Tuesday, August 7, 2012

প্রাণের খোঁজে ‘কিউরিওসিটি রোভার’র মঙ্গল গ্রহে অবতরণ



কিমাশ্চর্যম ! ‘কৌতূহল’কে নিয়ে কৌতূহল ! আর সেটা কিনা প্রশমিত হল এক ট্যুইট বার্তায়‘আমি মঙ্গল পৃষ্ঠের উপর নিরাপদে আছি । ‘গেইল ক্র্যাটার’ আমি আপনার মধ্যে আছি’
সোমবারের সবথেকে হিট ‘ট্যুইট’কে নিয়ে সারা বিশ্বে শোরগোল শুরু হয়েছে । ‘কিউরিওসিটি রোভার’ মঙ্গলগ্রহে অবতরণ করার পরই ঘটে ঘটনাটি । ট্যুইটারে কিউরিওসিটির নিজস্ব অ্যাকাউন্ট থেকে উপরোক্ত বার্তাটি প্রেরণ করার পর সাইবার জগতে আলোড়ন সৃস্টি হয় অলিম্পিকের আপডেটসের খবরও যারা রাখছিলেন তাঁরাও কিছুক্ষণ পর পর নাসার সাইটটিতে চোখ রাখছিলেন । অলিম্পিক জ্বরে কাবু জনসাধারণের মধ্যে হাইটেক প্রযুক্তিতে তৈরি এই রোবটটির অবতরণের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার যে হাইটেক মুনশিয়ানা ‘নাসা’-র বিজ্ঞানীরা করিয়ে দেখিয়েছেন তা এককথায় অনবদ্য । সোমবার ভারতীয় সময় সকাল এগারোটা দুই-এ কিউরিওসিটি মঙ্গলে অবতরণ করার পরই ইতিহাস রচিত হয়ে যায়    পারমানবিক শক্তিতে চালিত এই রোবটটিই হচ্ছে নাসার প্রথম হাইটেক মিশন ।
পৃথিবীর পাশের গ্রহ মঙ্গলকে নিয়ে আমাদের কৌতূহলের অন্ত নেই । সেই প্রাচীন কাল থেকেই ‘লাল গ্রহ’ তাঁর রূপ আর রহস্য ভরা চরিত্র নিয়ে আমাদের মোহিত করে রেখেছে । বিজ্ঞানী থেকে লেখক সবাই মজে গিয়েছিলেন মঙ্গলের প্রেমে । ১৮৯৮ সালে এইচ জি ওয়েলস নামক কল্পবিজ্ঞানের এক বিখ্যাত লেখক যখন তাঁর ‘দ্য ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস’ উপন্যাসটি প্রকাশিত করলেন, তখন মঙ্গল গ্রহ নিয়ে এক নূতন আতঙ্কের সৃষ্টি হল । সেই উপন্যাসের বিষয়বস্তু ছিল সত্যিই লোমহর্ষক । কাহিনীতে উল্লেখ আছে মঙ্গল গ্রহ থেকে একদল কদাকার শুঁড়ওলা ভয়ঙ্কর প্রাণী পৃথিবীতে নেমে এসে ধ্বংস কার্য শুরু করেছে । মানুষ কিছুতেই মোকাবিলা করতে পারছেনা তাদের শক্তিমত্তা আর রণ চাতুর্যের সঙ্গে । শেষ পর্যন্ত নানা সঙ্কটের মধ্য দিয়ে নানা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গল গ্রহের প্রাণীরা ধ্বংস হল । অবশেষে রক্ষা পেল মনুষ্যজাতি । এই কাহিনী মানুষের মনে সৃষ্টি করলো মঙ্গল গ্রহ নিয়ে এক দুশ্চিন্তা – মঙ্গলে অমঙ্গল নিশ্চয় সেখানে রয়েছে মানুষ থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী । মঙ্গল নিয়ে তেমন অসংখ্য কল্পবিজ্ঞানের কাহিনীর অভাব নেই । অবশেষে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আবিষ্কার করলো মঙ্গল গ্রহে মানুষের মত কোনও উন্নত প্রাণী নেই । মানব সভ্যতা নিশ্চিন্ত হল । কিন্তু প্রাণের কোনও স্পন্দনই কি নেই সেই গ্রহে  ? এই প্রশ্নটি বিজ্ঞানীদের ভাবিত করেছে সবথেকে বেশী । এর উত্তর এখনো অজানা । আর এ নিয়ে শুরু হয়েছে বিস্তর গবেষণা । সেই রহস্য সন্ধানে নানা স্পেস ক্রাফট মঙ্গলের দিকে ধেয়ে গিয়েছিল নানা সময়ে । যার সাম্প্রতিক সংযোজন হল  ‘কিউরিওসিটি রোভার’ নামক রোবটটি । প্রায় ২৫ কোটি ডলারের এই প্রজেক্টের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মঙ্গল পৃষ্ঠে প্রাণের খোঁজ করা ।
২৬ নভেম্বর ২০১১ সালে ‘মার্স সায়েন্স ল্যাবরেটরি’ মহাকাশযানটিকে ‘নাসা’-র বিজ্ঞানীরা নাসার কেপ ক্যানাভেরাল উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে উৎক্ষেপণ করেন । এই মহাকাশযানেই পে লোড হিসেবে রয়েছে ছয় চাকা বিশিষ্ট একটি বিশেষ রোবট যার নাম হচ্ছে ‘কিউরিওসিটি রোভার’ অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি এই রোভারটি পারমানবিক শক্তিতে নিয়ন্ত্রিত । কিউরিওসিটির নকশা বানানো আর সেটিকে তৈরি করার দায়িত্বে ছিলেন নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা । প্রায় সাড়ে আট মাসের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে গত ৬ আগস্ট ২০১২ সালে ভারতীয় সময় সকাল এগারোটা দুই-এ রোভারটি মঙ্গলের বুকে অবতরণ করে । সাধারণত: সৌরশক্তির সাহায্যে মহাকাশযান কিংবা মানবহীন রোবট গুলোকে চালানো হয়, কিন্তু কিউরিওসিটির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা পারমানবিক শক্তির সাহায্য নিয়েছেন, যা এক অত্যাধুনিক প্রযুক্তিপ্লুটোনিয়াম ব্যাটারির সাহায্যে তাপ এবং বিদ্যুৎ উভয়ই কিউরিওসিটি রোভারকে আগামী ১৪ বছর খুব ভাল ভাবেই সচল করে রাখতে পারবে । এই রোভারেই রয়েছে সতেরোটি অত্যাধুনিক ক্যামেরা । যার সাহায্যে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করা সম্ভব হবে ।  
এবার জেনে নেওয়া যাক  কিউরিওসিটি রোভার প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য । মঙ্গল গ্রহে প্রাণ আছে কিনা সেটি গবেষণা করাই এর মূল উদ্দেশ্য । মঙ্গলের বুকে নানা পাথর আর গভীর গর্তের মধ্যে কিউরিওসিটি রোবটটি সুরঙ্গ করে অনুসন্ধান করবে কোনও ব্যাকটেরিয়া জাতীয় প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা । এর জন্য ঐ রোবটের শরীরের ভেতরেই রয়েছে এক মিনি ল্যাবরেটরি । মঙ্গল পৃষ্ট থেকে পাওয়া নানা পদার্থ সেখানেই বিশ্লেষণ করে রোভারটি সেই তথ্য পৃথিবীতে বেতার তরঙ্গ মারফত প্রেরণ করবেএছাড়া মঙ্গলের আবহাওয়া সম্পর্কেও পুঙ্কানুপুঙ্ক বিশ্লেষণ করবে এই হাইটেক রোবট । মঙ্গলের ভূতত্ব গবেষণা করাও তার মিশনের একটি প্রধান অঙ্গ । এই মিশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য মঙ্গল গ্রহে  মানব মিশনের রূপরেখা তৈরী করতে বিজ্ঞানীদের আগামীতে নানাভাবে সাহায্য করবে ।  
নাসার চতুর্থ রোবোটিক মিশন কিউরিওসিটি তার পূর্বসুরিদের থেকে অনেক বেশী হাইটেক  সম্পন্ন । এর ভরও আগের রোভার মিশন থেকে বেশী । নাসার পূর্ববর্তী মিশন থেকে এটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে মঙ্গলের উত্তর গোলার্ধে রয়েছে বরফের স্তর । এই কঠিন বরফের নিচেই নাকি রয়েছে তরল জলের সমুদ্র । তাই নাসার বিজ্ঞানীরা উত্তর গোলার্ধের ‘গেল’ নামক ক্রেটারে কিউরিওসিটিকে অবতরণ করান । এই ক্রেটার বা গর্তেই রয়েছে ১৫৪ কিলোমিটার ব্যাস আর ৫.৫ কিলোমিটার উঁচু এক বিশাল পর্বত । ‘এয়েলো মন্‌স’ নামক ঐ পর্বতের বয়স হচ্ছে প্রায় ৩৫ থেকে ৩৮ কোটি বছর । বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে সেখানেই নাকি লুকিয়ে থাকতে পারে প্রাণের বীজ । আগামীতে কিউরিওসিটি সেই ‘গেল’ গর্তেই অক্লান্তভাবে খুঁজে বেড়াতে থাকবে প্রাণের বীজ । 
            নাসার এই সাফল্যে বিজ্ঞানী মহল খুব খুশি । এই হাইটেক মিশনের সাফল্যের উপরই নির্ভর করছে ভবিষ্যতের নানা রূপরেখা । আগামীতে মানব কলোনী গড়তেও এই মিশন যথেষ্ঠ সাহায্য করবে । কে জানে হয়তো ১০০ বছর পর  মঙ্গলগ্রহে হয়ে যাবে আমাদের আর এক ঠিকানাআর তখন গরম কিংবা শীতের ছুটিতে সেই গ্রহে ক’দিন ঘুরে আসাটাও মন্দ হবেনা । কি বলেন ?

