Friday, August 13, 2010

মহাপ্রলয়ের নেপথ্যে



চিত্র ১ -  কাউন্টডাউন শুরু ! ২০১২ সালেই কি তাহলে পৃথিবীর চুম্বকীয় মেরু পরিবর্ত্তিত হওয়া পাকা ?
চিত্র ২ - কম্পাস প্রস্তুতকারী কোম্পানীগুলো কম্পাসের উত্তরকে দক্ষিণ আর দক্ষিণকে উত্তর বানাবার চিন্তা ভাবনা করছে !
চিত্র ৩ - নস্ত্রাদামুসের ভবিষ্যত গণনায় বিশ্বাসীরা আসন্ন প্রলয়ের চিন্তায় বিভোর !
চিত্র ৪ - পৃথিবীর চুম্বকীয় ক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিল্ডের হঠাৎ পরিবর্তন জীবজগতে কি প্রভাব ফেলবে - এ নিয়ে জম্পেশ গবেষণা করার খোরাকও পেয়ে গেলেন কিছু গবেষক !
চিত্র ৫ - পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আসন্ন বিপদের কথা ভাবছেন ! মহাজাগতিক রশ্মি কিছু সময়ের জন্য কোনও বাধা না পেয়ে পৃথিবীতে পতিত হলে জীবজগতের কী ক্ষতি হতে পারে সেটা নিয়েই বিশ্লেষণ চলছে !
চিত্র ৬ - হলিউডের ব্লকব্লাস্টার ফিল্ম '২০১২' গত ১৩ নভেম্বর, ২০০৯ তারিখে মুক্তি পেয়েছে । মুভিটি সারা বিশ্বে হিট !

              ২১ ডিসেম্বর ২০১২ । ঠিক এই তারিখেই ঘটতে চলেছে মহাপ্রলয় ! ২০০২ সালে প্রকাশিত 'দি অরিয়ন প্রোফেসি' নামক বইয়ে জনৈক বেলজিয়ামের লেখক পেট্রিক গেরিল-এর অন্তত এমনটিই দাবি । আর তিনি তাঁর এই দাবিকে পাকাপোক্ত করার জন্য  বিজ্ঞান আর মাইথোলজির আশ্রয় নিয়েছেন ; নিট ফল - বইটি বেস্টসেলিং -এর তালিকায় । এর তিন বছর পর ওই লেখকের আরও একটি বই বের হয় - 'দি ওয়ার্ল্ড কেটাক্লিসম ইন ২০১২' । বলাবাহুল্য এই বইটিও বাজার মাত করেছিল । এরই মধ্যে তৈরী হয়েছে 'হাউ টু সারভাইভ ২০১২ ডট কম' নামে একটি ওয়েবসাইট । সেখানেই বর্ণনা আছে শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথা , আর মহাপ্রলয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার নানা উপায় । ওয়েবসাইটের বয়ান থেকে এটা পরিষ্কার যে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করেই টিকে থাকতে হবে এই গ্রহে ।

            মাইথোলজি কী বলছে ? পেট্রিক গেরিল মায়া সভ্যতা আর মিশরীয় সভ্যতার পুরনো নথিপত্র ঘেটে বলতে চেয়েছেন যে ২১ ডিসেম্বর , ২০১২ তেই নাকি নেমে আসছে শেষের সেই দিন ! তার এই দাবিকে জোরালো করার জন্য ওই সভ্যতার আগের মিলে যাওয়া কিছু ভবিষ্যত গণনার কথাও উল্লেখ করা হয় বইটিতে । 'মেসোআমেরিকান লং কাউন্ট ক্যালেন্ডার' - এ নাকি ২১ ডিসেম্বর , ২০১২ - এর পর তারিখ সমাপ্ত । মানে পৃথিবী ধবংস !

          বিজ্ঞানীরা কী বলছেন ? 'মেসোয়ামেরিকান লং কাউন্ট ক্যালেন্ডার' কে বিজ্ঞানীমহল বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছেন । মায়া সভ্যতার কিছু মানুষ এক ভুল সত্যের পেছনে ছুটেছিলেন , এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মনে কোনও সন্দেহ নেই । সেই সভ্যতা নিঃসন্দেহে উন্নতমানের ছিল কিন্তু এর মানেই এই নয় যে ওদের সব ধারণাই সঠিক ছিল ।

         টিভি অথবা খবরের কাগজে ক'বছর পরপর 'মহাপ্রলয়' নিয়ে নানা চমকপ্রদ খবর বের হয় ! সাইবার জগতেও এর ব্যাপ্তি বিশাল । ইন্টারনেটের হাজার হাজার অয়েবসাইটেও রয়েছে মহাপ্রলয় নিয়ে অবিশ্বাস্য কথা ! এর সত্য মিথ্যা যাচাই করাটাও অনেকসময় কঠিন হয় । কারণ ঐ ধারণাগুলি বিজ্ঞানের প্যাকিং দিয়ে এমনভাবে মোড়া হয় যে আসল সত্য ভিতরেই থেকে যায় ।

         নিজেকে একজন গবেষক বলে জাহির করা পেট্রিক গেরিল বিজ্ঞানের আশ্রয়ও নিয়েছেন সুচতুরভাবে । তার বই এ 'জিওম্যাগনেটিক রিভারসেল' তত্ত্বের প্রসঙ্গ জোরালোভাবে পেশ করা হয়েছে ।

