Wednesday, November 24, 2010

মহাযন্ত্রের আঁতুরঘরে অবশেষে জন্ম হল ‘অ্যান্টিম্যাটার’-এর


১৭ নভেম্বর ২০১০ । ‘নেচার’ সাময়িকীতে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হবার পর বিজ্ঞানের জগতে সেটি এক ‘মহাবিস্ফোরণ’ ঘটালো ! বিশ্বের সর্ববৃহৎ যন্ত্রের আঁতুরঘরে অবশেষে জন্ম হল ‘অ্যান্টিম্যাটার’ এর যা শুধু এতদিন তাত্বিক জগতে সীমাবদ্ধ ছিল । ডঃ জি বি অ্যান্ড্রিসেন আর তার সহযোগী ৪১ জন বিজ্ঞানীদের তপস্যায় মুগ্ধ হয়ে ‘অ্যান্টিহাইড্রোজেন’ স্বল্প সময়ের জন্য আবির্ভূত হলেন বিজ্ঞানীদের সম্মুখে ।
‘এল এইচ সি’ (লার্জ হ্যাডরন কলাইডার) নামটি অনেকআগেই বিজ্ঞানীদের গন্ডি অতিক্রম করে সাধারণ মানুষের অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছে । ‘দ্য ইউরোপিয়ান অর্গেনাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ’ (সার্ন) এর বদান্যতায় তৈরী এটিই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ যন্ত্র ! ফ্রান্স এবং স্যুইজারল্যান্ডের সীমানার ২৭ কিলোমিটার পরিধির বৃত্তাকার এক টানেলের মধ্যেই তার আবাস । সারা বিশ্বের প্রায় দশহাজার বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়ারদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই যন্ত্রটির অবস্থান মাটির তলায় ১৭৫ মিটার নিচে যা বানাতে খরচ হয়েছে প্রায় ৯০ কোটি ডলার ! মহাবিশ্বের জন্মরহস্য অনুসন্ধান, ‘ভগবান কণা’ (বা ‘হিগস কনা’) এর পরীক্ষামূলক অস্তিত্বের সন্ধান, ‘ডার্ক ম্যাটার’ আর ‘ডার্ক এনার্জি’ এর রহস্য উন্মোচনের পাশাপাশি ‘গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন থিওরি’ তৈরীর লক্ষেই ‘এল এইচ সি’ –এর জন্ম ।
          জন্মের মুহূর্ত থেকেই ‘এল এইচ সি’ বিতর্কের ঘেরাটোপে । খবরের শিরোনাম দখল করার এক অদৃশ্য তাগিদ যেন তার জন্ম কুন্ডলিতে লিখে রেখেছেন বিজ্ঞানীরা ! ১০ সেপ্টেম্বর, ২০০৮ এ তার আবির্ভাবেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ‘বিগব্যাং’ বা ‘মহাবিস্ফোরণ’-এর আতঙ্ক ছড়িয়ে যায় । এক মহল থেকে প্রচার করা হয়েছিল ‘এল এইচ সি’ তে যে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরিক্ষা করা হচ্ছে তার ফলে নাকি আমাদের গ্রহ চিরতরে নির্মূল হয়ে যেতে পারে । কিন্তু সেই অপপ্রচারে বিজ্ঞানের তেমন ক্ষতি হলনা । ‘এল এইচ সি’ এর বিজয় রথ এগিয়ে যেতেই লাগলো । ৩০শে মার্চ, ২০১০ সালে আবারও সে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসলো । প্রায় আলোর গতিতে ধেয়ে আসা দু’টি প্রোটনের সংঘর্ষে সর্বপ্রথম ৭ টেরা ইলেক্ট্রনভল্টের শক্তি সৃষ্টি হল মানবসৃষ্ট ল্যাবরেটরিতে । গবেষণার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এ ছিল এক অনন্য অগ্রসরতা । আর সাম্প্রতিক খবর তো অন্য সব খবরকে পিছনে ফেলে দিয়েছে ।
আমাদের এই বস্তু জগৎ সৃষ্টির নেপথ্যে রয়েছে নানাবিধ কণার সংমিশ্রণ । যেমন – ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন । এ ছাড়াও রয়েছে আরো অনেক কণা । একটি মানুষ সৃষ্টির নেপথ্যেও রয়েছে লক্ষকোটি কণার সমন্বয় । এই কণাদের জগৎটাও বড় বিচিত্র আর রহস্যময় ! এর কুহেলিভরা চরিত্র মোহিত করে রেখেছে গবেষকদের । আসলে এই কণাগুলির চরিত্রের গভীরেই লুকিয়ে রয়েছে মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্যের চাবিকাটি । প্রচলিত থিওরি মতে এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমেই এই মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল যাকে ‘বিগ ব্যাং’ বলা হয়ে থাকে । এই বিস্ফোরণের পর ‘ম্যাটার’ (বা ‘পদার্থ’) আর ‘অ্যান্টিম্যাটার’ (বা ‘বিপরীত পদার্থ’) দু’টিই তৈরী হয়েছিল । কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বর্তমান বিশ্ব ‘ম্যাটার’ দিয়েই তৈরী, আর আশ্চর্যজনকভাবে ‘অ্যান্টিম্যাটার’ অনুপস্থিত । যদি কখনো ‘ম্যাটার’ আর ‘অ্যান্টিম্যাটার’ এর মিলন হয় তখন বিস্ফোরণ হয়ে বিপুল পরিমানের শক্তি সৃষ্টি হয় । মজার ব্যাপার হল অ্যান্টিম্যাটারের অনুপস্থিতির জন্য আমরাও বহাল তবিয়তে রয়েছি এই ব্রহ্মান্ডে । এই অ্যান্টিম্যাটারের অস্তিত্বের কথা ১৯৩১ সালে সর্বপ্রথম পল ডিরাক নামক এক বিজ্ঞানী অনুমান করেছিলেন । সুদীর্ঘ ৬৯ বছর পর অ্যান্টিম্যাটারের পরীক্ষামূলক উপস্থিতি বিজ্ঞানীদের হিসেব নিকেশ অনেক পাকা করলো । বলা যায় মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে এটি এক ধাপ এগনো । ‘এল এইচ সি’ নির্মাণের এক গুরূত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল ল্যাবরেটরিতে অ্যান্টিম্যাটার সৃষ্টি করা । কারণ এর অধ্যয়ন এতদিন তত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল । আর পরীক্ষামূলকভাবে ল্যাবরেটরিতে এর সৃষ্টি করা এতদিন অধুরাই ছিল । কিন্তু বিজ্ঞানের জাদুতে অসম্ভবের সীমা অতিক্রম করে সম্ভবের মাইলস্টোন স্পর্শ ‘এল এইচ সি’ এর দৌলতেই অবশেষে সম্ভব হল । ডঃ জি বি অ্যান্ড্রিসেনের তত্বাবধানে ৪১ জন বিজ্ঞানীদের দল ‘এল এইচ সি’ তে ‘অ্যান্টিহাইড্রোজেন’ সৃষ্টি করলেন যার আয়ুকাল ছিল ১৭০ মিলি সেকেন্ড । ‘হাইড্রোজেন’ মৌলের ঠিক বিপরীত চরিত্রের অধিকারী এই ‘অ্যান্টিহাইড্রোজেন’ । খুব স্বল্প সময়ের জন্য একে সৃষ্টি করা হলেও এর আবির্ভাবে কিন্তু অনেক তত্বের প্রতিষ্ঠা পাকাপোক্ত হল । বিজ্ঞানীদের মতে এই অ্যান্টিম্যাটারের পরীক্ষামূলক অধ্যয়ন করে অনেক গুরূত্বপূর্ণ তথ্য জানাও ভবিষ্যতে সম্ভব হবে । মহাবিশ্বের জন্ম রহস্যের কুহেলিও ধীরে ধীরে আমাদের সামনে পরিস্কার হবে । তবে এর জন্য ‘এল এইচ সি’ এর অশ্বমেধ ঘোড়াকে অনেকদূর এগিয়ে যেতে হবে ।
          “আচ্ছা মশাই, ‘অ্যান্টি ইউনিভার্স’ থেকে আমার ‘বিপরীত সত্তা’ যদি আপনাদের সেই বিশাল যন্ত্রের সাহায্যে এই বিশ্বে চলে আসে তাহলে তো মুশকিল । কোথাও ওর সঙ্গে দেখা হবার পর করমর্দন হয়ে গেলে তো আমার অস্তিত্বই থাকবেনা” – বক্তা আমার বাড়ির মালিক । ‘ম্যাটার’ আর ‘অ্যান্টিম্যাটার’ এর মিলন হলে যে কি হবে সেই গূঢ় তত্ব তাহলে তিনি মিডিয়ার দৌলতে ভালই উপলব্ধি করতে পেরেছেন !

