Wednesday, July 21, 2010

রক্তস্নাত একুশে জুলাই

২১শে জুলাই, ১৯৮৬ । সকালে বাবা আর আমি খেতে বসেছি । মেনু – কাঁচকলা আর আলু সেদ্ধ ভাত । বাবার খুব তাড়া, সার্কিট হাউসে যেতে হবে । কারণ জিজ্ঞাসা করতেই তিনি গম্ভীর হয়ে একটি কথাই বললেন – “ভাষা আন্দোলন” । হঠাৎ বাবার বিষম উঠলো । ভালো করে খাওয়া হয়ে উঠলোনা । এর স্বল্পক্ষণ পর কয়েকবার গুলিচালনার শব্দ শুনতে পেলাম । বাবাকে বলতেই ব্যাপারটা তিনি পাশ কাটিয়ে বললেন যে পটকার শব্দ হতে পারে । বাবা আঁচ করতে পেরেছিলেন যে হয়তো কিছু ঘটতে চলেছে । তাড়াহুড়োর মধ্যেই তিনি বেরিয়ে গেলেন । তারপর দু’ দু’টো রাত কেটে গেল, বাবার কোন খবর নেই ।


            ক্লাস ফাইভের ছাত্র হিসেবে করিমগঞ্জের নীলমনি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সদ্য ইংরেজী শিখতে শুরু করেছি । বাংলা ভাষার পাশাপাশি আরো দু’টি ভাষা হিন্দি আর ইংরেজী শিখতে পারবো বলে কত আনন্দ । বাবার মুখেই শুনতাম বিদেশে যেতে হলে অনেক ভাষা জানতে হয় । কারণ ভাষা শেখার বিকল্প নেই । “ভাষা আন্দোলন” শব্দটা আমার কাছে কেমন জানি বাঁধো ঠেকলো ! ভাষার জন্য আবার আন্দোলন করতে হয় না কি ? এখানে তো সবাই দিব্যি বাংলা বলছে । ২১শে জুলাই-এর রাতে মা এর মুখেই শুনতে পেলাম বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এই আন্দোলনে দু’দুটো তাজা প্রাণ শহিদ হয়েছে, আর আহতের সংখ্যা অগনিত । কার্ফ্যু হয়ে যাওয়ায় পর বাবার কোন খবর পাওয়া যাচ্ছিলনা । বাবাও কি তবে ...। আমরা কেউ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতেই পারছিলাম না । পরদিনও সারাক্ষণ উৎকন্ঠায় কাটলো । একদিকে সেনার ফ্ল্যাগ মার্চ আর অপরদিকে পুলিশের ঘন ঘন টহল, পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছিল । ২৩ শে জুলাই সকাল বেলা খবর পেলাম যে বাবা সিভিল হাসপাতালে রয়েছেন । এক ঘন্টার জন্য কার্ফ্যু উঠার পর তড়িঘড়ি মা আর দিদি হাসপাতালে বাবাকে আহত অবস্থায় দেখে এলেন ।

              ভাষা আন্দোলনের অতীত যে অনেক পুরানো তা পরে জেনেছিলাম । ১৯৬০ সালে আসাম রাজ্যভাষা আইন চালু হওয়ার পর থেকেই বরাক উপত্যকার বাংলাভাষীদের উপরে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে সামিল হয় মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহার সরকার । এর ফলস্বরূপ ১৯৬১ এর ১৯শে মে-এর ভাষা আন্দোলনে শিলচরে পুলিশের গুলিতে এগারো শহিদের রক্তে রাঙ্গা হয়ে উঠে শিলচর রেলস্টেশন চত্বর । চালিহা সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয় । কিন্তু চক্রান্ত চলতেই থাকে । ১৯৭২ সালে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় একটি চরম সিদ্ধান্ত নেন যে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হবে একমাত্র অসমীয়া ভাষা । তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী শরৎচন্দ্র সিংহ ও ঝোপ বোঝে কোপ মারলেন । উনার মন্ত্রীসভাও ১৯৭২ সালে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো যে মাধ্যমিক পর্যায়ে অনসমীয়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য অসমীয়া ভাষা বাধ্যতামূলক করা হবে । এই সিদ্ধান্তের বিরূদ্ধে বরাকে আবার আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠলো । অবশেষে সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়, আর অনির্দিষ্ট কালের জন্য গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অসমীয়া ভাষাকে একমাত্র মাধ্যম করার প্রস্তাবটি স্তগিত রাখা হয় এবং সঙ্গে ভাষা সার্কুলারটিও । ১৯৮৫ এর ডিসেম্বর মাসে প্রফুল্ল কুমার মহন্ত ক্ষমতায় বসেই ভাষা সার্কুলারের “মাইন” আবার নুতন করে পুঁতবার প্রস্তুতি শুরু করলেন । দিসপুর থেকে বরাক উপত্যকায় নির্দেশ আসলো অসমীয়া ভাষা এখন থেকে বাধ্যতামূলক হবে । আবারও গর্জে উঠার পালা এই উপত্যকার অবহেলিত মানুষদের । ১৯৮৬ সালের ২১শে জুলাই মুখ্যমন্ত্রীর করিমগঞ্জ সফরে ভাষা সার্কুলারের বিরূদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দেওয়ার জন্য শতশত মানুষ সামিল হলেন ভাষা আন্দোলনে ।