Sunday, July 15, 2012

ঈশ্বর কণার সন্ধানে

সুইজারল্যান্ডের জেনেভার ‘সার্ন সেন্টার’-এ অডিটোরিয়াম ভর্তি লোক । অন্যান্য বিশেষ নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮৩ বছরের এক পদার্থবিজ্ঞানীও দর্শকের আসনে চুপচাপ বসে রয়েছেন । সবার চোখ সেই বিজ্ঞানীর দিকে । আজ এমন এক ঘোষণা হতে চলেছে যা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা হবে । ১৯৬৪ সালে যে বিজ্ঞানী মানস চক্ষে দেখতে পেয়েছিলেন ভবিষ্যতের ‘চাপ্টার’, আজ ৪ঠা জুলাই ২০১২ সালে সার্নের বিজ্ঞানীরা জনসাধারণের সামনে সেটিই উন্মুক্ত করতে চলেছেনসেই পদার্থবিজ্ঞানীর কল্পনা আর গণিতের মেলবন্ধনের বাস্তব স্বরূপ দেখার জন্য সারা পৃথিবীর মানুষ অপেক্ষা করছেন । যথাসময়ে সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা হল, আর তারপর অডিটোরিয়াম ভর্তি মানুষের হাততালির ছন্দে সেই ভদ্রলোক কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন সাফল্যের খুশিতে ওনার চোখে জল । জীবন সায়াহ্নে এসে এমন খুশির খবর যে শুনবেন তা ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পিটার হিগ্‌স্‌ স্বপ্নেও ভাবেন নি । বিজ্ঞানের জগত তখন ঈশ্বরময় ! অদৃশ্য কোন এক জগত থেকে অবশেষে ‘ঈশ্বর কণা’ দৃশ্যমান জগতে আবির্ভূত হলেন । বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা আর জেদের কাছে তিনি পরাজিত হলেন । এই ধরাধামে ঈশ্বর কণাকে আনিয়েই ছাড়লেন বিজ্ঞানীরা । গণিতের মধ্যে যে লুকিয়ে আছে সৃষ্টি রহস্যের চাবিকাঠি তা আবারও পরীক্ষিত ভাবে প্রমাণিত হল । পিটার হিগ্‌সের গবেষণা থেকে জন্ম নেওয়া এক তাত্ত্বিক কণা অবশেষে গণিতের দুনিয়া থেকে বেরিয়ে এসে ল্যাবরেটরিতে জন্ম নিলোআর এটা হতেই সময় লেগে গেল সুদীর্ঘ ৪৮ বছর !      

পিটার হিগ্‌স্‌
      অ্যালবার্ট আইনস্টাইন আর সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখরের সঙ্গে পিটার হিগ্‌সের এক অদ্ভুত মিল ! এই তিনজন পদার্থবিদ তাঁদের জীবদ্দশায় এমন থিওরির কথা বলেছিলেন যা বিজ্ঞানের জগতে আলোড়ন জাগায় আইনস্টাইনের ‘সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ’, চন্দ্রশেখরের ‘নক্ষত্রের বিবর্তন তত্ত্ব’  আর  হিগ্‌সের ‘গজ বোসনের ভর তত্ত্ব’- এগুলোর পরীক্ষামূলক প্রমাণ করাটাও বিজ্ঞানীদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল১৯১৬ সালে আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের কথা বললেও ১৯১৯ সালে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ অধ্যয়ন করার পর তা পরীক্ষামূলক ভাবে প্রমাণিত হয় । এই বিখ্যাত বিজ্ঞানী ১৯২১ সালে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন । ভারতীয়-আমেরিকান বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ১৯৩০ সালে নক্ষত্রের বিবর্তন রহস্যের উপর গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, আর তখন ‘চন্দ্রশেখর লিমিট’ এর ধারণাও সৃষ্টি হয় । একটি নক্ষত্রের মৃত্যু হবার পর সেটি ‘ওয়াইট ডুয়ার্ফ’, ‘নিউট্রন স্টার’ না ‘ব্ল্যাকহোল’ হবে সেটা নির্ভর করে নক্ষত্রের ভরের উপর । ১৯৭১ সালে ‘ব্ল্যাকহোল’ আবিষ্কৃত হলেও চন্দ্রশেখর ১৯৮৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান ।  উল্লেখ্য যে পিটার হিগ্‌সের পূর্বসূরি দু’জন বিখ্যাত বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হলেও তাঁর ভাগ্যে কিন্তু এখনও নোবেলের শিকে ছিঁড়েনি । তবে ৪ জুলাইর পর বিশ্বের সব দিক থেকেই আওয়াজ উঠছে এই জীবন্ত কিংবদন্তীকে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করারকি হবে, সেটা সময় বলবে । 
 
গত কয়েকমাস ধরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে বিজ্ঞানীদের আনাগোনায় আসর গরম । সেখানেই বিশাল এক কর্মযজ্ঞ চলছে ‘এল এইচ সি’ (লার্জ হ্যাডরন কলাইডার) নামক যন্ত্রে । ‘দ্য ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ’ (সার্ন) এর বদান্যতায় তৈরি এটিই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ যন্ত্র ! ফ্রান্স এবং সুইজারল্যান্ডের সীমানার ২৭ কিলোমিটার পরিধির বৃত্তাকার এক সুরঙ্গের মধ্যেই তার আবাস । গত ৪ঠা জুলাই-এ সার্নের বিজ্ঞানীরা যখন ঘোষণা করলেন যে অবশেষে পাওয়া গেছে ‘ঈশ্বর কণা’, তখন সারা বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে এক খুশির বাতাবরণ সৃষ্টি হয়  পঁয়তাল্লিশ বছরের সুদীর্ঘ যাত্রাপথ পাড়ি দেওয়ার ফলশ্রুতিতেই বিজ্ঞানীদের কাছে এই চরম সাফল্য ধরা দিয়েছে  ।       

লার্জ হ্যাডরন কলাইডার

প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল যে বিজ্ঞানের জগতের ঈশ্বর কণার সঙ্গে আধ্যাত্মিক জগতের ঈশ্বরের কোনও সম্পর্ক নেই । এই কণা শনাক্তকরণের সঙ্গে ভগবানের উপস্থিতি গুলিয়ে ফেললে চলবে না । বিজ্ঞানীদের অভিধানে ‘ঈশ্বর কণা’ বা ‘গড পার্টিকেল’ বলেও কোনও শব্দ নেই । এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘হিগ্‌স্‌ বোসন পার্টিকেল’ বা ‘হিগ্‌স্‌ বোসন কণা’ আসলে নোবেল পদার্থবিজ্ঞানী লীয়ন লেডারম্যান তাঁর ১৯৯৩ এর জনপ্রিয় বই The God Particle: If the Universe Is the Answer, What is the Question?”  তে হিগ্‌স্‌ বোসন কণাকে ঈশ্বর কণা বলে উল্লেখ করায় সাধারণ ভাষায় এই নামকরণ স্থান পেয়ে গেছে । কিন্তু এই বই প্রকাশের অনেক পর নাস্তিক লেডারম্যান স্বীকার করেছিলেন যে তিনি আসলে গড পার্টিকেলের বদলে ‘গডড্যাম পার্টিকেল’ (Goddamn Particle) প্রস্তাব করেছিলেন, কারণ তাঁর মতে সেটাই ছিল সবথেকে যুক্তিযুক্ত । কিন্তু প্রকাশক তা মানতে রাজী হননি বইয়ের কাটতির কথা ভেবে । তবে এটাও ঠিক যে ‘হিগ্‌স্‌ বোসন কণা’-কে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার প্রয়োজনে ‘ঈশ্বর কণা’ নামকরণেরও দরকার ছিল । যেমন স্টিফেন হকিং তাঁর বিখ্যাত বই A Brief history of timeএর মাধ্যমে বিশ্বতত্ত্বের মত দুরূহ বিষয়কে চায়ের টেবিলে নিয়ে আসলেন । এই বইটির মাধ্যমেই ‘ব্ল্যাক হোল’ বা ‘কৃষ্ণ গহ্বর’-এর নাম মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে লাগলো ।  যাই হোক আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা সেই আবিষ্কৃত কণাকে আর ঈশ্বর কণা বলে অভিহিত করবোনা, বরং তাঁকে ‘হিগ্‌স্‌ বোসন কণা’ বলেই সম্বোধন করবো      