Wednesday, September 29, 2010

মোবাইল আতঙ্ক ভিত্তিহীন


“অনুগ্রহ করে ৯৮৮৮৩০৮০০১, ৯৩১৬০৪৮১২১, ৯৮৭৬২৬৬২১১, ৯৮৮৮৮৫৪১৩৭ এবং ৯৮৭৬৭১৫৫৮৭ মোবাইল নাম্বারগুলো থেকে কোন ফোন আসলে ধরবেন না । নাম্বারগুলো সেলফোনে আসলে লাল হয়ে যায় । উচ্চ কম্পনাঙ্কের এই ফোন কল গুলো ধরলে মস্তিষ্কক্ষরণ হতে পারে । ২৭জন মানুষের ইতিমধ্যে মৃত্যু হয়ে গেছে । বিস্তারিত জানার জন্য ডিডি নিউজ, আজতক চ্যানেলে চোখ রাখুন” ।
     আজব এই এস এম এসটি আমার সেলফোনে আসার পর অন্য ফালতু ম্যাসেজের মতই সে মোবাইলের এক বটনের চাপে ‘ডিলিট’ হয়ে গেল । কিন্তু চমক বাকি ছিল ! এই ‘সন্দেশ’-টি যে অনেকের বদহজম হয়েছে তা মিডিয়ার দৌলতে জানতে আর দেরি হয়নি । গুজব আর আতঙ্কের ককটেলে যে এই ‘সন্দেশ’ খবরের শিরোনাম হয়ে যেতে পারে তা বোঝা যায় নি, বা এই মুছে যাওয়া সন্দেশকে নিয়ে যে কলম ধরতে হবে তাও স্বপ্নে ভাবিনি । নিছক একটি ম্যাসেজ, সমস্যা জর্জরিত উত্তরপূর্বে আতঙ্কের নবতম সংযোজন । অলিক আতঙ্কের এই ম্যাসেজ পুজোর আগে আমজনতার কাছে পুজোর চাঁদার থেকেও ভয়ঙ্কর এক জুজু হয়ে ধরা দিয়েছে ।
     বিশ্লেষণে যাবার আগে বলে নেওয়া ভাল যে কোন অপ্রত্যাশিত ফোন কল থেকে মস্তিষ্কক্ষরণ বা মোবাইল ফোনের ব্যাটারি বিস্ফোরণ হবার কোন সম্ভাবনা নেই । আর এটা বিজ্ঞানসম্মত সত্য । 
     মোবাইল ফোনে যখন দুজন ব্যক্তি কথা বলেন তখন উচ্চ কম্পনাঙ্কের (৮০০-১০০০ মেগাহার্জ) বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গের জাদুতেই সেটা সম্ভব হয়, যাকে ‘বাহক তরংগ’ ও বলা হয়ে থাকে । আমাদের কথাবার্তার তরঙ্গকে এই বাহক তরঙ্গ এক মোবাইল ফোন থেকে আর এক ফোনে বহন করে নিয়ে যায় । মানুষের শ্রাব্যতীব্রতা মাপার জন্য একটি একক ব্যবহার করা হয় যাকে ‘ডেসিবেল’ বলা হয় যা শব্দচাপের একক । সাধারণতঃ দু’জন মানুষ যখন কথা বলেন তখন তীব্রতা প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ ডেসিবেল হয় । বিজ্ঞানীদের মতে মানুষের সাধারণ শ্রাব্যসীমা হল প্রায় ৮৫ ডেসিবেল । এর থেকে বেশী হলে মানুষের বধির হবার আশঙ্কা থাকে । এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বজ্রপাতের শব্দ প্রায় ১২০ ডেসিবেল হয়ে থাকে । মোবাইল কোম্পানীদের জন্য সরকারী তরফ থেকে একটা সীমা নির্ধারণ করা থাকে যা কোনমতেই ৮৫ ডেসিবেলের বেশী হতে পারবেনা । তার মানে কোন ক্ষতিকারক উচ্চ কম্পনাঙ্কের তরঙ্গ আমাদের মোবাইল সেটে এসে পৌছাতে পারবেনা । মোদ্দা কথায় মস্তিষ্কক্ষরণের কোন আশঙ্কাই নেই । তাই যে কোন নাম্বার থেকেই ফোন কল আসুক না কেন সেই কল থেকে অন্ততঃ হার্টের সমস্যা, কান দিয়ে রক্ত বের হওয়া ইত্যাদি আজব ঘটনা ঘটার বাস্তব কোন কারণ নেই । আর এটা বিজ্ঞানসম্মত সত্য । 
     মোবাইল বিস্ফোরণ নিয়ে গুজব বর্তমানে চরমে । মোবাইলের ব্যাটারি কখনো কখনো বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে তবে তা কখনো বৃহদাকারে হয়না । নানা কারনে সেটা হতে পারে । ২০০৬ সালে নোকিয়া কোম্পানীর ‘বি এল ৫ সি’ সিরিজের ব্যাটারিতে সমস্যা দেখা গিয়েছিল । ভারতের নানা প্রান্ত থেকে মৃদু বিস্ফোরণের খবরও শুনা যাচ্ছিল । যাই হোক সেই সমস্যা কোম্পানী অচিরেই সমাধান করতে পেরেছিল । টেকনোলজি এক্সপার্টদের মতে কখনো কখনো ব্যাটারি খুব বেশী চার্জিং করলে, অথবা পুরানো ব্যাটারি থেকেও মৃদু বিস্ফোরণ হতে পারে । তবে সেই বিস্ফোরণে ক্ষতির সম্ভাবনা খুব কম । আর কোন ফোনকলের মাধ্যমে মোবাইল বিস্ফোরণ ঘটানো অসম্ভব । 
     এবার আসি মোবাইল ভাইরাস প্রসঙ্গে । ‘মোবাইল ভাইরাস’ হল এক উন্নতমানের প্রোগ্রাম যে নিজে রক্তবীজের মত বংশবৃদ্ধি করে মোবাইলের সফটয়ারের প্রভূত ক্ষতিসাধন করতে পারে । মানুষ যেমন মোবাইল সৃষ্টি করেছে ঠিক তেমনি মোবাইল ভাইরাস সৃষ্টির পুরো কৃতিত্বও কিন্তু কিছু অপরাধপ্রবন মানুষেরই । এই ভাইরাস মোবাইলকে বিকল করে দিতে পারে । মূলতঃ ‘ব্লু টুথ’ এর সাহায্যে গান এবং ভিডিও ডাউনলোড করার সময় ভাইরাসগুলি এক মোবাইল থেকে অন্য মোবাইলে ছড়িয়ে পড়ে । পাশাপাশি ইন্টারনেট থেকেও ছড়িয়ে পড়তে পারে ভাইরাস । সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাতে দেখা গেছে যে কিছু মোবাইল লাল হয়ে গেছে, অথবা নানা আজব নাম্বার মোবাইলের স্ক্রিনে চলে আসছে, এর পেছনেও কিন্তু ভাইরাসের নেপথ্য ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না । তবে কোন ভাইরাস মোবাইলের বিস্ফোরণ অথবা আমাদের দৈহিক অসুস্থতার জন্য কোন ভাবেই দায়ী নয় ! 
     এই সরল মোবাইল সন্দেশটির জন্ম ২০০৭ সালে । আঁতুরঘর - পাকিস্থান । সেখান থেকে আতঙ্কের এই এস এম এস আফগানিস্থানেও আলোড়ন তুলে । গুজবের বিষাক্ত ঝড়ে সেখানের জনজীবন স্তব্ধ হয়ে পড়ে । ‘মোবাইল বিজনেস ম্যাগাজিন’ এর তথ্যমতে পাকিস্থান ও আফগানিস্থান সরকারের তরফ থেকে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে গুজব নিয়ে আতঙ্কিত না হবার কথা প্রচার করা হয় । আফগান টেলিভিশনে সরকারী আধিকারীকেরা সম্ভাব্য গুজব নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি জনসাধারণের সম্মুখে তুলে ধরেন । ৭ এপ্রিল ২০০৭ সালে এই এস এম এস কেসের নেপথ্য চার অপরাধীদের ধরা হয় । এই ‘সন্দেশ’ যে বর্তমানে উত্তরপূর্ব ভারতেই ঝড় তুলেছে এমন নয়, বিশ্বের নানা দেশেও তা ছড়িয়ে পড়েছে । সম্প্রতি সুদান, কেনিয়াতেও চলছে গুজবের রাজত্ব । সে দেশের সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রকের তরফ থেকেও গুজবে কান না দেবার কথা বহুলভাবে প্রচার করা হয়েছে । সবথেকে মজার ব্যাপার হল আমাদের এখানের মোবাইলে যে ম্যাসেজ এসেছে তা ২০০৭ সালের ম্যাসেজটির হুবহু নকল । শুধু স্থানকাল ভেদে নিউজ চ্যানেলের নাম পরিবর্তিত হয়েছে । সেই ম্যাসেজেও ২৭জন মানুষের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছিল । আর ম্যাসেজের ৫ টি নম্বরও অপরিবর্তিত । ম্যাসেজ একই, কিন্তু এখন সে দেশের সীমা অতিক্রম করেছে । এই প্রবন্ধ লেখার কারণে নানা মোবাইল ফোন পরিষেবা বিতরণকারীদের সঙ্গে ই-মেলে যোগাযোগ করা হলে তারাও সবাই এই গুজবে কান না দেবার কথা বলেছেন । আসলে এই ভুয়ো ম্যাসেজের বাড়বাড়ন্ত রুখতে আমাদের সম্মিলিত প্রয়াস দরকার ।
     মোবাইল ফোনের ক্ষতিকারক প্রভাব নিয়েও সারা বিশ্বে গবেষনা হচ্ছে । তবে তা মূলতঃ দীর্ঘসময় সেলফোন ব্যবহার কেন্দ্রিক । ২০০৫ সালে গবেষক এস লোন আর তার সহযোগীরা আমেরিকান জার্নাল অফ এপিডেমিওলোজিতে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন । গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল ‘লং টার্ম মোবাইল ফোন ইউস এন্ড ব্রেইন টিউমার রিস্ক’ । দেখা গেছে, যারা খুব বেশী মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন তাদের ব্রেন টিউমার হবার সম্ভাবনাও বেড়ে যায় । এ ছাড়া আরো ভয়ঙ্কর কথা শুনিয়েছেন বিজ্ঞানীরা । পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাবার সম্ভাবনাও বাড়ছে – ২০০৭ এ প্রকাশিত একটি গবেষনণাপত্রে এমনই আশঙ্কা করেছেন আর্থার ডোইয়াক আর তার সহযোগীরা । এছাড়া আরো অনেক অপকারিতার খবরও লুকিয়ে রয়েছে মোবাইল ফোনের ব্যবহারে । তবে এসব ক্ষেত্রে অনেকদিন ফোন ব্যবহার করলেই এই দুর্ভোগ দেখা দিতে পারে । তবে তাৎক্ষণিক ক্ষতির কথা বিজ্ঞানীরা একযোগে অস্বীকার করেছেন ।
     শেষ পাতে পরিবেশন ! গত তিনদিন আগে আমার মোবাইলে এক অজানা ফোন কল আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার মা আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েন । নাম্বারটি দেখে ‘ল্যান্ডলাইন নাম্বার’ বলে মা-কে আশ্বস্ত করলাম । অপরপ্রান্ত থেকে আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধুর পরিচিত কন্ঠস্বর –‘এখনই সেল স্যুইচ অফ কর । শুনিসনি যে কোন সময় অজানা ফোনকল এসে সেলফোনের বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে । আমাদের পাড়াতে ঘোষণা হয়ে গেছে । সবার সেল স্যুইচ অফ । তোর ফোন তো এখন তাজা বোমা’ । মা-কে কথোপকথনের রিপোর্ট দিলাম না । টেবিলের উপর চুপচাপ শুয়ে থাকা তাজা বোমাটির উপর চোখ পড়লো । সে নীরবে শুয়ে আছে, আর তাকে নিয়েই চলছে সারা বিশ্বে নানা খেলা !

