Saturday, March 19, 2011

‘সুপারমুন’-এর আবির্ভাবে সারা বিশ্ব আতঙ্কিত



লড়াই বেশ জমে উঠেছে ! ভবিতব্য বনাম কাকতালীয়-এর দ্বৈরথে তামাম বিশ্বের জনগণ দিশেহারা ! পৃথিবীর খুব কাছের উপগ্রহ চাঁদ প্রায় ১৮ বছর পর আজকের দিনেই সবথেকে নিকটে আসছে । আর তার এত কাছে আসা নিয়েই যত কাণ্ড । পূর্ণিমার চাঁদের আজ রাতের পোশাকী নাম সুপারমুন কি সত্যি প্রলয়ঙ্করের বার্তা নিয়ে এসেছে ?
     সম্প্রতি জাপানের সুনামি নিয়ে যখন সারা বিশ্ব আতঙ্কিত, তখন এর নেপথ্য ভিলেন হিসেবে চাঁদের নাম এসে যাওয়াটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত সেটা নিয়েই এখন জোর চর্চা চলছে । লড়াইটা জ্যোতিষী বনাম জ্যোতির্বিদ-দের । চন্দ্র যখন পৃথিবীর খুব কাছে আসে তখন নাকি ভূমিকম্প, সুনামি, অনাবৃষ্টি, সাইক্লোন, আগ্নেয়গিরি উদ্গীরণ ইত্যাদি নানা বিপর্যয় এসে পৃথিবীকে গ্রাস করে । মুন থেকে সুপারমুন হয়ে উঠার পেছনে রয়েছে নানা ঘটনা । আর জ্যোতিষীদের এই বিশ্বাস নিয়েই যত আপত্তি জ্যোতির্বিদদের !
     চন্দ্র উপবৃত্তাকার পথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে । এই ভাবে প্রদক্ষিণ করতে করতে একটা সময় আসে যখন সে পৃথিবীর সব থেকে দূরে চলে যায় । তখন তাকে অপভূ অবস্থান বলা হয় । এই দূরত্ব প্রায় চার লক্ষ ছয় হাজার তিনশো কিলোমিটার হয় । আর যখন চন্দ্র সব থেকে কাছে চলে আসে তখন তাকে অনুভূ অবস্থান বলা হয় ।  তখন পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব হয় মাত্র তিন লক্ষ ছাপ্পান্ন হাজার ছয়শো কিলোমিটার । আর সে সময় চন্দ্রের আকৃতিও রোজকার আকার থেকে প্রায় বারো শতাংশ বড় হয় । সুপারমুন - চাঁদের বড় আকৃতির জন্য ১৯৭৯ সালে চন্দ্রের এই জম্পেশ নাম দিয়ে ছিলেন রিচার্ড নলে নামক এক জ্যোতিষী । তবে বেডমুন নামকরণ থেকে রিচার্ডের বিরত থাকার কারণটা অবশ্য অজ্ঞাত । তার বিশ্বাসমতে সুপারমুন পৃথিবীতে প্রলয়ঙ্করের বার্তা নিয়ে আসে ।
মহাপ্রলয়ের বিশ্বাসে বিশ্বাসীরা তো এক ধাপ এগিয়ে বলতে শুরু করে দিয়েছেন যে সুপারমুন মহাপ্রলয়ের সাইরেন বাজাতেই এসেছে যার জলজ্যান্ত উদাহরণ জাপানের প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প আর তৎসঙ্গে সুনামি । আর মহাপ্রলয়ের জুজুতে যারা কাবু তাদের জন্য এই পরিঘটনা মস্তিষ্কে আলোড়ন তুলেছে । এর পেছনে সম্ভাব্য বৈজ্ঞানিক কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে যেহেতু চন্দ্র পৃথিবীর খুব নিকটে আসছে তখন চন্দ্রের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রকোপ পৃথিবীতে বেশী হবে, তার দরুণ পৃথিবীর চাঞ্চল্যতা বেড়ে যাবে । নিটফল- ভূমিকম্প, সুনামি, প্রবল ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি অঘটনের আবির্ভাব । অতীতেও সুপারমুন এর সময় তেমন ঘটনার উদাহরণ আছে । ১৯৩৮ এ ব্রিটেনে প্রবল ঝড়, ১৯৭৪ এ ভয়ঙ্কর সাইক্লোন, ২০০৫ এ ক্যাটরিনা হারিকেন, আর সাম্প্রতিক ২০১১ এর মার্চে জাপানের বিধ্বংসী সুনামি ইত্যাদি সুপারমুন এর বেড ইমেজ প্রদর্শন করছে । তাই সুপারমুন এর আবির্ভাবে  প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা ভবিতব্য !