সত্যেন্দ্র নাথ বসু
     শুরুতেই জেনে নেওয়া যাক হিগ্‌স্‌ বোসন কণা সম্পর্কে । এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির নেপথ্যে রয়েছে নানাবিধ কণার সংমিশ্রণ । যেমন – ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন । এ ছাড়াও রয়েছে আরও অনেক কণা । একটি মানুষ সৃষ্টির নেপথ্যেও রয়েছে লক্ষকোটি কণার সমন্বয় । এই কণাদের জগতটাও বড় বিচিত্র আর রহস্যময় ! এর কুহেলি ভরা চরিত্র মোহিত করে রেখেছে গবেষকদের । আসলে এই কণাগুলির চরিত্রের গভীরেই লুকিয়ে রয়েছে মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্যের চাবিকাঠি প্রকৃতির সকল জানা পদার্থ এবং শক্তি যে সব মৌলিক কণা দিয়ে গঠিত তাদের শ্রেণীবিন্যাসের নাম ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’কণা দুই ধরণের হয়ে থাকে – ‘ফার্মিয়ন’ (বিখ্যাত বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির নামে) আর ‘বোসন’ (বিখ্যাত ভারতীয় বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্র নাথ বোসের নামে) এ যেন কিছুটা শ্রেণী বিভাগের মত । যেমন - আমেরিকার দুইটি রাজনৈতিক দল হল ‘রিপাবলিকান’ আর ‘ডেমোক্রেটিক’, এর বাইরে কোনও দল নেই । তাই আমেরিকার জনগণ এই দু’টি দল ছাড়া অন্য দলে যেতে পারেন না । মহাবিশ্বে অজস্র কণা থাকলেও তাঁদের দু’টি শ্রেণীতে নাম লেখাতে হয় । হয় ‘ফার্মিয়ন’ নতুবা ‘বোসন’ সব ফার্মিয়নের ভর বা ‘মাস্‌’ আছে, আর কিছু বোসনের ভর আছে । স্ট্যান্ডার্ড মডেল দিয়ে কিছুতেই ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিলোনা এই ভরের উৎপত্তি কিভাবে হয়েছে । অবশেষে ১৯৬৪ সালে পিটার হিগ্‌স্‌ আর তাঁর পাঁচ সমসাময়িক বিজ্ঞানী প্রস্তাব করেন যে এক অদৃশ্য ক্ষেত্র (বা ‘ফিল্ড’) এই মহাবিশ্বের সর্বত্র বিরাজমান আছে যে নাকি মৌলিক কণাগুলিকে ভর প্রদান করেছে । এই ক্ষেত্রকে পরবর্তীতে ‘হিগ্‌স্‌ ক্ষেত্র’ নাম দেওয়া হয়েছে । কিন্তু কি দিয়ে এই ক্ষেত্র গঠিত ? বলা হল যে একটা কণা থাকতে হবে যা দিয়ে এই ক্ষেত্র গঠিত । পরবর্তীতে সেই কণার নাম দেওয়া হল ‘হিগ্‌স্‌ বোসন কণা’ যে নাকি ‘বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্‌স্‌’ মেনে চলে । পিটার হিগ্‌সের লেখা “ব্রোকেন সিমেট্রিস এন্ড দ্য মাসেস অব গজ বোসনস্‌” নামক গবেষণাপত্রটি বিখ্যাত ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারস জার্নালে ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল । মাত্র দেড় পাতায় লেখা গবেষণা পত্রটি বিজ্ঞানের জগতে এক উল্লেখযোগ্য মার্গ দর্শন ঘটিয়েছিল । তবে ঐ জার্নালের একই ভলিউমে হিগ্‌সের সমসাময়িক পাঁচজন বিজ্ঞানী হিগ্‌স্‌ বোসন নিয়ে আরও দু’টি পেপার লিখেছিলেন । তাই তাঁদের অবদানও ভুলবার নয় । 
  
        এবার সাধারণ ভাষায় ‘হিগ্‌স্‌ বোসন কণা’ সম্পর্কে জানা যাক । যদিও পদার্থবিদ ব্যতীত সাধারণ মানুষের পক্ষে ‘হিগ্‌স্‌ তত্ত্ব’ বোঝা বেশ মুশকিল । তবুও উপমার সাহায্যে অনেক বিজ্ঞানীরাই সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপারটা তোলে ধরার চেষ্টা করেছেন । ধরে নেওয়া যাক শহরের এক অভিজাত হোটেলে উঠতি ক্রিকেটারদের নিয়ে এক পার্টির আয়োজন করা হয়েছে । সেই পার্টিতে মুখ্য অতিথি সৌরভ গাঙ্গুলি । একজন ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে সেই পার্টিতে আমিও নিমন্ত্রিত । তিনি যখনই পার্টিতে হাজির হলেন, তখন তাঁর চারিদিকে ক্রিকেটাররা জটলা পাকিয়ে এক গোলাকার আবরণ সৃষ্টি করলোযার ফলে সৌরভের পক্ষে সামনে এগিয়ে যেতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে । কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছেনা । আমি বিনা বাধায় সবদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছি । একজন হালকা ওজনের মানুষের থেকে একজন অধিক ওজনের মানুষের নড়াচড়ায় কষ্ট হয় । সৌরভের ক্ষেত্রেও তা হয়েছে । আসলে সৌরভের ওজন তাঁর ভক্তদের জটলা পাকানোর কারণে বেড়ে গেছে । এই উপমাতে হিগ্‌স্‌ বোসন কণা হচ্ছে ঐ উঠতি ক্রিকেটারদের মত, যার কারণে ভরহীন কণা ভর অর্জন করে ।  যেহেতু আমার জনপ্রিয়তা সৌরভের ধারে কাছেও নেই, তাই ওর থেকে আমার ভর কম হবে । একইভাবে মৌলিক কণাগুলো হিগ্‌স্‌ ক্ষেত্রের সাথে ক্রিয়া করে সমান ভর লাভ করে না, জনপ্রিয়তার মত সবার ভর এক হয় না  । স্বভাবতই সৌরভ হচ্ছেন অধিক ভরের কণা আর আমি হচ্ছি কম ভরের কণা । আর একটি সুন্দর উপমার প্রসঙ্গ এখানে করবো । ধরে নেওয়া যাক এই মহাবিশ্ব অদৃশ্য ক্ষীরে পরিপূর্ণ । আমরা এঁকে ‘হিগ্‌স্‌ ক্ষীর’ বলে আখ্যায়িত করতে পারিপ্রকৃতিতে মৌলিক কণাগুলি হল নানা আকারের চামচের মত । কোনটি বা বড় আর কোনটি ছোট । এখন যদি একটি বড় চামচ হিগ্‌সের ক্ষীরে ডুবিয়ে নেওয়া যায় তবে সে বেশী ক্ষীর নিতে পারবে ছোট চামচ থেকে । যত বেশী ক্ষীর তত বেশী ভর । আর চামচটি যদি ডুবিয়ে নেওয়া না হয় তবে সেটি থাকবে ক্ষীর শূন্য অর্থাৎ ভর শূন্যভর যত কম হবে গতিবেগ তত বেশী । আমরা সবাই জানি যে আলোর গতিবেগ সবথেকে বেশী । আলো বা ‘ফোটন’ যেহেতু একটি কণা, আর তাঁর ভর শূন্য হবার কারণে সে সব কণার থেকে বেশী গতিবেগে ছুটতে থাকে । মোদ্দা কথায় বলতে গেলে হিগ্‌স্‌ বোসন কণার জন্যই প্রকৃতির নানা কণা (যেমন ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদি) তাদের ভর লাভ করেছে ।    

          হিগ্‌স্‌ কণার কথা ১৯৬৪ সালে বলা হলেও একে শনাক্ত করতে বিজ্ঞানীদের এত বছর কেন লেগে গেল ? প্রচলিত থিওরি মতে এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমেই এই মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল যাকে ‘বিগ ব্যাং’ বলা হয়ে থাকে । বিজ্ঞানীদের ধারণা এই বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ পর হিগ্‌স বোসন কণার সৃষ্টি হয় । এই কণা তৈরি হয় অনেক উচ্চ শক্তিতে যা ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা বেশ মুশকিল । তবে বিজ্ঞানীরা হাল ছাড়েননি ।  হিগ্‌স্‌ বোসন কণাকে ল্যাবরেটরিতে সৃষ্টি করার জন্য বিজ্ঞানীরা যন্ত্র তৈরিতে মনোনিবেশ করলেন । ‘দ্য ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ’ (সার্ন) এর নেতৃত্বে তৈরি হল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ যন্ত্র - ‘এল এইচ সি’ (লার্জ হ্যাডরন কলাইডার) ! সারা বিশ্বের প্রায় দশ হাজার বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়ারদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই যন্ত্রটির অবস্থান মাটির তলায় ১৭৫ মিটার নিচে যা বানাতে খরচ হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি ডলার ! মহাবিশ্বের জন্মরহস্য অনুসন্ধান, হিগ্‌স্‌ বোসন কণার পরীক্ষামূলক অস্তিত্বের সন্ধান, ‘ডার্ক ম্যাটার’ আর ‘ডার্ক এনার্জি’ এর রহস্য উন্মোচনের পাশাপাশি ‘গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন থিওরি’ তৈরির লক্ষেই ‘এল এইচ সি’ –এর জন্ম । আসলে এই মহাবিশ্বের যাবতীয় বস্তু, গ্যালাক্সি, গ্রহ নক্ষত্র সব কিছু সৃষ্টির নেপথ্যে রয়েছে এই হিগ্‌স্‌ বোসন কণা । তাই এর শনাক্তকরণ খুব জরুরী হয়ে পড়েছিল । 