Tuesday, August 24, 2010

চাঁদের আকার দিন দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে, দাবি নাসার বিজ্ঞানীদের




চাঁদ নিয়ে জবর খবর তাদেরকে রাতারাতি ‘তারকা’ বানিয়ে দিল ! ‘সায়েন্স’ জার্নালে গত ২০শে আগষ্ট, ২০১০ গবেষণাপত্রটি বের হবার পর বিজ্ঞানীমহলে আলোড়ন তুললেন থমাস ওয়াটার্স আর তার সহযোগীরা । চাঁদের ব্যাসার্দ্ধ নাকি গত ১০ কোটি বছরে ১০০ মিটার কমেছে, আর ভবিষ্যতে সেটা আরো কমবে ।
    আমাদের পৃথিবীর অতি আদরের উপগ্রহ নিয়ে বিজ্ঞানীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও আগ্রহের সীমা নেই । সাহিত্য, ধর্ম, সংস্কৃতি সর্বত্রই তাঁর অবাধ গতি । শিশুকে যেমন চাঁদের মায়াময় রূপ দেখিয়ে মন ভুলানো যায়, তেমনি আবালবৃদ্ধবনিতাও তার নির্মল আলোর যাদুতে মোহিত হয়ে যান । রাতের আকাশে তার উপস্থিতি পরিবেশকে এক আলাদা পবিত্রতায় নিয়ে যায় । উপকথা আর রূপকথার জগতে কখনো শুনা যায় ‘চাঁদের বুড়ির’ কথা যে নাকি অবিরত চরকা কেটে যাচ্ছে । এই চাঁদই কবিদের চোখে কখনো ঝলসানো রুটি আবার কখনো আঁধার প্রেমের সাক্ষী ।    
    চাঁদের মাটিতে ১৯৬৯  সালে পদার্পন করার পর ইতিহাস গড়েছিলেন নীল আর্মষ্ট্রং আর তার সহযোগীরা । যা আগে শুধু স্বপ্ন ছিল সেই চরম সত্যকে বিজ্ঞানের ভেলকিতে বাস্তব করে দেখালেন বিজ্ঞানীরা । তারপর হয়েছে চাঁদ নিয়ে নানা অভিনব আবিষ্কার । ভারতের জন্যও শ্লাঘার ব্যাপার যে ‘ইসরো’ প্রেরিত কৃত্রিম উপগ্রহ ‘চন্দ্রযান-১’ মিশনও সাফল্যের মুখ দেখে । ২০০৯ সালে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে জলের উপস্থিতির কথা সর্বপ্রথম ভারতের বিজ্ঞানীরাই বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন । তারপর নাসা ৯ অক্টোবর, ২০০৯ পরীক্ষামূলক ভাবে দক্ষিণ মেরুতে দ্রবীভূত জলের সন্ধান পায় । সাম্প্রতিক এই দুরন্ত আবিষ্কারের নেপথ্য নায়ক কিন্তু ‘নাসা’ প্রেরিত ‘লুনার রিকনেশাঁ অরবিটার’  যা গত ১৮ জুন, ২০০৯ এ উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল ।
চন্দ্র পৃষ্ঠের এই চ্যুতি গুলোর ফটো বিশ্লেষণ করেই নাসার বিজ্ঞানীরা চন্দ্রের সঙ্কুচিত হবার খবরটি প্রকাশ করেছেন ।    