নিতান্তই কাকতালীয় ! বলছেন বিজ্ঞানীরা । জাপানের ৮.৯ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পের পর নাসার বিজ্ঞানী ডেভ উইলিয়াম ঘটনার পেছনে সুপারমুনের অদৃশ্য হাতের কথা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন । আমেরিকার জিওলোজিকেল সার্ভের ভূপদার্থবিদ জন বেলিনি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে সুপারমুন এর বিজ্ঞানসম্মত সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন । তার মতে এটা পরীক্ষিত সত্য নয় । ব্রিষ্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূকম্পবিদ প্রোফেসর জর্জ হেলফ্রিকও এ ব্যাপারে একমত । ভূমিকম্পের মূল কারণ যে পৃথিবীর অন্দরে প্লেটের গতিশীলতার জন্য তা তিনি জোরগলায় বলেছেন । আর এর সঙ্গে চাঁদের প্রবল আকর্ষণের কোন কারণ নেই । আসলে আমাদের পৃথিবীর উপরিভাগ কঠিন হলে কি হবে তার অন্দরমহলে রয়েছে গরম, গলিত বস্তু । পৃথিবীর বহিঃস্তরে লিথোস্ফিয়ার আর অ্যাস্থেনোস্ফিয়ার নামক দুইটি স্তর আছে । লিথোস্ফিয়ার কঠিন, ঠান্ডা এবং অ্যাস্থেনোস্ফিয়ার তরল আর গরম । এই লিথোস্ফিয়ার মূলতঃ কয়েকটি প্লেটে বিভক্ত  যাকে টেক্টোনিক প্লেটস বলা হয়ে থাকে । এই প্লেট গুলো অ্যাস্থেনোস্ফিয়ার এর উপর ভাসতে থাকে । এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আমাদের সাতটি মহাদেশ কয়েকটি প্লেটের উপরে ভাসমান । এই প্লেটগুলো কিন্তু ধীরে ধীরে সঞ্চালিত হতে থাকে । বিজ্ঞানীদের মতে হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি নাকি এই প্লেটগুলোর সঞ্চালনের জন্য হয়েছে । যখন দুটি পাশাপাশি প্লেটের মধ্যে ঘর্ষণ হয় তখন কখনো কখনো ঐ প্লেটের সংযোগস্থলের উপরে থাকা অঞ্চলে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে ।  জাপান দাঁড়িয়ে রয়েছে তেমনই একটি গতিশীল প্লেটের উপরে যা আবার দুটি প্লেটের সংযোগস্থলও । তাই বিজ্ঞানীরা জাপানকে ভূমিকম্পের জন্য খুব বিপজ্জনক অঞ্চল বলে চিহ্নিত করেছেন । গত ১১ মার্চ প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে থাকা প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটটি এক ধাক্কায় ইউরেশীয় প্লেটের তলায় ঢুকে যাওয়াতেই ঘটে গেল জাপানের সাম্প্রতিক ভুমিকম্প।
আহমেদাবাদের ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী প্রোফেসর নরেন্দ্র ভান্ডারির বললেন ‘‘সুপারমুন এর ফলে শুধু জোঁয়ার ভাটায় প্রভাব পড়বে । আর এটা সত্য যে চন্দ্র সূর্যের আকর্ষণের জন্যই জোঁয়ার ভাটা হয়ে থাকে । সুপারমুন এর সময় সমুদ্রের জলোচ্ছাস আর জোঁয়ারের দাপট বেড়ে যাবে । ব্যস এই পর্যন্তই । এর থেকে বেশী প্রভাব পৃথিবীতে পড়বেনা ।
তাই সুপারমুন নিয়ে গুজব কল্পনার জগতে আলোড়ন তুলতে পারে, কিন্তু বাস্তবে মুন-এর প্রত্যক্ষ প্রভাব কোনভাবেই পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকারক নয় । সুপারমুন এর সুপারম্যান ইমেজ অক্ষত থাকবে তা যতই ওকে কালিমালিপ্ত করা হোক না কেন !        

2 comments:

  1. বাহ! বিজ্ঞান নিয়ে বাংলাতে তোমার এই লেখালেখি অসমের বাঙালিদের পথ দেখাক এই আশা করছি। একেতো বাংলাতে ব্লগ লেখালেখি বাড়াই উচিত। আমাদের পূর্বোত্তর এতে পিছিয়ে আছে। তার উপর বিজ্ঞান চর্চা। তোমার জবাব নেই। তুমি খুব ভালো লেখালেখি করছ। আমি নিয়মিত কাগজে তোমার লেখা দেখলেই পড়ি।

    ReplyDelete
  2. তোমার ব্লগে ফলোয়ার গেজেট আর সেয়ার গেজেট না থাকা ভালো কথা নয়। জুড়ে দাও।

    ReplyDelete