     বিস্তারিত না বলে এতটুকুই বলা যায় যে ‘এল এইচ সি’-তে উচ্চ শক্তির একটি প্রোটনের সঙ্গে আর একটি উচ্চ শক্তির প্রোটনের সংঘর্ষ ঘটিয়েই নূতন কণার সৃষ্টি করা হয়েছিল । ফলাফল হিসেবে এমন একটি কণা পাওয়া গেল যার শক্তি প্রায় ১২৫ গিগা ইলেকট্রন ভোল্টের (আলোর গতির এককে) কাছাকাছি । বিজ্ঞানীদের গণনা মতে হিগ্‌স্‌ বোসন কণার শক্তিও এমন হওয়ার কথা । এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে প্রকৃতিতে বাকী মৌলিক কণার শক্তি এমন হওয়ার কথা নয় । এই পরীক্ষার জন্য দু’টি পৃথক বিজ্ঞানীদের দল গঠন করা হয় । একটা দল হল ATLAS (A Toroidal LHC Apparatus), আর অপরটি CMS (Compact Muon Solenoid) উভয় দল পরীক্ষার পর একই ফলাফলে উপনীত হন । এখানে উল্লেখ্য যে কোন দলই অন্য দলের কার্য পদ্ধতি সম্পর্কে জানতেন না । দুটি দলই তৈরি করার সময় নানা দেশের বিজ্ঞানীদের রাখা হয়েছিল যাতে কোন পক্ষপাত না হয় ফলাফলের পর সার্নের বিজ্ঞানীরা একমত হন যে ‘হিগ্‌স্‌ বোসন কণা’ সদৃশ এক কণার সন্ধান পাওয়া গেছে । ৪ঠা জুলাই প্রেস কনফারেন্সে সেই সম্ভাবনার কথাই জনসমক্ষে বলা হয় । “সঠিক কখনো কখনো খুব সুন্দর হয় !” হিগ্‌স্‌ বোসন কণা আবিষ্কারের পর এভাবেই মনের ভাষা ব্যক্ত করেন পিটার হিগ্‌স্‌ ।

     এবার জেনে নেওয়া যাক এই রাজসূয় যজ্ঞে ভারতের অবদান কতটুকু । ‘এল এইচ সি’-তে ২০০০ বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রায় ২০০ জন বিজ্ঞানীই ভারতের । ভারত প্রায় আড়াই কোটি ডলার সাহায্য দিয়েছে সেই মেগা প্রজেক্টে । ‘এল এইচ সি’-এর ২৭ কিলোমিটার বৃত্তাকার সুরঙ্গে রয়েছে প্রায় ১২৩২ টি ক্রায়ো ম্যাগনেট । সেগুলি সূক্ষ্মভাবে ঠিকঠাক জায়গায় বসানোর জন্য যে ‘পজিশনিং সিস্টেম’ এর দরকার তা ইনডোরের ‘রাজা রামান্না সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড টেকনোলজি’-তে বানানো হয়েছে । ‘সি এম এস ডিটেক্টর’-এর বিশেষ ‘সেন্সর’ গুলো দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে বানানো হয়েছে । উল্লেখ্য যে এই ডিটেক্টর হিগ্‌স্‌ বোসন কণা শনাক্তকরণে বিশেষ ভূমিকা নেয় । এছাড়াও টাটা ইন্সটিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, মুম্বাই; ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার, ট্রোম্বে; সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, কলকাতা; বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়; জয়পুর বিশ্ববিদ্যালয়; পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদির বিজ্ঞানীরা ‘ফাইবার অপটিক ক্যাবল্‌স্‌’ ডেভেলপমেন্টে সার্ন-কে নানা ভাবে সাহায্য করেন । ‘এল এইচ সি’-এর ভেতরে যে সূক্ষ্ম পরীক্ষা নিরীক্ষা হচ্ছে সেগুলিকে বিশ্লেষণ করার জন্য উন্নতমানের সফটওয়ার দরকার ভারতের গবেষকেরা সেই বিশেষ সফটওয়ার বানাতে সার্ন-কে সাহায্য করেছেন । ভারতীয় মূলের ব্রিটিশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক জিম ভির্ডি আবার ‘সি এম এস ডিটেক্টর’-এর প্রতিষ্টাতা সদস্যভারতের অধ্যাপক অর্চনা শর্মা প্রায় ২৫ বছর ধরে সার্নের ঐ ল্যাবে কাজ করছেন । সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এর অধ্যাপক বিকাস সিনহা একটি বিশেষ ‘চিপ’ তৈরি করেন যা ‘এল এইচ সি’ তে সিগনাল প্রসেসিং এ ব্যবহৃত হয় । অধ্যাপক বিনোদ চৌহান কে কিছু বিজ্ঞানীদের গ্রুপ লিডার বানানো হয় যাদের কাজ ছিল ‘এল এইচ সি’-এর ভেতরে সব ম্যাগনেট ঠিকঠাক ভাবে কাজ করছে কি না সেটার উপর নজর রাখা ভারতের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের পি এইচ ডি স্কলাররাও সার্নের ল্যাবে গিয়ে তাঁদের গবেষণার কাজ করেছেন । সবকিছু মিলিয়ে ভারতের অবদানও এই বিশাল কর্মকাণ্ডে নেহাত ফেলনা নয় ।  

     “হিগ্‌স্‌ বোসনের আবিষ্কারে হয়তো পিটার হিগ্‌স্‌ নোবেল পুরষ্কার পেতে পারে, কিন্তু আমার আর্থিক ক্ষতি হয়ে গেছে ।  আমি একশো ডলারের বাজী হেরে গেলাম” উক্তি বিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-এর ।  কোনও একটি কনফারেন্সে যুক্তরাষ্ট্রের মিচিগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী গর্ডন কেনের কাছে হকিং বাজী ধরেছিলেন যে  হিগ্‌স্‌ বোসন কখনো শনাক্ত করা যাবে না । কিন্তু পিটার হিগ্‌সের ভক্ত গর্ডনের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, বাজী তিনি জিতবেনই ...


ভারতীয় আনবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ড.অনিল কাকোদকার ভারতে নির্মিত নটরাজ মূর্তিটি সার্নের ডিরেক্টর জেনারেল অধ্যাপক রবার্ট এমারকে উপহার হিসেবে দিচ্ছেন । 

Friday, June 1, 2012

৬ জুনের লাইভ শো দেখার জন্য তৈরি তো ?