    থমাস ওয়াটার্স আর তার সহযোগীরা ‘লুনার রিকনেশাঁ অরবিটার ক্যামেরা’ দিয়ে চন্দ্র পৃষ্ঠের তোলা ফটো গুলোর পুঙ্কানুপুঙ্ক বিশ্লেষণ করে এই লক্ষ্যে পৌছেছেন যে চাঁদের আকার সঙ্কুচিত হয়েছে । এই সঙ্কুচনের হার গত দশ কোটি বছরে ১০০ মিটার ! আগামিতেও চাঁদের ব্যাসার্দ্ধ কমার আশঙ্কা আছে । নাসার ‘লুনার রিকনেশাঁ অরবিটার’ মিশনের মূল উদ্দেশ্য হল চন্দ্রপৃষ্টের গঠন নিয়ে বিস্তারিত অধ্যয়ন করা । আসলে ১৯৭০ সালের প্রাক্কাল থেকেই ‘অ্যাপেলো ১৫, ১৬ এবং ১৭’ মহাকাশযানগুলো চন্দ্রের খুব কাছ থেকে ফটো তুলে পৃথিবীতে পাঠাতে শুরু করে । তখন চাঁদের বিষুবরেখার বরাবর অনেক চ্যুতি বিজ্ঞানীদের নজরে আসে । এই চ্যুতিগুলো দেখতে কিছুটা ফাটলের মত । বিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘লোবেট স্কার্পস’ বলা হয় । “অ্যাপেলো মিশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল চাঁদের মাটিতে মানুষ অবতরণ করানো, তাই অ্যাপেলোর পাঠানো ছবিগুলো মূলতঃ বিষুবরেখা কেন্দ্রিক ছিল” । বক্তা আমেরিকার ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর আর্থ এন্ড প্ল্যানেটারি স্টাডিসের বিজ্ঞানী থমাস ওয়াটার্স যিনি এই প্রজেক্টের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত । “বর্তমান মিশনে আমরা চাঁদের বিষুবরেখা ছাড়া উচ্চ অক্ষাংশেও চ্যুতির সন্ধান পেয়েছি । সেটা সম্ভব হয়েছে আল্ট্রা উচ্চপ্রযুক্তির ক্যামেরা ফটোগ্রাফি থেকে” । ‘লুনার রিকনেশাঁ অরবিটার ক্যামেরা’  এর সাহায্যে চৌদ্দটি ‘লোবেট স্কার্পস’ এর সন্ধান পাওয়া গেছে যার মধ্যে সাতটি ৬০ ডিগ্রি অক্ষাংশে পাওয়া গেছে । এর থেকে বোঝা যায় যে এই চ্যুতিগুলো চাঁদের সবদিকেই ছেয়ে আছে । আশা করা যায় যে আগামীতে তেমন আরো অসংখ্য ‘স্কার্পস’ এর সন্ধান পাওয়া যাবে ।       
    চাঁদের পৃষ্টে এই ‘লোবেট স্কার্পস’ হবার কারণটাই বা কি ? আর এর সঙ্গে সঙ্কুচনের কি সম্পর্ক ? বিজ্ঞানীদের মতে চন্দ্র যখন সৃষ্টি হয়েছিল তখন সে খুব গরম আর গলিত অবস্থায় ছিল । চাঁদের অভ্যন্তর ধীরে ধীরে ঠান্ডা হওয়ার জন্য তার আকার কমতে থাকে, আর এর প্রভাব পড়ে বহির্পৃষ্টে । আভ্যন্তরীণ আকার কমার দরুণ বহির্পৃষ্টে তখন চ্যুতির সৃষ্টি হয় । এই চ্যুতিগুলোর অধ্যয়ন করে সঙ্কুচনের হার হিসেব করে বের করা যায় । এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বুধ আর মঙ্গলগ্রহেও এই চ্যুতি দেখা গেছে যা কয়েক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তারিত হয় । আর চাঁদের ক্ষেত্রে তা কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত হয় ।    
    আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর ‘আন্তর্জাতিক চন্দ্রদর্শন রাত্রি’ হিসেবে উদযাপন করা হবে সারা বিশ্বে । মূলতঃ চন্দ্রবিজ্ঞান আর এর আবিষ্কারের কথা জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্য বিজ্ঞানীদের তরফ থেকে এই আয়োজন । সবথেকে মজার ব্যাপার হল ছোট দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেও চাঁদের সুন্দর পাহাড় বা গহবর গুলো খুব ভালো দেখা যায় । তাই বিশ্বের নানা স্থানে ঐ বিশেষ রাত্রে  চন্দ্রদর্শনের আয়োজন করা হবে ।
    এই রাত্রিটা অন্যান্য রাত্রির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা । এক আলাদা আমেজ, একটু রোমান্টিক ভাবনা, আর ...বিজ্ঞান - সবই আছে । তাই ব্যস্ততার ফাকে একটু রোমান্টিক হয়ে উঠতে কে না চায় !!!

Friday, August 13, 2010

মহাপ্রলয়ের নেপথ্যে



চিত্র ১ -  কাউন্টডাউন শুরু ! ২০১২ সালেই কি তাহলে পৃথিবীর চুম্বকীয় মেরু পরিবর্ত্তিত হওয়া পাকা ?
চিত্র ২ - কম্পাস প্রস্তুতকারী কোম্পানীগুলো কম্পাসের উত্তরকে দক্ষিণ আর দক্ষিণকে উত্তর বানাবার চিন্তা ভাবনা করছে !
চিত্র ৩ - নস্ত্রাদামুসের ভবিষ্যত গণনায় বিশ্বাসীরা আসন্ন প্রলয়ের চিন্তায় বিভোর !
চিত্র ৪ - পৃথিবীর চুম্বকীয় ক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিল্ডের হঠাৎ পরিবর্তন জীবজগতে কি প্রভাব ফেলবে - এ নিয়ে জম্পেশ গবেষণা করার খোরাকও পেয়ে গেলেন কিছু গবেষক !
চিত্র ৫ - পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আসন্ন বিপদের কথা ভাবছেন ! মহাজাগতিক রশ্মি কিছু সময়ের জন্য কোনও বাধা না পেয়ে পৃথিবীতে পতিত হলে জীবজগতের কী ক্ষতি হতে পারে সেটা নিয়েই বিশ্লেষণ চলছে !
চিত্র ৬ - হলিউডের ব্লকব্লাস্টার ফিল্ম '২০১২' গত ১৩ নভেম্বর, ২০০৯ তারিখে মুক্তি পেয়েছে । মুভিটি সারা বিশ্বে হিট !

              ২১ ডিসেম্বর ২০১২ । ঠিক এই তারিখেই ঘটতে চলেছে মহাপ্রলয় ! ২০০২ সালে প্রকাশিত 'দি অরিয়ন প্রোফেসি' নামক বইয়ে জনৈক বেলজিয়ামের লেখক পেট্রিক গেরিল-এর অন্তত এমনটিই দাবি । আর তিনি তাঁর এই দাবিকে পাকাপোক্ত করার জন্য  বিজ্ঞান আর মাইথোলজির আশ্রয় নিয়েছেন ; নিট ফল - বইটি বেস্টসেলিং -এর তালিকায় । এর তিন বছর পর ওই লেখকের আরও একটি বই বের হয় - 'দি ওয়ার্ল্ড কেটাক্লিসম ইন ২০১২' । বলাবাহুল্য এই বইটিও বাজার মাত করেছিল । এরই মধ্যে তৈরী হয়েছে 'হাউ টু সারভাইভ ২০১২ ডট কম' নামে একটি ওয়েবসাইট । সেখানেই বর্ণনা আছে শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথা , আর মহাপ্রলয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার নানা উপায় । ওয়েবসাইটের বয়ান থেকে এটা পরিষ্কার যে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করেই টিকে থাকতে হবে এই গ্রহে ।

            মাইথোলজি কী বলছে ? পেট্রিক গেরিল মায়া সভ্যতা আর মিশরীয় সভ্যতার পুরনো নথিপত্র ঘেটে বলতে চেয়েছেন যে ২১ ডিসেম্বর , ২০১২ তেই নাকি নেমে আসছে শেষের সেই দিন ! তার এই দাবিকে জোরালো করার জন্য ওই সভ্যতার আগের মিলে যাওয়া কিছু ভবিষ্যত গণনার কথাও উল্লেখ করা হয় বইটিতে । 'মেসোআমেরিকান লং কাউন্ট ক্যালেন্ডার' - এ নাকি ২১ ডিসেম্বর , ২০১২ - এর পর তারিখ সমাপ্ত । মানে পৃথিবী ধবংস !

