিংয়ের আঘাতে বিশ্বের জর্জরিত দেশগুলি মুক্তিলাভের উপায় খুঁজছে । আসলে হ্যাকিং এখন শুধু আর আতঙ্কবাদীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে এখন নানা রাষ্ট্রপ্রধানদের অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছে । হ্যাকিংকে হাতিয়ার করে এক অঘোষিত যুদ্ধও ঘোষণা হয়ে গেছে । কিছু কিছু দেশের বিরুদ্ধে তাই উঠেছে ইন্টারনেটে তথ্য চুরির অভিযোগ ।
     সম্প্রতি হ্যাকিং নিয়ে চীন-মার্কিন সম্পর্ক উত্তপ্ত হয়েছে । সাইবার জগতের সর্ববৃহৎ সার্চ ইঞ্জিন গুগল চীনের বিরুদ্ধে তথ্য চুরির অভিযোগ নিয়ে এসেছে । বিশ্বের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গুগলের ই-মেল সার্ভিস জি মেল-এর ব্যবহারকারীরা । এই বৃহৎ মার্কিন কোম্পানির অভিযোগ চীনে তাদের ই-মেল সার্ভিসের কয়েক হাজার গ্রাহক  হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছাড়াও রয়েছেন সরকারি, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা এবং সাংবাদিক মহল । অবশ্য চীন বরাবরের মতই হ্যাকিং নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন বলেছে । মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফ বি আই এরই মধ্যে অনুসন্ধানে নেমে পড়েছে । চীনা হ্যাকিংয়ের রেশ মিটতে না মিটতেই আবার হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । সেখানের প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন-এ ভয়াবহ সাইবার আক্রমণ চালানো হয়েছে । পেন্টাগনের কম্পিউটার থেকে প্রায় চব্বিশ হাজার নথি চুরি হয়ে গেছে । অনেক স্পর্শকাতর তথ্যও হ্যাকাররা গায়েব করে দিয়েছে । মার্কিন উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী উইলিয়াম লিন এই ঘটনাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ সাইবার হামলা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন । 


     ভারতেও ওয়েবসাইট শিকারের নানা ঘটনা সামনে এসেছে । মূলত: পাকিস্তান আর চীনের হ্যাকারদের তরফ থেকেই আক্রমণের খবর সবচেয়ে বেশী। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা সি বি আই-এর ওয়েবসাইটকে হ্যাকিং করে রীতিমত হইচই ফেলে দিয়েছিল হ্যাকাররা । এছাড়া নানা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটও হ্যাকারদের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । অনেক গ্রাহকের অনলাইন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকেও টাকা হাপিশ হয়ে যাবার নজিরও রয়েছে । ভারতের তরফ থেকে ওয়েবসাইটকে সুরক্ষা করার জন্য নানা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে । কিন্তু হ্যাকাররাও নিত্যনুতন কৌশল উদ্ভাবন করে ওয়েবসাইটের সিকিউরিটিকে বিধ্বস্ত করার কাজ করেই যাচ্ছে ।  
     মজার একটি ঘটনা বলেই ইতি টানবো নিবন্ধের ।  গত মাসে লুলজ সিকিউরিটি নামে একটি হ্যাকার গ্রুপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ, বহুজাতিক কোম্পানি সোনি, ব্রিটিশ পুলিশের ওয়েবসাইট ইত্যাদি হ্যাকিং করে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে । তাদের আক্রমণে বিশ্বের বৃহৎ বৃহৎ কোম্পানি আর সরকারি ওয়েবসাইটগুলো মুখ থবড়ে পড়ে । সাইবার জগতে রীতিমত চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পরিকল্পিত পঞ্চাশ দিনব্যাপী হ্যাকিংয়ের পর তারা অভিযানের সমাপ্তি টেনেছে ।  এখনো লুলজের বিস্তারিত খবর তেমনভাবে জানা যায়নি ।  তবে ধারণা করা হচ্ছে লুলজ বেনামি হ্যাকারদের একটি দল ।
     হ্যাকারদের প্রতিরোধের জন্য ইতিমধ্যে নানা দেশে গড়ে উঠেছে অ্যান্টি-হ্যাকারদের দল । যারা রীতিমত লড়াই করছে সাইবার জগতে । তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হয়তো হ্যাকারদের নির্মূল করা সম্ভব হবে । ওয়েবসাইটের সুরক্ষা আরো মজবুত হচ্ছে । সাইবার অপরাধে নানা আইনও বলবত হচ্ছে দেশে দেশে । সেদিন বোধহয় আর দূরে নেই যখন হ্যাকিংয়ের অন্তর্জলী যাত্রা হবে । তখন অ্যান্টি-হ্যাকারদের অবশ্যই বলবো  থ্যাঙ্ক্‌ ইউ আর হ্যাকারদের - গুডবাই

No comments:

Post a Comment