‘লাইভ শো’ দেখতে যারা ভালবাসেন তাঁদের জন্য এক জব্বর খবর । ‘আই পি এলের’ দীর্ঘ নাটকীয় লাইভ ক্রিকেট ম্যাচগুলো দেখে যারা ‘বোর’ হচ্ছিলেন, তাদেরকে এক আলাদা স্বাদ দেবার জন্য আগামী ৬ জুন দু’জন ‘কলাকার’ তৈরি হচ্ছেন । প্রায় তিন ঘণ্টার এই শোয়ে থাকবে এক আলাদা আনন্দ, মজা আর শিহরণ । সকাল সাতটা থেকে শুরু হওয়া এই ‘শো’ দেখার জন্য বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষেরা উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছেন । সেদিনই ঘটতে চলেছে এমন এক মহাজাগতিক ঘটনা যা আবার দেখতে হলে আমাদের আরও ১০৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে । ‘ট্রেন্সিট অব ভেনাস’ নামক অনুষ্ঠানে সূর্য আর শুক্রের দ্বৈত অভিনয়কে ক্যামেরা-বন্দী করবেন পৃথিবী স্বয়ং । আসলে সেদিনই এক অভিনব সূর্য গ্রহণ ঘটতে চলেছে যার নেপথ্যে রয়েছেন নায়িকা শুক্র গ্রহ বা ‘ভেনাস প্ল্যানেট’ । সূর্যের সঙ্গে শুক্রের ‘টুইস্ট ডান্স’ নিয়ে আসর আপাতত গরম । আর এই লাইভ শো-এর ‘টি আর পি’ও তাই এখন তুঙ্গে ।
     সৌরজগতের নানা চমকপ্রদ ঘটনার মধ্যে ‘ট্রেন্সিট অব ভেনাস’ হল এক অতি বিরল ঘটনা । সূর্য আর পৃথিবীর মধ্যে রয়েছে শুক্র আর বুধ গ্রহ । কখনো কখনো এই গ্রহ দু’টি সূর্য আর পৃথিবীর মধ্যে এক সরলরেখার চলে আসে । আর তখন দৃশ্যমান হয় গ্রহণ । সাধারণত: সূর্যগ্রহণ বলতে আমরা পৃথিবী আর চন্দ্র উপগ্রহের ‘রাউন্ড ডান্স’-এর কথাই জানি । পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় চন্দ্র পুরো সূর্যকেই ঢেকে ফেলে । তখন সূর্য ভোজবাজীর মতই কিছুক্ষণের জন্য পৃথিবীর আকাশ থেকে ‘গায়েব’ হয়ে যায় । গ্রহণ হতে হলে সূর্যের কৌণিক ব্যাসার্ধের সঙ্গে চন্দ্রের কৌণিক ব্যাসার্ধ মিলতেই হবে, আর হতে হবে অমাবস্যা । আর বলয়গ্রাসের সময় চন্দ্রের কৌণিক ব্যাসার্ধ সূর্য থেকে কিঞ্চিৎ ছোট হয় । তাই সূর্যকে একটি রিং এর মত দেখায় । আর এই মজার ঘটনা সম্ভব হওয়ার পেছনে চন্দ্র আর পৃথিবীর স্বল্প দূরত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে । কিন্তু বুধ আর শুক্র গ্রহের দূরত্ব পৃথিবী থেকে বেশী হওয়ার কারণে বুধ বা শুক্র গ্রহ পুরো সূর্যকে ঢাকতে পারেনা । পৃথিবী থেকে এই বিশেষ সূর্য গ্রহণের সময় শুক্র গ্রহকে তখন একটি কালো মটর দানার মত সূর্যের পৃষ্টে দেখা যায় । এই গ্রহ সূর্যের বলয়ের এক পাশ থেকে অন্য পাশে যেতে সময় লেগে যায় কয়েক ঘণ্টা । মজার ব্যাপার হল জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ‘ট্রেন্সিট’ সময় গণনা করে পৃথিবী আর সূর্যের দূরত্ব নির্ণয় করতে পারেন ।
       ১৬৩১ সালে জোহানেস কেপলার প্রথম গণনার সাহায্যে সর্বসমক্ষে ঘোষণা করেন যে ৬ ডিসেম্বর ১৬৩১ সালে ‘ট্রেন্সিট অব ভেনাস’ হবে ।  সেদিন ‘ট্রেন্সিট অব ভেনাস’ ইউরোপে দৃশ্যমান না হওয়ায় তিনি সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকলেন । জেরেমিয়া হরোকস নামে এক ইংরেজ পুরোহিত প্রথম বোঝতে পারেন যে এই ঘটনা দ্বিতীয়বার ‘রিপিট’ হবে খুব কম সময়ের ব্যবধানে । তিনি অঙ্ক কষে দেখেন যে ২৪ নভেম্বর ১৬৩৯ সালে এটি আবার দৃশ্যমান হবে । বিজ্ঞানের ইতিহাসে তিনিই প্রথম এই ঘটনা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণ করেন । আসলে ‘ট্রেন্সিট অব ভেনাস’ জোড়া ঘটনা হিসেবে হয়ে থাকে । এর মানে এই ঘটনা একবার হলে দ্বিতীয়টি খুব কম সময়ের মধ্যে ‘রিপিট’ হয় । যেমন ১৮৭৪ আর ১৮৮২ সালে ‘ট্রেন্সিট অব ভেনাস’ ঘটেছিল । এই ঘটনা গত ৮ জুন ২০০৪ সালে পৃথিবী থেকে শেষ দেখা গিয়েছিল ।  ৬ জুন ২০১২ এর পর আবার এই ঘটনা দৃশ্যমান হবে ২১১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে । এর মানে পাক্কা ১০৫ বছর পর !
    এই ঘটনা দেখতে হলে একটু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে । খালি চোখে সূর্যকে দেখতে গেলেই অন্ধ হবার চান্স থাকে । সাধারণত: ওয়েল্ডিং এর কালো গ্লাস বা এক্স রে প্লেট কে দুই বা তিন পরতে জোড়া দিয়ে ফিল্টার বানাতে হবে যা সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে রক্ষা করবে । জলে প্রতিফলিত সূর্যের প্রতিবিম্বকেও যেন সরাসরি কেউ না দেখেন । দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে প্রজেকশন স্ক্রিনের মাধ্যমে সূর্যের প্রজেক্টেড ইমেজ দেখা যেতে পারে । আর এটাই সব থেকে নিরাপদ ।
    সকাল ঠিক সাতটার সময় এই ঘটনা শিলচরে দৃশ্যমান হবে । ততক্ষণে শুক্র গ্রহ সূর্যের প্রায় মধ্যখানে চলে আসবে । সকাল প্রায় ১০:০৫ এ সূর্যের বলয় থেকে  শুক্রগ্রহ বের হওয়া শুরু হবে । তারপর সকাল প্রায় ১০:২১ এ শুক্র পুরোপুরি বেরিয়ে পড়বে সূর্যের বলয় ছেড়ে আর শেষ হয়ে যাবে লাইভ শো ।  
    গরমের কষ্টে নাজেহাল আম আদমিরা অন্তত: সেদিন আশা করবেন না যে বৃষ্টি হোক । আসলে এই ঋতুতে বৃষ্টির সঙ্গে যে আমাদের এক আলাদা রোমান্সের সৃষ্টি হয় । আসুন না গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ স্বল্প ক্ষণের জন্য ভুলে আমরা এক মহাজাগতিক ঘটনার সাক্ষী হই !

Wednesday, February 29, 2012

রাতের আকাশে গ্রহদের নৃত্য


রাতের আকাশের মনমাতানো রূপ দেখে যারা রোমান্টিকতায় হারিয়ে যেতে চান, তাঁদের জন্য এক দারুণ খবর ! আগামী কয়েকদিন কালো আকাশের ‘ব্যাকড্রপে’ রাতভর চলবে পর্যায়ক্রমে পাঁচটি গ্রহের ‘টুইস্ট ডান্স’ । সারাটা রাত সেই দৃশ্য দেখে বসন্তের মায়াঘন রাত কেমন করে কেটে যাবে বোঝাই যাবেনা !
এক বিরল মহাজাগতিক ঘটনার সাক্ষী হতে চলেছি আমরা । আগামী মার্চ মাসের কয়েকদিন রাতের আকাশে পৃথিবী থেকে পাঁচটি গ্রহ দৃশ্যমান হবে । সেগুলো হল বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি আর শনি । উল্লেখ্য যে পৃথিবী থেকে খালি চোখে শুধু এই গ্রহগুলোই দেখা যায় । আসলে ইউরেনাস আর নেপচুন গ্রহকে কখনো খালি চোখে পৃথিবী থেকে দেখা যায় না । যদি দেখা যেত তাহলে জ্যোতিষ বন্ধুরা তাঁদের জ্যোতিষ শাস্ত্রে মানুষের উপর এই দুটি গ্রহের প্রভাব নিয়ে লিখে ফেলতেন নানা আজগুবি কথা । হয়তো আরও দু’টো রত্ন বা পাথর এদের নামের সঙ্গে যুক্ত হত ! যাই হোক সেই গল্প এখন থাক । মনে রাখতে হবে যে ইউরেনাস আর নেপচুন গ্রহকে দেখতে হলে শক্তিশালী দূরবীন দিয়ে দেখতে হয় । সৌরজগতের আটটি গ্রহের সংসারে তেমন বিরল সময় খুব কমই আসে যখন এই পাঁচটি গ্রহ পৃথিবী থেকে খালি চোখে একসঙ্গে দেখা যায়  ।
রাতের আকাশে অগণিত নক্ষত্রের ভিড়ে তাহলে গ্রহদের খুঁজে বের করা কেমন করে ? আসলে গ্রহ আর নক্ষত্রের মধ্যে মূল পার্থক্য হল- নক্ষত্রের আলো মিটমিট করে, কিন্তু গ্রহের আলো স্থির । রাতের আকাশে তাই নক্ষত্রের ভিড়ে গ্রহগুলো এক আলাদা ‘পার্সোনেলিটি’ নিয়ে সবার সামনে হাজির হয় । এবার জেনে নেওয়া যাক গ্রহদের অবস্থান গুলো । আজ সন্ধ্যা ৫:৩০টে থেকে ৬:০৫ পর্যন্ত পশ্চিম আকাশে চোখ রাখলেই নজরে আসবে গুরুজী বৃহস্পতি আর তাঁর দুই শিষ্য শুক্র আর বুধের অসাধারণ নৃত্য । এদের ঠিক উপরেই চাঁদমামা মুচকি হেসে ট্যারা চোখে পুরো ঘটনা পর্যবেক্ষণ করবেন, আর সবার অলক্ষ্যে অল্পবিস্তর কোমরও দোলাবেন । এই তিনটি গ্রহ আর চন্দ্র তখন পশ্চিমাকাশে প্রায় সরলরেখায় অবস্থান করবে । এদিকে পূর্বাকাশে নজরে আসবে তখন আর এক দৃশ্য! ‘লালুজী’ মানে ‘লালগ্রহ মঙ্গল’ চুপচাপ পূর্বদিকে দাঁড়িয়ে পরবর্তী দৃশ্যপটের জন্য নিজেকে তৈরী করবেন । পশ্চিমাকাশের নৃত্যের রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই পূর্বাকাশে শুরু হয়ে যাবে লালুজীর ‘রক ডান্স’ । তাঁর রকডান্সে সঙ্গত করতে রাত প্রায় সাড়ে নয়টায় জবরদস্ত ‘এন্ট্রি’ মারবেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি শনি । রাশগম্ভীর শনিকে দেখে আপাতত ভয় পাবার কিছু নেই, কারণ তিনি নৃত্যে ব্যস্ত থাকার দরুণ আমাদের ঘাড়ে চেপে উঠবারও ভয় নেই । নির্দ্বিধায় রাতের লাইভ শো-এর মজা উপভোগ করা যাবে ।  সারাটা রাত ধরে চলবে হাসি হুল্লোরের ফোয়ারা । তারপর কিভাবে রাত কেটে ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় কোকিলের গানে সকালের শুরুয়াত হয়ে যাবে বোঝাই যাবেনা । বসন্তের এই মাসে ঘুম বাবাজীকে এক রাতের জন্য ‘ডিভোর্স’ দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে মন্দ লাগবে না, কি বলেন ?  