          বিজ্ঞানীরা কী বলছেন ? 'মেসোয়ামেরিকান লং কাউন্ট ক্যালেন্ডার' কে বিজ্ঞানীমহল বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছেন । মায়া সভ্যতার কিছু মানুষ এক ভুল সত্যের পেছনে ছুটেছিলেন , এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মনে কোনও সন্দেহ নেই । সেই সভ্যতা নিঃসন্দেহে উন্নতমানের ছিল কিন্তু এর মানেই এই নয় যে ওদের সব ধারণাই সঠিক ছিল ।

         টিভি অথবা খবরের কাগজে ক'বছর পরপর 'মহাপ্রলয়' নিয়ে নানা চমকপ্রদ খবর বের হয় ! সাইবার জগতেও এর ব্যাপ্তি বিশাল । ইন্টারনেটের হাজার হাজার অয়েবসাইটেও রয়েছে মহাপ্রলয় নিয়ে অবিশ্বাস্য কথা ! এর সত্য মিথ্যা যাচাই করাটাও অনেকসময় কঠিন হয় । কারণ ঐ ধারণাগুলি বিজ্ঞানের প্যাকিং দিয়ে এমনভাবে মোড়া হয় যে আসল সত্য ভিতরেই থেকে যায় ।

         নিজেকে একজন গবেষক বলে জাহির করা পেট্রিক গেরিল বিজ্ঞানের আশ্রয়ও নিয়েছেন সুচতুরভাবে । তার বই এ 'জিওম্যাগনেটিক রিভারসেল' তত্ত্বের প্রসঙ্গ জোরালোভাবে পেশ করা হয়েছে ।

          এবার একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক 'জিওম্যাগনেটিক রিভারসেল' বা 'ভূচুম্বকীয় বিপরীতীকরণ' তত্ত্বটা আসলে কি ? একটা চুম্বকের বাটকে যদি শূন্যে সুতো দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া যায় তবে দেখা যায় যে সেটা সবসময় পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণ মেরু বরাবর অনুভূমিক ভাবে অবস্থান করে । আসলে পৃথিবী নিজেই একটা বিশাল চুম্বক । চুম্বকের বিশেষত্ব হল এর উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরু । পৃথিবীর ক্ষেত্রে ওর ভৌগলিক উত্তর গোলার্ধেই রয়েছে চুম্বকীয় উত্তর মেরুর অবস্থান, আর দক্ষিণ গোলার্ধে রয়েছে চুম্বকীয় দক্ষিণ মেরুর অবস্থান । এই ব্যাপারটাকে কাজে লাগিয়েই তৈরী হয়েছে কম্পাস । আর দিক নির্ণয়ের কাজে কম্পাসের কোন বিকল্প নেই । কিন্তু মজার ব্যাপার হল এই মেরুগুলোও টেনিস খেলোয়ারের মত একটা 'সেট' শেষ হলে দিক পরিবর্তন করে । তখন ভৌগলিক উত্তর গোলার্ধে হয়ে যায় চুম্বকীয় দক্ষিণ মেরু, আর দক্ষিণ গোলার্ধে চুম্বকীয় উত্তর মেরু । এই পরিঘটনাকেই 'ভূচুম্বকীয় বিপরীতীকরণ' বলা হয় । এই বিপরীতীকরণ হতে সময় লাগে কয়েক হাজার বছর । পৃথিবীর ক্ষেত্রে এর কোন বাধাধরা নিয়ম নেই । কখনো ৫০ হাজার বছরেও মেরু বিপরীতীকরণ হয় আবার কখনো এর থেকে বেশী সময়ও লাগে । যেমন পৃথিবীর শেষ মেরু বিপরীতীকরণ হয়েছিল প্রায় ৭ লক্ষ ৮০ হাজার বছ আগে । এর পরেরটা কবে হবে সেটা বলা একটু কষ্টকর । এখানে উল্লেখ্য যে সূর্যের মেরু বিপরীতীকরণ হতে সময় লাগে মাত্র ১১ বছর । আর এই সময়টাও প্রায় অপরিবর্তিত থাকে । ২০০১ সালে সূর্যের এই বিপরীতীকরণ হয়েছিল । আগামী ২০১২ সালে আবার সেই বিপরীতীকরণ হওয়াটাও পাকা । 

        আবার চলে আসি পেট্রিক গেরিল প্রসঙ্গে । ওনার মস্তিষ্ক থেকে জন্ম নেওয়া নুতন থিওরি মতে যেহেতু সূর্যের চুম্বকীয় মেরু বিপরীতীকরণ আগামী ২০১২ সালে, তাই সেটার প্রভাবও এসে পড়বে পৃথিবীর উপরে । পৃথিবীতেও তখন মেরু বিপরীতীকরণের হাওয়া লাগবে । আর এর ফলে ভূমিকম্প, সুনামি শুরু হয়ে যাবে এই গ্রহে - ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী । 

         থিওরিটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত ? নাসার বিজ্ঞানীদের মতে সূর্যের চুম্বকীয় মেরু পরিবর্তনের সঙ্গে পৃথিবীর মেরু বিপরীতীকরণের কোন সম্পর্ক নেই । সেটা বিজ্ঞানসম্মত সত্য । পৃথিবীর ক্ষেত্রে সেই বিপরীতীকরণটা কবে হবে সেটা বলা মুশকিল । তবে সেটা যে আগামী কয়েক বছরে হবেনা এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা একমত । যদি ভূচুম্বকীয় বিপরীতীকরণ হয় তবে পৃথিবীতে কি অনাসৃষ্টি হতে পারে ? আসলে পৃথিবীর চুম্বকীয় ক্ষেত্র সূর্য থেকে আসা ক্ষতিকারক রশ্মিকে পৃথিবীতে আসতে বাধাদান করে । এর ফলেই জীবজগত ঐ ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে সুরক্ষিত আছে । মেরু  বিপরীতীকরণের সময় সামগ্রিক কিছু সময়ের জন্য পৃথিবীর চুম্বকীয় ক্ষেত্র কমে যেতে পারে । আর এর ফলে ক্ষতিকারক রশ্মি পৃথিবীতে এসে ঢুকবে । তবে  বিজ্ঞানীরা অভয় দিয়ে বলেছেন যে এর ফলে মারাত্মক কোন ক্ষতি হবেনা । কারণ এর আগেও পৃথিবীতে এমন ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু জীবকুল বিলুপ্ত হয়ে যায়নি । আর মেরু  বিপরীতীকরণের জন্য ভূমিকম্প বা সুনামির মত ঘটনা ঘটবে এর কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই । 

              রোলান্ড এমেরিক পরিচালিত ২০০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের হলিউড মুভি '২০১২' গত ১৩ নভেম্বর ২০০৯ এ মুক্তি পেয়েছে । এই মুভি মহাপ্রলয়ের থিম নিয়েই তৈরী হয়েছে । মুভিটি সারা বিশ্বে হিট । আর  পরিচালক যা ভবেছিলেন তাই হয়েছে । মহাপ্রলয়ের যুযু দেখিয়ে মুনাফা অর্জনের পথটাও হলিউডের জানা আছে । 

          ২১ নয়, ২২ ডিসেম্বর ২০১২ । সেদিন অবশ্যই একটা ই-মেল করবো - পেট্রিক গেরিলকে । আর বলবো যে ভাওতাবাজী দিয়ে ব্যবসায় করা যায়, কিন্তু   বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ সাধক হওয়া যায় না । পাঠকদের জন্য ই-মেল ঠিকানা দিলাম, ইচ্ছে হলে আপনারাও মেল করতে পারেন - patrick.geryl@skynet.be