              ২১শে জুলাই, ১৯৮৬ । সকাল ন’টা । তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লকুমার মহন্তের হেলিকপ্টার করিমগঞ্জ শহরের অদূরে মাইজডিহিতে অবস্থিত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হ্যালিপেডে এসে নামলো । সার্কিট হাউসের সামনে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় আসার পর দেখা গেল কালো পতাকা নিয়ে অগনিত মানুষের জটলা । জেলা প্রশাসনের মদতে জনতার ভিড় ঠেলে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় সার্কিট হাউসের দিকে চলে গেল । ততক্ষণে আন্দোলনকারীদের পালে হাওয়া লেগেছে । ‘অগপ সরকার মুর্দাবাদ’, ‘প্রফুল্ল কুমার মহন্ত মুর্দাবাদ’ ধ্বনিতে কেঁপে উঠলো সার্কিট হাউসের আশপাশ । উত্তপ্ত হয়ে উঠলো আন্দোলনের পরিবেশ । এরই মধ্যে পুলিশের কাজ শুরু হয়ে গেল । ‘কেলা বঙালি’ বলেই আন্দোলনকারীদের উপর লাঠি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো আসাম পুলিশের বর্বর ব্যাটেলিয়ান । সার্কিট হাউসের বারান্দায় এসে মুখ্যমন্ত্রী মহন্ত পর্যবেক্ষণ করে গেলেন তার সরকারী বাহিনীর দাপট । এদিকে পুলিশের লাঠিচার্জে বিক্ষোভকারীরা বেসামাল হয়ে পি ডবলিউ ডি অফিসের সামনে জমায়েত হতে লাগলেন । এর অল্পকিছুক্ষণ পর মুখ্যমন্ত্রী মহন্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়ে আন্দোলনকারীদের পাত্তা না দিয়ে নিমিষে বেরিয়ে যান পরবর্তী গন্থব্যস্থল ফকিরাবাজারের দিকে । নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের মধ্যে কেউ কেউ পুলিশের দিকে ঢিল ছোঁড়তে শুরু করে । ব্যস – তারপর অগ্নিশর্মা পুলিশের দল গুলি চালনা শুরু করে দেয় । সময় তখন সকাল ন’টা পঞ্চান্ন । বুলেটের ছোবলে জগন্ময় দেব (জগন) আর দিব্যেন্দু দাস (যীশু) লুটিয়ে পড়লেন পি ডবলিউ ডি অফিসের সামনে । শহিদের রক্তে করিমগঞ্জের মাটি পবিত্র হয়ে উঠলো । আহত মানুষদের আর্তনাদে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠলো ।