Wednesday, January 25, 2012

পৃথিবীতে আছড়ে পড়লো বৃহৎ সৌরঝড়




সূর্যের এই আজব ব্যামো হলেই চঞ্চল হয়ে ওঠে পৃথিবী । কারণ সূর্যের এই সাময়িক রোগ হলে  পৃথিবীকে যে নানা অশান্তির সম্মুখীন হতে হয় ! তাঁর এই ব্যাধি নিয়ে আবার চিন্তিত ধরিত্রীর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও আসলে সূর্য বাবাজির হাঁচির এক ব্যামো আছে যা কিছু বছর পর পর ঘুরে ফিরে আসে । গত ২৩ জানুয়ারি ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে নয়টায় তাঁর এক বিকট হাঁচি অশান্তির ঝড় তুললো পৃথিবীতে ।
পৃথিবীর সবথেকে কাছের নক্ষত্র সূর্য আমাদের সব শক্তির উৎস । সূর্যের অন্দরে পরমাণুর প্রতিনিয়ত বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে অফুরন্ত শক্তি । প্রায় পনেরো কোটি কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে বিকিরণের মাধ্যমে মাত্র ৮.৩ মিনিটে সূর্য থেকে সেই ভাণ্ডার পৃথিবীতে চলে আসে । পাশাপাশি ক্ষতিকারক রশ্মিও পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এসে পৌছায়, কিন্তু ওজোনস্তরের উপস্থিতির জন্য সেগুলো পৃথিবীতে পৌছাতে পারেনা । এ ছাড়া পৃথিবীর নিজস্ব চৌম্বকক্ষেত্রও এক্ষেত্রে বর্মের মত কাজ করে । তাই সভ্যতার শুরুয়াত থেকেই জীবজগত সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে সুরক্ষিত আছে । কিন্তু কখনো কখনো সূর্যের সরবরাহকৃত শক্তির যোগান হঠাৎ বেড়ে যায়, আর তখনই হয় বিপত্তি । বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ‘সৌরঝড়’ তবে এই ঝড় একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর হয় ।
     সূর্যের উপর নজরদারি করার জন্য মহাকাশ বিজ্ঞানীরা নানা কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে প্রেরণ করেছেন । সেই মহাকাশযানগুলো থেকে পাঠানো তথ্য সমৃদ্ধ করেছে সৌরবিজ্ঞানকে । সৌরজগতের সবথেকে কাছের নক্ষত্র হল-প্রক্সিমা সেন্টরাইসূর্য থেকে এর গড় দূরত্ব হল প্রায় ৪.২ আলোকবর্ষ (এক আলোকবর্ষ = ৯৫০০০০ কোটি কিলোমিটার)এত দূরত্বে তার এই অবস্থানের জন্য পৃথিবী থেকে শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেও তাকে বৃহদাকারে দেখা সম্ভব হয় না । তাই আমাদের সবথেকে কাছের তারা সূর্যের জন্মবৃত্তান্ত অধ্যয়ন করলেই জানা যাবে দূরবর্তী নক্ষত্র সম্বন্ধে নানা অজানা তথ্য । দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় তার গাত্রে নানা দাগ । যাকে সৌরকলঙ্ক (‘সানস্পট’) বলা হয় । গ্যালিলিও সর্বপ্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্রের দ্বারা এই দাগ দেখতে পান । এই দাগের সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট সময় পর বেড়ে যায় আর এর সময়কাল হচ্ছে এগারো বছর ! ২০০১ সালে সৌরকলঙ্কের উপস্থিতি  সবথেকে বেশী ছিল । আর তাই এই বছর স্বাভাবিক ভাবেই সৌর দাগের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান । মজার ব্যাপার হল  সেই সময় সূর্যের চঞ্চলতাও বেড়ে যায় যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে পৃথিবীতে ।      
নাসার বিজ্ঞানীরা গত ২৩ জানুয়ারি সূর্যের আকস্মিক বিস্ফোরণ ‘সোলার ডাইনামিকস অবজারভেটরি স্পেস ক্রাফট’-এ বিদ্যমান উচ্চ প্রযুক্তির ক্যামেরার সাহায্যে ভিডিও রেকর্ড করেছেন । বিজ্ঞানের ভাষায় এই বিস্ফোরণকে ‘করন্যাল মাস ইজেকশন’ বলা হয় । এই ইজেকশন হলে সূর্য থেকে আগত বিকিরণের মাত্রাও তখন বেড়ে যায় । এ যেন সূর্যের হাঁচি দেওয়ার মত ঘটনা । আর সূর্যের এই হাঁচিতে সৃষ্টি হয় ‘সৌরঝড়’ আগামী বুধবার পর্যন্ত এই ঝড়ের প্রকোপ থাকবে । এখানে উল্লেখ্য যে সৌর বিকিরণ ঝড়ের ফলে মূলত: সূর্য থেকে উচ্চ শক্তির প্রোটন কণা নির্গত হয় । ‘এই ঝড়ের প্রকোপ ২০০৫ সালের মে মাসে হওয়া করন্যাল মাস ইজেকশন থেকেও অনেক বেশী’ – বলেছেন নাসার বিজ্ঞানি ডঃ ডউগ বিসেকার সূর্যের আবহমণ্ডল অধ্যয়ন করার জন্য ১২টি কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবী থেকে প্রেরণ করা হয়েছে যারা প্রতিনিয়ত সূর্যের উপর নজরদারি রাখছে ।
     সৌরঝড়ের আবির্ভাবে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয় । আমাদের বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগে যেসব ‘কমুনিকেশন স্যাটেলাইট’ রয়েছে সেগুলোর উপর সব থেকে বেশী প্রভাব পড়ে । সূর্য থেকে আসা উচ্চশক্তির কণার আঘাতে ঐ স্যাটেলাইট গুলোর নানা যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে যায়,  যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থায়মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত টিভি চ্যানেল, বিমান পরিষেবা, ব্যাংকিং পরিষেবা ইত্যাদি মারাত্মক ভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয় ।  বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়ে । ২০০৫ সালের মে মাসেও তেমন সৌরঝড়ের ঘটনা ঘটেছিল । এছাড়া রয়েছে ক্ষতিকারক রশ্মির পৃথিবীতে ঢুকে পড়ার আশঙ্কা । আসলে বায়ুমণ্ডলে ওজোনস্তরের উপস্থিতির জন্য অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে পৌছাতে পারেনা । কিন্তু পরিবেশ প্রদূষণের ফলে ওজোনস্তরে দেখা দিয়েছে ফুটো, আর এ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন বিজ্ঞানীরা । এই অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে এসে পৌঁছালে মানবদেহে নানারকম চর্মরোগ দেখা দেবে । এমনকি স্কিন ক্যান্সারও হতে পারে । এছাড়া আরও নানারকম সর্বনাশা রোগের জন্ম হবারও সম্ভাবনা রয়েছে । সূর্যের সুনামির জন্য তাই পৃথিবী বাসির আতঙ্কিত হওয়া স্বাভাবিক ।     
     সৌরঝড় একটি প্রাকৃতিক ঘটনা । একে নিয়ন্ত্রিত করার ক্ষমতা বিজ্ঞানেরও নেই ! কিন্তু পৃথিবীর পরিবেশকে নিয়ন্ত্রিত করার ক্ষমতা আমাদের আছে । ওজোনস্তরের প্রলেপকে রক্ষা করার দায়িত্বও তাই পৃথিবী বাসির । কিন্তু এনিয়ে ভাবার সময় কি আমাদের আছে?