Wednesday, July 21, 2010

রক্তস্নাত একুশে জুলাই

২১শে জুলাই, ১৯৮৬ । সকালে বাবা আর আমি খেতে বসেছি । মেনু – কাঁচকলা আর আলু সেদ্ধ ভাত । বাবার খুব তাড়া, সার্কিট হাউসে যেতে হবে । কারণ জিজ্ঞাসা করতেই তিনি গম্ভীর হয়ে একটি কথাই বললেন – “ভাষা আন্দোলন” । হঠাৎ বাবার বিষম উঠলো । ভালো করে খাওয়া হয়ে উঠলোনা । এর স্বল্পক্ষণ পর কয়েকবার গুলিচালনার শব্দ শুনতে পেলাম । বাবাকে বলতেই ব্যাপারটা তিনি পাশ কাটিয়ে বললেন যে পটকার শব্দ হতে পারে । বাবা আঁচ করতে পেরেছিলেন যে হয়তো কিছু ঘটতে চলেছে । তাড়াহুড়োর মধ্যেই তিনি বেরিয়ে গেলেন । তারপর দু’ দু’টো রাত কেটে গেল, বাবার কোন খবর নেই ।


            ক্লাস ফাইভের ছাত্র হিসেবে করিমগঞ্জের নীলমনি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সদ্য ইংরেজী শিখতে শুরু করেছি । বাংলা ভাষার পাশাপাশি আরো দু’টি ভাষা হিন্দি আর ইংরেজী শিখতে পারবো বলে কত আনন্দ । বাবার মুখেই শুনতাম বিদেশে যেতে হলে অনেক ভাষা জানতে হয় । কারণ ভাষা শেখার বিকল্প নেই । “ভাষা আন্দোলন” শব্দটা আমার কাছে কেমন জানি বাঁধো ঠেকলো ! ভাষার জন্য আবার আন্দোলন করতে হয় না কি ? এখানে তো সবাই দিব্যি বাংলা বলছে । ২১শে জুলাই-এর রাতে মা এর মুখেই শুনতে পেলাম বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এই আন্দোলনে দু’দুটো তাজা প্রাণ শহিদ হয়েছে, আর আহতের সংখ্যা অগনিত । কার্ফ্যু হয়ে যাওয়ায় পর বাবার কোন খবর পাওয়া যাচ্ছিলনা । বাবাও কি তবে ...। আমরা কেউ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতেই পারছিলাম না । পরদিনও সারাক্ষণ উৎকন্ঠায় কাটলো । একদিকে সেনার ফ্ল্যাগ মার্চ আর অপরদিকে পুলিশের ঘন ঘন টহল, পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছিল । ২৩ শে জুলাই সকাল বেলা খবর পেলাম যে বাবা সিভিল হাসপাতালে রয়েছেন । এক ঘন্টার জন্য কার্ফ্যু উঠার পর তড়িঘড়ি মা আর দিদি হাসপাতালে বাবাকে আহত অবস্থায় দেখে এলেন ।

              ভাষা আন্দোলনের অতীত যে অনেক পুরানো তা পরে জেনেছিলাম । ১৯৬০ সালে আসাম রাজ্যভাষা আইন চালু হওয়ার পর থেকেই বরাক উপত্যকার বাংলাভাষীদের উপরে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে সামিল হয় মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহার সরকার । এর ফলস্বরূপ ১৯৬১ এর ১৯শে মে-এর ভাষা আন্দোলনে শিলচরে পুলিশের গুলিতে এগারো শহিদের রক্তে রাঙ্গা হয়ে উঠে শিলচর রেলস্টেশন চত্বর । চালিহা সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয় । কিন্তু চক্রান্ত চলতেই থাকে । ১৯৭২ সালে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় একটি চরম সিদ্ধান্ত নেন যে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হবে একমাত্র অসমীয়া ভাষা । তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী শরৎচন্দ্র সিংহ ও ঝোপ বোঝে কোপ মারলেন । উনার মন্ত্রীসভাও ১৯৭২ সালে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো যে মাধ্যমিক পর্যায়ে অনসমীয়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য অসমীয়া ভাষা বাধ্যতামূলক করা হবে । এই সিদ্ধান্তের বিরূদ্ধে বরাকে আবার আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠলো । অবশেষে সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়, আর অনির্দিষ্ট কালের জন্য গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অসমীয়া ভাষাকে একমাত্র মাধ্যম করার প্রস্তাবটি স্তগিত রাখা হয় এবং সঙ্গে ভাষা সার্কুলারটিও । ১৯৮৫ এর ডিসেম্বর মাসে প্রফুল্ল কুমার মহন্ত ক্ষমতায় বসেই ভাষা সার্কুলারের “মাইন” আবার নুতন করে পুঁতবার প্রস্তুতি শুরু করলেন । দিসপুর থেকে বরাক উপত্যকায় নির্দেশ আসলো অসমীয়া ভাষা এখন থেকে বাধ্যতামূলক হবে । আবারও গর্জে উঠার পালা এই উপত্যকার অবহেলিত মানুষদের । ১৯৮৬ সালের ২১শে জুলাই মুখ্যমন্ত্রীর করিমগঞ্জ সফরে ভাষা সার্কুলারের বিরূদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দেওয়ার জন্য শতশত মানুষ সামিল হলেন ভাষা আন্দোলনে ।

              ২১শে জুলাই, ১৯৮৬ । সকাল ন’টা । তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লকুমার মহন্তের হেলিকপ্টার করিমগঞ্জ শহরের অদূরে মাইজডিহিতে অবস্থিত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হ্যালিপেডে এসে নামলো । সার্কিট হাউসের সামনে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় আসার পর দেখা গেল কালো পতাকা নিয়ে অগনিত মানুষের জটলা । জেলা প্রশাসনের মদতে জনতার ভিড় ঠেলে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় সার্কিট হাউসের দিকে চলে গেল । ততক্ষণে আন্দোলনকারীদের পালে হাওয়া লেগেছে । ‘অগপ সরকার মুর্দাবাদ’, ‘প্রফুল্ল কুমার মহন্ত মুর্দাবাদ’ ধ্বনিতে কেঁপে উঠলো সার্কিট হাউসের আশপাশ । উত্তপ্ত হয়ে উঠলো আন্দোলনের পরিবেশ । এরই মধ্যে পুলিশের কাজ শুরু হয়ে গেল । ‘কেলা বঙালি’ বলেই আন্দোলনকারীদের উপর লাঠি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো আসাম পুলিশের বর্বর ব্যাটেলিয়ান । সার্কিট হাউসের বারান্দায় এসে মুখ্যমন্ত্রী মহন্ত পর্যবেক্ষণ করে গেলেন তার সরকারী বাহিনীর দাপট । এদিকে পুলিশের লাঠিচার্জে বিক্ষোভকারীরা বেসামাল হয়ে পি ডবলিউ ডি অফিসের সামনে জমায়েত হতে লাগলেন । এর অল্পকিছুক্ষণ পর মুখ্যমন্ত্রী মহন্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়ে আন্দোলনকারীদের পাত্তা না দিয়ে নিমিষে বেরিয়ে যান পরবর্তী গন্থব্যস্থল ফকিরাবাজারের দিকে । নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের মধ্যে কেউ কেউ পুলিশের দিকে ঢিল ছোঁড়তে শুরু করে । ব্যস – তারপর অগ্নিশর্মা পুলিশের দল গুলি চালনা শুরু করে দেয় । সময় তখন সকাল ন’টা পঞ্চান্ন । বুলেটের ছোবলে জগন্ময় দেব (জগন) আর দিব্যেন্দু দাস (যীশু) লুটিয়ে পড়লেন পি ডবলিউ ডি অফিসের সামনে । শহিদের রক্তে করিমগঞ্জের মাটি পবিত্র হয়ে উঠলো । আহত মানুষদের আর্তনাদে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠলো ।