          এবার একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক 'জিওম্যাগনেটিক রিভারসেল' বা 'ভূচুম্বকীয় বিপরীতীকরণ' তত্ত্বটা আসলে কি ? একটা চুম্বকের বাটকে যদি শূন্যে সুতো দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া যায় তবে দেখা যায় যে সেটা সবসময় পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণ মেরু বরাবর অনুভূমিক ভাবে অবস্থান করে । আসলে পৃথিবী নিজেই একটা বিশাল চুম্বক । চুম্বকের বিশেষত্ব হল এর উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরু । পৃথিবীর ক্ষেত্রে ওর ভৌগলিক উত্তর গোলার্ধেই রয়েছে চুম্বকীয় উত্তর মেরুর অবস্থান, আর দক্ষিণ গোলার্ধে রয়েছে চুম্বকীয় দক্ষিণ মেরুর অবস্থান । এই ব্যাপারটাকে কাজে লাগিয়েই তৈরী হয়েছে কম্পাস । আর দিক নির্ণয়ের কাজে কম্পাসের কোন বিকল্প নেই । কিন্তু মজার ব্যাপার হল এই মেরুগুলোও টেনিস খেলোয়ারের মত একটা 'সেট' শেষ হলে দিক পরিবর্তন করে । তখন ভৌগলিক উত্তর গোলার্ধে হয়ে যায় চুম্বকীয় দক্ষিণ মেরু, আর দক্ষিণ গোলার্ধে চুম্বকীয় উত্তর মেরু । এই পরিঘটনাকেই 'ভূচুম্বকীয় বিপরীতীকরণ' বলা হয় । এই বিপরীতীকরণ হতে সময় লাগে কয়েক হাজার বছর । পৃথিবীর ক্ষেত্রে এর কোন বাধাধরা নিয়ম নেই । কখনো ৫০ হাজার বছরেও মেরু বিপরীতীকরণ হয় আবার কখনো এর থেকে বেশী সময়ও লাগে । যেমন পৃথিবীর শেষ মেরু বিপরীতীকরণ হয়েছিল প্রায় ৭ লক্ষ ৮০ হাজার বছ আগে । এর পরেরটা কবে হবে সেটা বলা একটু কষ্টকর । এখানে উল্লেখ্য যে সূর্যের মেরু বিপরীতীকরণ হতে সময় লাগে মাত্র ১১ বছর । আর এই সময়টাও প্রায় অপরিবর্তিত থাকে । ২০০১ সালে সূর্যের এই বিপরীতীকরণ হয়েছিল । আগামী ২০১২ সালে আবার সেই বিপরীতীকরণ হওয়াটাও পাকা । 

        আবার চলে আসি পেট্রিক গেরিল প্রসঙ্গে । ওনার মস্তিষ্ক থেকে জন্ম নেওয়া নুতন থিওরি মতে যেহেতু সূর্যের চুম্বকীয় মেরু বিপরীতীকরণ আগামী ২০১২ সালে, তাই সেটার প্রভাবও এসে পড়বে পৃথিবীর উপরে । পৃথিবীতেও তখন মেরু বিপরীতীকরণের হাওয়া লাগবে । আর এর ফলে ভূমিকম্প, সুনামি শুরু হয়ে যাবে এই গ্রহে - ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী । 

         থিওরিটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত ? নাসার বিজ্ঞানীদের মতে সূর্যের চুম্বকীয় মেরু পরিবর্তনের সঙ্গে পৃথিবীর মেরু বিপরীতীকরণের কোন সম্পর্ক নেই । সেটা বিজ্ঞানসম্মত সত্য । পৃথিবীর ক্ষেত্রে সেই বিপরীতীকরণটা কবে হবে সেটা বলা মুশকিল । তবে সেটা যে আগামী কয়েক বছরে হবেনা এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা একমত । যদি ভূচুম্বকীয় বিপরীতীকরণ হয় তবে পৃথিবীতে কি অনাসৃষ্টি হতে পারে ? আসলে পৃথিবীর চুম্বকীয় ক্ষেত্র সূর্য থেকে আসা ক্ষতিকারক রশ্মিকে পৃথিবীতে আসতে বাধাদান করে । এর ফলেই জীবজগত ঐ ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে সুরক্ষিত আছে । মেরু  বিপরীতীকরণের সময় সামগ্রিক কিছু সময়ের জন্য পৃথিবীর চুম্বকীয় ক্ষেত্র কমে যেতে পারে । আর এর ফলে ক্ষতিকারক রশ্মি পৃথিবীতে এসে ঢুকবে । তবে  বিজ্ঞানীরা অভয় দিয়ে বলেছেন যে এর ফলে মারাত্মক কোন ক্ষতি হবেনা । কারণ এর আগেও পৃথিবীতে এমন ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু জীবকুল বিলুপ্ত হয়ে যায়নি । আর মেরু  বিপরীতীকরণের জন্য ভূমিকম্প বা সুনামির মত ঘটনা ঘটবে এর কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই । 

              রোলান্ড এমেরিক পরিচালিত ২০০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের হলিউড মুভি '২০১২' গত ১৩ নভেম্বর ২০০৯ এ মুক্তি পেয়েছে । এই মুভি মহাপ্রলয়ের থিম নিয়েই তৈরী হয়েছে । মুভিটি সারা বিশ্বে হিট । আর  পরিচালক যা ভবেছিলেন তাই হয়েছে । মহাপ্রলয়ের যুযু দেখিয়ে মুনাফা অর্জনের পথটাও হলিউডের জানা আছে । 

          ২১ নয়, ২২ ডিসেম্বর ২০১২ । সেদিন অবশ্যই একটা ই-মেল করবো - পেট্রিক গেরিলকে । আর বলবো যে ভাওতাবাজী দিয়ে ব্যবসায় করা যায়, কিন্তু   বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ সাধক হওয়া যায় না । পাঠকদের জন্য ই-মেল ঠিকানা দিলাম, ইচ্ছে হলে আপনারাও মেল করতে পারেন - patrick.geryl@skynet.be



No comments:

Post a Comment