Saturday, January 14, 2012

হ্যাপি নিউ ‘হ্যাংকে -হেনরি পার্মানেন্ট ক্যালেন্ডার’




কেমন হবে যদি ...
১) দৈনন্দিন ব্যবহৃত ক্যালেন্ডারটি বছর বছর পরিবর্তন করতে না হয় !
২) জন্মের বার প্রতি বছর একই হয় !
          ৩) নূতন বছরের প্রথম দিন সবসময় রবিবার হয় !
          ৪) ক্যালেন্ডারটিতে ৩০ দিনের মাস আটটি হয় !
৫) ফেব্রুয়ারি মাস ৩০ দিন এবং জুন আর সেপ্টেম্বর মাস ৩১ দিনের হয় !
৬) জানুয়ারি, মে, জুলাই, আগস্ট আর অক্টোবর মাস ৩০ দিনের হয় !
৭) ক্যালেন্ডারটিতে কোনও বছর ৩৬৪ দিন আবার কোনও কোনও বছর ৩৭১ দিনের হয় !
... খুব মজাই হবে, তাই না ?
তেমনই এক অভিনব ক্যালেন্ডার গত ১লা জানুয়ারি ২০১২ থেকে বেসরকারিভাবে শুরু করে দিয়েছে ‘দ্য হেনরি ফাউন্ডেশন’ । ‘হ্যাংকে–হেনরি পার্মানেন্ট ক্যালেন্ডার’ নামের এই ক্যালেন্ডারটি নিয়েই এখন সারা বিশ্বে চর্চা তুঙ্গে । নেপথ্যে রয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনস হোপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী -রিচার্ড কন হেনরি আর ওয়াইটিং স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অর্থনীতিবিদ -স্টিভ হ্যাংকে । প্রচলিত ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’-টির আমূল পরিবর্তন করে নূতন ক্যালেন্ডার প্রচলনের পেছনে রয়েছে তাঁদের সুদীর্ঘ কয়েক বছরের অক্লান্ত গবেষণা । সারা বিশ্বের জনমত সংগ্রহের লক্ষ্যে ক্যালেন্ডারটি ইতিমধ্যে ফাউন্ডেশনের ওয়েবপেজে রাখা হয়েছে । বিশ্বের তামাম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মতি হাসিল হলেই ক্যালেন্ডারটি আগামী ১লা জানুয়ারি ২০১৭ থেকে চালু হয়ে যাবে ।
     সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই মানুষ দিনের হিসেবের জন্য ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে আসছে । দেশ কাল ভেদে ক্যালেন্ডারের প্রকারও ছিল ভিন্ন । এর মধ্যে হিন্দু, বাহাই, চায়নিজ, জাপানি, হিব্রু, ইসলামিক, পার্সিয়ান, গ্রেগরিয়ান, জুলিয়ান ক্যালেন্ডারগুলি অন্যতম । মূলত: চন্দ্র আর সূর্যের মাসিক বা বার্ষিক গতির উপর ভিত্তি করেই ক্যালেন্ডার নির্মাণ হতো । চন্দ্রের প্রাত্যহিক গতির উপর নির্ভর করে বানানো ক্যালেন্ডার কে ‘লুনার ক্যালেন্ডার’ বা চন্দ্র ক্যালেন্ডার বলা হয় । যেমন – ইসলামিক ক্যালেন্ডার । সূর্যের বার্ষিক গতির উপর ভিত্তি করে বানানো ক্যালেন্ডারকে ‘সোলার ক্যালেন্ডার’ বলা হয়ে থাকে । যেমন – পার্সিয়ান, জুলিয়ান, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ইত্যাদি । চন্দ্র আর সূর্য উভয়ের গতির উপর ভিত্তি করে ‘লুনি-সোলার ক্যালেন্ডার’ বানানো হয়েছিল । যেমন – হিন্দু, হিব্রু, চায়নিজ ক্যালেন্ডার ইত্যাদি । দেখা গেছে যে সূর্যের বার্ষিক গতির উপর ভিত্তি করে বানানো ক্যালেন্ডারটিই বিজ্ঞান সম্মতভাবে সঠিক । ক্যালেন্ডারের বিবর্তনের ইতিহাস খুবই চমকপ্রদ যা এই স্বল্প পরিসরে ব্যক্ত করা সম্ভব নয় । তবে ‘জুলিয়ান  ক্যালেন্ডার’ আর ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’-এর ব্যাপারে একটু জেনে নেওয়া দরকার । বিখ্যাত রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের নামেই জুলিয়ান ক্যালেন্ডার এর নামকরণ হয় । ৪৫ খৃঃ পুঃ তে জুলিয়াস সিজার এই ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন । জুলিয়ান বছরের সময় কাল ৩৬৫ দিন, যাকে ১২টি মাসে বিভক্ত করা হয় । জুলিয়াস সিজারের সময় কালেই ‘লিপ ইয়ারে’ ফেব্রুয়ারিতে একটি অতিরিক্ত দিনের সংযোজন হয় । এর মানে জুলিয়ান বছরের গড় সময় কাল ৩৬৫.২৫ দিন । বলাবাহুল্য যে এই ক্যালেন্ডার সৌর কেন্দ্রিক ছিল । কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা যায় যে সৌরবছরের নির্ভুল সময় হল ৩৬৫.২৪২৫ দিন । এর মানে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে সৌরবছরের হিসেব ১১ মিনিট বেশী ধরা হয়েছিল । পরে হিসেব করে দেখা গেল যে এই ১১ মিনিটের হিসেবের গরমিলের জন্য প্রতি চার শতাব্দীতে তিন দিন অতিরিক্ত সংযোজন হয়ে গেছে । পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি ১৫৮২ সালে সেই ভুল সংশোধন করে তখনকার প্রচলিত জুলিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে ১০ দিন কমিয়ে দেন । আর সেটি করতে ১৫৮২ সালের অক্টোবর মাস থেকে দশটি দিন কেটে হিসেবের গরমিলকে দূর করা হয় । ১৫৮৩ সাল থেকে আবার অক্টোবর মাস ৩১ দিনের হয়ে যায় । গ্রেগরির নামানুসারেই এটিকে ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’ বলা হয়ে থাকে । তবে এই ক্যালেন্ডার সব দেশে প্রচলিত হতে হতে বেশ কয়েকবছর কেটে যায় । বর্তমানে এটিই আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডার যা বিশ্বের প্রতিটি দেশ ব্যবহার করছে ।   
     এবার জেনে নেওয়া যাক নূতন ক্যালেন্ডার সম্পর্কে । ছবিতে দ্রষ্টব্য ‘হ্যাংকে–হেনরি পার্মানেন্ট ক্যালেন্ডার’-এর চিত্রটির একেবারে উপরের দিকে তাকালেই দেখা যাবে যে এতে কিন্তু কোন বছরের উল্লেখ নেই । এর মানে ক্যালেন্ডারটি প্রতি বছর বদল করার কোনও প্রয়োজন নেই । এই ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস প্রচলিত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ২০১২ এর জানুয়ারি মাসের মতই । তবে নূতন ক্যালেন্ডারে জানুয়ারি মাস ৩০ দিনের । তাই ঐ তারিখের পরই গ্রেগরির সঙ্গে হ্যাংকে-হেনরির পা মিলিয়ে চলার ছন্দে ইতি ঘটবে । নূতন ক্যালেন্ডারে ফেব্রুয়ারিকে লিপ ইয়ারে আত্মত্যাগ করতে হবেনা । তাকে যথাযোগ্য মর্যাদায়  ৩০ দিনে ফিরিয়ে আনা হয়েছে । এটির সব থেকে মজার ব্যাপার হল ক্যালেন্ডারের মধ্যের বর্ডার লাইন একটি দর্পণের মত কাজ করছে । জানুয়ারি মাসের প্রতিবিম্ব জুলাই মাস, ফেব্রুয়ারির প্রতিবিম্ব আগস্ট মাস ইত্যাদি । প্রথম ছয়টি মাসের বারের বিন্যাস গুলিই আবার পরবর্তী ছয় মাসে ফিরে আসছে । আর একটি উল্লেখ যোগ্য ব্যাপার হল নূতন ক্যালেন্ডারে জুন আর সেপ্টেম্বর মাস ৩১ দিনের হয়ে গেছে যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ৩০ দিনের ছিল । এ ছাড়া জানুয়ারি, মে, জুলাই, আগস্ট আর অক্টোবর মাসগুলিরও এক দিন কর্তন হয়ে ৩০ দিনের করে দেওয়া হয়েছে । এই ক্যালেন্ডার মনে রাখার সহজ উপায় হল মার্চ মাসই প্রথম মাস যা ৩১ দিনের,  এর ঠিক তিন মাস পর পর ৩১ দিনের মাস আসবে । তার মানে জুন, সেপ্টেম্বর আর ডিসেম্বর ৩১ দিনের । 