               “ঘর থেকে বের হবার পর আমি খবর পেলাম পুলিশের লাঠি চার্জ আর ফায়ারিং-এ শহরের পরিস্থিতি থমথমে । রেডক্রস আর সরকারি হাসপাতালে আহতদের ভিড় । তাই হাসপাতালে ছুটে গেলাম আহত আন্দোলনকারীদের সাহায্যে । সুপারিন্টেনডেন্টের ঘরে যখন আহত মানুষদের খবর নিচ্ছি তখন হাসপাতাল চত্বরে প্রবেশ করলেন করিমগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার মহন্ত । এসেই তিনি আমাকে দেখে বললেন ‘দুলাদা আপনাকে আমি গ্রেফতার করলাম । চলুন গাড়িতে ।’ হাসপাতালের সীমানা থেকে বের হবার আগেই মহন্তের সেনাবাহিনী আমার দিকে ছুটে আসলো, আর এলোপাথারি লাঠির আঘাত করতে লাগলো । হাত দিয়ে আটকাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু গাড়িতে উঠার পর সেটা যেন বেড়ে গেল । বুটের লাথি আর লাঠির আঘাতে জর্জরিত এক বৃদ্ধকে ক্ষমা দেখাবার ন্যূনতম সৌজন্যবোধ দেখালো না আসাম পুলিশের বর্বর দল । পুলিশের গাড়িতে অন্যান্য আন্দোলনকারীদেরও একই অবস্থা । অবশেষে থানায় এনে আমাদের বস্তার মত ফেলে দেওয়া হল । অনেক অনুরোধের পর আমাদের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হল । ডান হাতটা ভীষণ ব্যথা করছিল । ভাবতেই পারিনি যে হাত ভেঙ্গে গেছে । হাসপাতালে আসার পর চশমা না থাকায় খুব অসুবিধে হচ্ছিল । চশমার কথা জনৈক অসমীয়া পুলিশকে বলতেই অশ্লীল গালি আমার দিকে ধেয়ে আসলো । যাই হোক এক বাঙালি পুলিশ কর্মীর বদান্যতায় অবশেষে চশমাটি পেলাম ।” বক্তা আমার বাবা হিমাংশু শেখর দাস (দুলা) । এই ঘটনার রোমন্থন অনেকবারই তিনি করেছেন । প্রতিবারই আমার মনে হতো নুতন ঘটনা শুনছি । কারফিউ উঠার পর রোজ হাসপাতালে বাবার ওখানে যেতাম আর শুনতাম নানা গল্প । পুলিশের অকথ্য অত্যাচারের গল্প তখন ঘরে ঘরে মা বোনদের আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছিল । অনেক নেতারাও বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন । এদের মধ্যে রথিন সেন, রণেন্দ্রমোহন দাস (দুলুবাবু), নৃপতি চৌধুরী, সুজিৎ চৌধুরী, লোপামুদ্রা চৌধুরী প্রমুখ । বর্তমান কংগ্রেস সরকারের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ও সেসময় করিমগঞ্জ সফর করেন আর বাবার সঙ্গে আন্দোলন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয় । কলকাতার পাক্ষিক পত্রিকা “প্রতিক্ষণ” বিস্তারে ২১শে জুলাই এর ঘটনা নিয়ে ১৭ আগস্ট, ১৯৮৬ সালে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে । সেই সংখ্যার ম্যাগাজিনে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাবার একটি সচিত্র (চিত্রঃ ১) রিপোর্ট বের হয় যা বাবা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত একখানি কপি আগলে রেখে ছিলেন । বাবা ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী । বৃটিশের বিরূদ্ধে আন্দোলনের অনেক কথাই উনার মুখে শুনেছি । বাবা কখনো আক্ষেপ করে বলতেন যে স্বাধীন ভারতে এখন স্বদেশী ভাইদের বিরূদ্ধে ভাষার অধিকার নিয়েই লড়াই করতে হচ্ছে । বাবার অবশ্য এক আলাদা রাজনৈতিক পরিচয়ও ছিল । প্রথম জীবনে তিনি জনসঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । পরে যখন জনসঙ্ঘ বিভক্ত হয়ে ‘জনতা পার্টি’ আর ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’ হয় তখন বাবা জনতা পার্টিতে যোগ দেন । দীর্ঘকাল তিনি জনতা পার্টি (পরে জনতা দল) এর সম্পাদক আর সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন । বাবা করিমগঞ্জ থানার ও সি মহন্ত এন্ড কোম্পানীর বিরূদ্ধে মামলাও করে ছিলেন । মহন্ত এবং আর এক পুলিশ অফিসার বদরুল হক লস্কর আমাদের বাড়িতে প্রায়ই এসে বাবাকে কেস তুলে নেবার জন্য কাতর অনুরোধ করতো । কিন্তু বাবা তাদের কথায় কর্ণপাত করেননি । অনেকদিন সেই মামলা চলার পর দেখা গেল শেষে সাক্ষী দেবার লোক নেই । মহন্তের চোখ রাঙ্গানিতে ওরা ভয় পেয়ে গিয়েছিল । কেসের গতি রুদ্ধ হয়ে গেল । সাক্ষী হিসেবে বাবা উনার সেদিনের পরিহিত রক্তরাঙ্গা কাপড়ও রেখেছিলেন । কিন্তু ২১শে জুলাইয়ের ভিলেনদের কোন বিচার হলনা ! সেই আক্ষেপ বাবা বাকী জীবন বয়ে গিয়েছিলেন ।

                'প্রতিক্ষণম্যাগাজিনের (১৭ আগষ্ট, ১৯৮৬) রিপোর্টের একটি অংশ ।

          ২১শে জুলাই এর ঘটনা বাংলা ভাষার প্রতি আমার এক আলাদা তাগিদ সৃষ্টি করে । ১৯৬১ এর ভাষা আন্দোলনেও বাবা একজন সৈনিক ছিলেন । সেসময় করিমগঞ্জ রেলষ্টেশন চত্বরে পুলিশের লাঠির আঘাতে বাবার পা ভেঙ্গে যায় । “যুগান্তর” পত্রিকায় বাবার একখানি ফটো আর উনাকে নিয়ে একটি রিপোর্টও বেরিয়ে ছিল । পত্রিকার কাটিং রাখার এক বিচিত্র শখ ছিল বাবার । প্রচারবিমুখ বাবা উনার ফাইলে ১৯৬১ সালের ভাষা আন্দোলনের অনেক দুর্লভ কাটিং সংগ্রহ করে রেখেছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আজ সেই সব আমার কাছে কিছুই নেই । এই উপত্যকার প্রতিটি মানুষের বাংলা ভাষার প্রতি এক তাগিদ আসলে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করা । প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে বরাকের সর্বস্তরের মানুষই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল । তাই ভাষা আন্দোলন নিয়ে যখন কোন আলোচনা হয় তখন প্রচারবিমুখ বাবার অবদানের জন্য নিজেকে বড় গর্বিত মনে হয় ।

Saturday, June 12, 2010

রাতের আকাশে ম্যাকনটের মায়াবী রূপ

“মুসাফির হু ইয়ারো
না ঘর হ্যায় না ঠিকানা
মুঝে বস চলতে জানা ...”