               “ঘর থেকে বের হবার পর আমি খবর পেলাম পুলিশের লাঠি চার্জ আর ফায়ারিং-এ শহরের পরিস্থিতি থমথমে । রেডক্রস আর সরকারি হাসপাতালে আহতদের ভিড় । তাই হাসপাতালে ছুটে গেলাম আহত আন্দোলনকারীদের সাহায্যে । সুপারিন্টেনডেন্টের ঘরে যখন আহত মানুষদের খবর নিচ্ছি তখন হাসপাতাল চত্বরে প্রবেশ করলেন করিমগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার মহন্ত । এসেই তিনি আমাকে দেখে বললেন ‘দুলাদা আপনাকে আমি গ্রেফতার করলাম । চলুন গাড়িতে ।’ হাসপাতালের সীমানা থেকে বের হবার আগেই মহন্তের সেনাবাহিনী আমার দিকে ছুটে আসলো, আর এলোপাথারি লাঠির আঘাত করতে লাগলো । হাত দিয়ে আটকাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু গাড়িতে উঠার পর সেটা যেন বেড়ে গেল । বুটের লাথি আর লাঠির আঘাতে জর্জরিত এক বৃদ্ধকে ক্ষমা দেখাবার ন্যূনতম সৌজন্যবোধ দেখালো না আসাম পুলিশের বর্বর দল । পুলিশের গাড়িতে অন্যান্য আন্দোলনকারীদেরও একই অবস্থা । অবশেষে থানায় এনে আমাদের বস্তার মত ফেলে দেওয়া হল । অনেক অনুরোধের পর আমাদের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হল । ডান হাতটা ভীষণ ব্যথা করছিল । ভাবতেই পারিনি যে হাত ভেঙ্গে গেছে । হাসপাতালে আসার পর চশমা না থাকায় খুব অসুবিধে হচ্ছিল । চশমার কথা জনৈক অসমীয়া পুলিশকে বলতেই অশ্লীল গালি আমার দিকে ধেয়ে আসলো । যাই হোক এক বাঙালি পুলিশ কর্মীর বদান্যতায় অবশেষে চশমাটি পেলাম ।” বক্তা আমার বাবা হিমাংশু শেখর দাস (দুলা) । এই ঘটনার রোমন্থন অনেকবারই তিনি করেছেন । প্রতিবারই আমার মনে হতো নুতন ঘটনা শুনছি । কারফিউ উঠার পর রোজ হাসপাতালে বাবার ওখানে যেতাম আর শুনতাম নানা গল্প । পুলিশের অকথ্য অত্যাচারের গল্প তখন ঘরে ঘরে মা বোনদের আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছিল । অনেক নেতারাও বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন । এদের মধ্যে রথিন সেন, রণেন্দ্রমোহন দাস (দুলুবাবু), নৃপতি চৌধুরী, সুজিৎ চৌধুরী, লোপামুদ্রা চৌধুরী প্রমুখ । বর্তমান কংগ্রেস সরকারের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ও সেসময় করিমগঞ্জ সফর করেন আর বাবার সঙ্গে আন্দোলন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয় । কলকাতার পাক্ষিক পত্রিকা “প্রতিক্ষণ” বিস্তারে ২১শে জুলাই এর ঘটনা নিয়ে ১৭ আগস্ট, ১৯৮৬ সালে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে । সেই সংখ্যার ম্যাগাজিনে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাবার একটি সচিত্র (চিত্রঃ ১) রিপোর্ট বের হয় যা বাবা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত একখানি কপি আগলে রেখে ছিলেন । বাবা ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী । বৃটিশের বিরূদ্ধে আন্দোলনের অনেক কথাই উনার মুখে শুনেছি । বাবা কখনো আক্ষেপ করে বলতেন যে স্বাধীন ভারতে এখন স্বদেশী ভাইদের বিরূদ্ধে ভাষার অধিকার নিয়েই লড়াই করতে হচ্ছে । বাবার অবশ্য এক আলাদা রাজনৈতিক পরিচয়ও ছিল । প্রথম জীবনে তিনি জনসঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । পরে যখন জনসঙ্ঘ বিভক্ত হয়ে ‘জনতা পার্টি’ আর ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’ হয় তখন বাবা জনতা পার্টিতে যোগ দেন । দীর্ঘকাল তিনি জনতা পার্টি (পরে জনতা দল) এর সম্পাদক আর সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন । বাবা করিমগঞ্জ থানার ও সি মহন্ত এন্ড কোম্পানীর বিরূদ্ধে মামলাও করে ছিলেন । মহন্ত এবং আর এক পুলিশ অফিসার বদরুল হক লস্কর আমাদের বাড়িতে প্রায়ই এসে বাবাকে কেস তুলে নেবার জন্য কাতর অনুরোধ করতো । কিন্তু বাবা তাদের কথায় কর্ণপাত করেননি । অনেকদিন সেই মামলা চলার পর দেখা গেল শেষে সাক্ষী দেবার লোক নেই । মহন্তের চোখ রাঙ্গানিতে ওরা ভয় পেয়ে গিয়েছিল । কেসের গতি রুদ্ধ হয়ে গেল । সাক্ষী হিসেবে বাবা উনার সেদিনের পরিহিত রক্তরাঙ্গা কাপড়ও রেখেছিলেন । কিন্তু ২১শে জুলাইয়ের ভিলেনদের কোন বিচার হলনা ! সেই আক্ষেপ বাবা বাকী জীবন বয়ে গিয়েছিলেন ।

                'প্রতিক্ষণম্যাগাজিনের (১৭ আগষ্ট, ১৯৮৬) রিপোর্টের একটি অংশ ।

          ২১শে জুলাই এর ঘটনা বাংলা ভাষার প্রতি আমার এক আলাদা তাগিদ সৃষ্টি করে । ১৯৬১ এর ভাষা আন্দোলনেও বাবা একজন সৈনিক ছিলেন । সেসময় করিমগঞ্জ রেলষ্টেশন চত্বরে পুলিশের লাঠির আঘাতে বাবার পা ভেঙ্গে যায় । “যুগান্তর” পত্রিকায় বাবার একখানি ফটো আর উনাকে নিয়ে একটি রিপোর্টও বেরিয়ে ছিল । পত্রিকার কাটিং রাখার এক বিচিত্র শখ ছিল বাবার । প্রচারবিমুখ বাবা উনার ফাইলে ১৯৬১ সালের ভাষা আন্দোলনের অনেক দুর্লভ কাটিং সংগ্রহ করে রেখেছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আজ সেই সব আমার কাছে কিছুই নেই । এই উপত্যকার প্রতিটি মানুষের বাংলা ভাষার প্রতি এক তাগিদ আসলে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করা । প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে বরাকের সর্বস্তরের মানুষই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল । তাই ভাষা আন্দোলন নিয়ে যখন কোন আলোচনা হয় তখন প্রচারবিমুখ বাবার অবদানের জন্য নিজেকে বড় গর্বিত মনে হয় ।

No comments:

Post a Comment