২০১৭ থেকেই বা ক্যালেন্ডার শুরু করার প্রস্তাব কেন করা হয়েছে ? আসলে ২০১২ এর ১লা জানুয়ারির ঠিক পাঁচ বছর পর ২০১৭ এর ১লা জানুয়ারিতেই আবার একই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ঘুরে আসছে । তার মানে বছরের প্রথম দিনই রবিবার মানে সপ্তাহের প্রথম দিন । হেনরি ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে প্রস্তাব রাখা হয়েছে যে ১লা জানুয়ারি তারিখ থেকেই ‘আন্তর্জাতিক সময়’ ২৪ ঘণ্টা স্কেলের নিরিখে গণনা করা যেতে পারে । বিশ্বের প্রতিটি দেশে তারপর সময় আর তারিখ একই থাকবে । সময় আর তারিখ নিয়ে আর ঝঞ্ঝাট থাকবেনা । এটা সর্বজন বিদিত যে প্রশান্ত মহাসাগরের ১৮০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশের উপর অবস্থিত উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু অবধি কাল্পনিক রেখাকে ‘আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা’ বলা হয়ে থাকে । ধরে নেওয়া যাক ঐ রেখার বাঁদিকের কোন দেশের তারিখ ২২শে জানুয়ারি, তাহলে রেখাটির ডান দিকের দেশের তারিখ হবে ২১ জানুয়ারি । কিন্তু  নূতন ক্যালেন্ডার প্রবর্তিত হয়ে গেলে ‘আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা’-এর অস্তিত্বও বিলুপ্ত হয়ে যাবে । লন্ডনের গ্রিনউইচ মান মন্দিরে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬-তে ঠিক রাত বারোটার পরই গণনা শুরু হয়ে যাবে নূতন ‘আন্তর্জাতিক সময়’ । ১লা জানুয়ারি ২০১৭-তে সবদেশেই তখন হয়ে যাবে একই তারিখ, একই সময় । সেটা ব্রিটেন, রাশিয়া, ভারত, জাপান বা আমেরিকা যে দেশই হোক না !
     ‘আমাদের এই নূতন ক্যালেন্ডার প্রস্তাব রাখার মূল উদ্দেশ্যই হল জনসাধারণকে একটি স্থায়ী ক্যালেন্ডার উপহার দেওয়া যা বছরের পর বছর অপরিবর্তিত থাকবে । স্কুল, কলেজ থেকে কর্পোরেট সেক্টর সবাই সারা বছরের কর্মযজ্ঞ একবার ভাল করে ঠিক করে নিলে বছর বছর পরিবর্তন করতে হবে না’ । বলছেন রিচার্ড কন হেনরি, যিনি মেরিল্যান্ড স্পেস গ্র্যান্ট কনসরসিয়াম এরও ডিরেক্টর । তাঁর দৃঢ় আশা যে বিশ্বের জনসাধারণ এই ক্যালেন্ডার থেকে নানা ভাবে উপকৃত হবেন । আসলে এই ক্যালেন্ডারটি বব ম্যাকক্লেননের ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত ক্যালেন্ডারের সংশোধিত রূপ ।
     নুতন ক্যালেন্ডারে মোট দিন রয়েছে ৩৬৪ দিন । কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু বছরে সেটা হয়ে দাঁড়ায় ৩৭১ দিনে । কেন ? ব্যাপারটি বুঝতে হলে আমাদের আবার পৃথিবীর বার্ষিক গতির সময়ের দিকে চোখ রাখতে হবে । পৃথিবীকে সূর্যের চারিদিকে পাক খেতে সময় লাগে ৩৬৫.২৪২৫ দিন । ৩৬৪ দিনের ক্যালেন্ডার হওয়ায় এই অতিরিক্ত ১.২৪২৫ দিনকে মিলানোর জন্য প্রতি ৫ বা ৬ বছর পর অতিরিক্ত একটি সপ্তাহ ডিসেম্বরের পর জুড়ে দেওয়া হয়েছে । যাকে ‘লিপ উইক’ নামকরণ করা হয়েছে । সেই বছর গুলো হল ২০১৫, ২০২০, ২০২৬, ২০৩২, ২০৩৭, ২০৪৩, ২০৪৮, ২০৫৪, ... ইত্যাদি । ছবিটিতে  Xtr হল সেই অতিরিক্ত সপ্তাহ । আর তখন সেই নির্দিষ্ট বছর হয়ে যাবে ৩৭১ দিনের ।   
     এই ক্যালেন্ডারের সুবিধা কি ? কোনও ব্যক্তি যদি ১৭ ডিসেম্বর জন্মান তাহলে প্রতি বছরই তাঁর জন্মবার শনিবার থাকবে । তার মানে জন্মের বার কারও পরিবর্তিত হবেনা । ছুটির দিন পূর্ব নির্ধারিত থাকবে । বড়দিন আর ১লা জানুয়ারি প্রতি বছরই রবিবার থাকবে । গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের মত ছুটির বার নিয়ে আর অনিশ্চয়তা থাকবে না । ছুটির দিন প্রতি বছর বাড়া বা কমার ঝক্কি থাকবে না । আর প্রতি বছর ছুটির তালিকা বানানোর জন্য বৃথা সময় নষ্টও হবেনা । ‘আমাদের ক্যালেন্ডার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের জটিল হিসেব নিকেশ সহজ করে দেবে । স্থায়ী ক্যালেন্ডারের দৌলতে ব্যাঙ্কের সুদের হিসেব নিকেশ থেকে ধরে অন্যান্য কাজও অনেক সুবিধেজনক হয়ে যাবে । তাই এই ক্যালেন্ডার অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আমাদের লাভবানই করবে’ । বলছেন অর্থনীতিবিদ তথা এই ক্যালেন্ডারের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ডঃ স্টিভ হ্যাংকে । ক্যালেন্ডারে ৩১শে মার্চ শনিবার থাকায় নানা দেশের মত আমাদের দেশেও অর্থনৈতিক বছরের শেষে আর্থিক লেনদেনের সুবিধেই হবে । এর আগেও কিছু গবেষক বিকল্প ক্যালেন্ডারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন যেখানে সপ্তাহ সাত দিনের বদলে ছয় দিনের কথা বলা হয়েছিল । তবে সাত দিনের সপ্তাহের মিথ ভেঙ্গে কারো সম্মতি মিলেনি নুতন ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের । কিন্তু ‘হ্যাংকে–হেনরি পার্মানেন্ট ক্যালেন্ডার’-এ সপ্তাহ সাত দিন রাখার ফলে সেটা রয়েছে বেশ সুবিধেজনক অবস্থায় ।  
     নুতন ক্যালেন্ডারে যে অসুবিধে হবেনা এমন নয় । যাদের জন্ম ইতিমধ্যে ৩১শে জানুয়ারি হয়ে গেছে তাঁরা নুতন ক্যালেন্ডার প্রবর্তিত হয়ে গেলে তো ইহ জীবনে জন্মদিন উদযাপন করতে পারবেন না । যারা ডিসেম্বরের মাসের পর অতিরিক্ত সপ্তাহে জন্মেছেন তাঁদের তো পাঁচ বা ছয় বছর পর সেই দিন ঘুরে আসবে । যদিও হেনরি ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে বলা হয়েছে যে ৩১শে জানুয়ারিতে যাদের জন্ম তাঁরা  জানুয়ারির শেষ দিন মানে ৩০শে জানুয়ারিতে জন্মদিন উদযাপন করতে পারেন; কিন্তু সেটাও তো মেনে নেওয়া যায়না । সৌরবছরের সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার । কিন্তু অপরিবর্তিত ক্যালেন্ডার থাকার দরুণ ‘হ্যাংকে–হেনরি ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সৌরবছরের ছন্দ পতন ঘটবে । এ ছাড়া ২০১৫, ২০২০, ২০২৬ ‘লিপ ইয়ার’-এর  অতিরিক্ত সাত দিনের জন্য তো আলাদা ভাবে ভাবতে লাগবে । কারণ এই সাত দিন শ্রমিকেরা ডিসেম্বর মাসের শেষে কাজ করলে অতিরিক্ত বেতন পেতে পারেন কিনা সেটাও ভেবে দেখা দরকার । এই ক্যালেন্ডার নিয়ে তাই সারা বিশ্বে শুরু হয়েছে তর্ক-পাল্টা বিতর্ক । রাষ্ট্রপ্রধানরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দিকের ব্যাপারগুলো খতিয়ে দেখবেন ।  সব দেশেই যে আগামী ২০১৭ তে এই ক্যালেন্ডার মেনে নিতে পারে এরও কোনও নিশ্চয়তা নেই । আর যেহেতু প্রতি দেশের ঘড়ির সময় আলাদা, তাই একক আন্তর্জাতিক সময় মেনে নেওয়ার ব্যাপারেও থাকবে নানা প্রতিবন্ধকতা । সব মিলিয়ে বেশ কাঠখড় পুড়িয়েই এগোতে হবে হ্যাংকে–হেনরি ক্যালেন্ডারকে । তবুও তাঁদের বিশ্বাস পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি যেমন ১৫৮২ সালে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার সংস্কার করেছিলেন, ২০১৭ সালে হ্যাংকে–হেনরিও সেই অসাধ্য সাধন করতে পারবেন ।