      কিশোরকুমারের গানটি এই নায়কের আবির্ভাবের সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে যায় । রাতের আকাশে তার আকস্মিক আগমন যুগযুগান্তর ধরে মোহিত করে রেখেছে পৃথিবীবাসিদের । সূর্যের অমোঘ আকর্ষণে লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এই পরিযায়ি মহাজাগতিক বস্তু হাজির হয় সৌরজগতে । পৃথিবীর পাশ দিয়ে হাসতে হাসতে হাত নেড়ে যাবার সময় সে দৃশ্যমান হয় এই গ্রহ থেকে । মায়াময় জগৎ থেকে সৌরজগতে ধূমকেতুর আগমনকে নাটকীয় ছাড়া আর কী বলা যায় ! আগামী ১৩ জুন থেকেই রাতের আকাশে এক নুতন হার্টথ্রব নায়ক ‘ধূমকেতু ম্যাকনট’-এর লাইভ শো শুরু হবে ।


           
         
              ৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৯ । রোজকার মতই দূরবীন নিয়ে রাতের আকাশের মনোরম দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত এক জ্যোর্তিবিদ । হঠাৎ চমকে উঠলেন তিনি ! পরিচিত আকাশের এক কোনে নুতন অতিথিকে দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না । ইতিহাসের পাতায় আবারও কী নাম উঠতে যাচ্ছে নাকি ! সঙ্গে সঙ্গে ফটো সহ বিস্তারিত রিপোর্ট তিনি পাঠিয়ে দেন ইন্টারন্যাশনেল অ্যাস্ট্রোনোমিকেল ইউনিয়ন পরিচালিত ‘মাইনর প্ল্যানেট সেন্টার’-এ । সেখান থেকে খবর আসার পর আনন্দে আত্মহারা অস্ট্রেলিয়ান জ্যোর্তিবিদ রবার্ট ম্যাকনট -- নুতন ধূমকেতু সৌরজগতে ।  প্রথা অনুযায়ী আবিষ্কারকের নামেই ধূমকেতুর নাম হল ‘ধূমকেতু ম্যাকনট’ । এর আগেও ২০০৬ সালে আরো একটি ধূমকেতু আবিষ্কার করে রীতিমত হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন ম্যাকনট ।  

              ধূমকেতু হল একটি মহাজাগতিক বস্তু যার ব্যাসার্দ্ধ ১ থেকে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে । মূলতঃ বরফ, পাথর আর অরগ্যানিক পদার্থ দিয়েই তৈরী সে । ধূমকেতুর বিশেষত্ব হল সূর্যের নিকটে আসলেই তার দুটি লেজ গজায় । একটিকে বলা হয় ‘আয়ন টেল’ আর অপরটিকে ‘ডাস্ট টেল’ ।  লেজগুলো সবসময় সূর্যের বিপরীতে থাকে । আবার যখন সে সূর্যের আকর্ষণ থেকে দূরে চলে যায় তখন লেজও গায়েব !

              ধূমকেতুর আবির্ভাবে লুকিয়ে রয়েছে নানা গল্প । প্রাচীনকালে এর আবির্ভাবে মানুষ হয়ে উঠতো শঙ্কিত । অনাবৃষ্টি, খরা, ভূমিকম্প ইত্যাদি নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ধূমকেতুর আকস্মিক আগমনকেই দায়ী করা হত । কিন্তু সময় বদলেছে, কারণ বিজ্ঞানের দৌলতে সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে কুসংস্কার মুক্ত । এখন তাই রাতের আকাশে ধূমকেতুর আবির্ভাবে তারা কোন অমঙ্গলের ছায়া দেখতে পাননা । 

               তাইকো ব্রাহে নামক ডেনমার্কের এক জ্যোর্তিবিদ ১৫৭৭ সালে ইউরোপের নানা জায়গায়  যন্ত্রপাতির সাহায্যে প্রথম ধূমকেতুর পর্যবেক্ষণ করেন । তার পর্যবেক্ষণ থেকেই বেরিয়ে আসে নুতন তথ্য যে ধূমকেতু আমাদের সৌরজগতের সদস্য । তারপর শুরু হয় বিজ্ঞানীদের গবেষণা । আর এই গবেষণায় ইংল্যান্ডের অ্যাডমন্ড হ্যালির অবদান অনস্বীকার্য । হ্যালি ১৭০৫ সালে সর্বপ্রথম আইজাক নিউটনের বলতত্ত্ব ব্যবহার করে দেখান যে ইতিহাস বর্ণিত ১৪৫৬, ১৫৩১, ১৬০৭ আর ১৬৮২ সালে আবির্ভূত হওয়া ধূমকেতু গুলি আসলে একই  ধূমকেতু  যাদের পরিভ্রমন পথ ৭৬ বছর । তিনি ঘোষণা করেন যে ১৭৫৮ সালে ধূমকেতুটি আবার আসবে । অবশেষে বিজ্ঞানের জয় হল । ১৭৫৮ তে রাতের আকাশে আবার আগমন ঘটলো তার । কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল ঐ ঐতিহাসিক ঘটনার সত্যতা জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি হ্যালি ।  ১৭৪২ সালেই তার মৃত্যু হয় । অবশেষে হ্যালির সম্মানার্থে ধূমকেতুটির নাম রাখা হয় – ‘হ্যালির ধূমকেতু’ যা ১৯৮৬ সালে পৃথিবী থেকে শেষ দৃশ্যমান হয়েছিল । ধূমকেতু পুনরাবৃত্ত (Periodical) আর অপুনরাবৃত্ত (Non periodical) দু’রকমের হতে পারে । ‘পুনরাবৃত্ত ধূমকেতু’ একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর সূর্যকে পরিভ্রমন করে থাকে । যেমন – ‘ধূমকেতু হ্যালি’, ‘ধূমকেতু হেল-বপ’ ইত্যাদি । আর ‘অপুনরাবৃত্ত ধূমকেতু’-এর ক্ষেত্রে  আগমন একবারই ঘটে থাকে ।  যেমন – ‘ধূমকেতু লেভি’, ‘ধূমকেতু অস্টিন’ ইত্যাদি ।   

               ধূমকেতুর আবাসস্থল ঠিক কোথায় ? সূর্য থেকে অনেকদূরে বর্তুলাকার একটি দেশ আছে যাকে ‘উওর্ট ক্লাউড’ বলা হয় । বিখ্যাত জ্যোর্তিবিজ্ঞানী জেন হেনরিক উওর্ট প্রথম আবিষ্কার করেন ধূমকেতুর উৎপত্তিস্থল । সূর্য থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্ব ১৫ কোটি কিলোমিটার । এই দূরত্বকে এক ‘অ্যাস্ট্রোনোমিকেল ইউনিট’ বলা হয় । আর সূর্যকে আবৃত করে রাখা বর্তুলাকার ‘উওর্ট ক্লাউড’ প্রায় এক লক্ষ অ্যাস্ট্রোনোমিকেল ইউনিট দূরত্বে আছে,  কিন্তু তবুও সূর্যের আকর্ষণে আবদ্ধ সে ! সেই ক্লাউডেই রয়েছে অসংখ্য ধূমকেতু । বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে দেখেছেন যে সেখানে ১০ কোটি থেকে ১০০০ কোটি ধূমকেতু থাকতে পারে । সেই আবাসস্থল থেকে কিছু ধূমকেতু কখনো ঢুকে পড়ে সৌরমন্ডলের ভিতরে । আর তারপর শুরু হয়ে যায় সূর্যকে কেন্দ্র করে ওদের পরিভ্রমণ । সাধারণতঃ উপবৃত্তাকার (Elliptical)অথবা অধিবৃত্তাকার (Parabolic) পথেই ধূমকেতু সূর্যকে পরিভ্রমন করে । 

               ভোরের নির্মল হাওয়াতে যারা প্রাতঃকালীন সফরে অভ্যস্ত, তারাই লাইভ শো এর মজা উপভোগ করতে পারবেন । কারণ ‘ধূমকেতু ম্যাকনট’ ভোর চারটে থেকেই খালি চোখে পূর্বাকাশে বুধ গ্রহের একটু ওপরেই দেখা যাবে । বুধ গ্রহ চেনার উপায় হল এর ঔজ্জ্বল্যতা । এই জ্যোতিষ্কের আলো স্থির আর এটি তারার মত জ্বলজ্বল করবেনা । আনন্দের খবর হল  ১২ জুন অমাবস্যা থাকায় আগামী ১৩ জুন থেকে এই ধূমকেতু খুব ভাল ভাবে কয়েকদিন দৃশ্যমান হবে । ধীরে ধীরে এর ঔজ্জ্বল্যতা বাড়তে থাকবে । সবথেকে গুরূত্বপূর্ণ ব্যাপার হল এই ধূমকেতু আবার সৌরজগতে ফিরে আসবে কিনা তা বলা মুশকিল । কারণ প্রাথমিক তথ্যমতে  এই ধূমকেতু অপুনরাবৃত্ত । তাই বিজ্ঞানীদের কাছে  ম্যাকনট একটু বাড়তি সমাদর পাবে । 

                এখন আবহাওয়া দপ্তরকে প্রশ্ন – মেঘের আস্তরণ সরবে তো ?