Tuesday, February 1, 2011

আবেগের জোয়ারে ভাসলেন দাদা


তাঁকে নিয়ে আবেগের আলোড়ন যে এই অঞ্চলে অনেকদিন থেকেই বিরাজমান এই খবর তিনি রাখেন । আর তাই তো আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরোধে এত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি চলে আসেন অত্যন্ত স্বল্পকালীন সফরে, আবেগের সমুদ্রে অবগাহন করতে ।
     রাতারাতি কোনো নায়ক হয়ে উঠেননি তিনি চারিত্রিক দৃঢ়তা, লড়াকু মানসিকতা আর ইতিবাচক চিন্তার যথাযথ প্রয়োগ করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ক্রিকেট খেলায় ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কাপ্তান । বিশ্বের দরবারে ভারতের মানকে কয়েক ধাপ উপরে নিয়ে যাবার মহানায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, অবশেষে হাজির শহিদের শহর শিলচরে । বরাকবাসীর গর্বের বিশ্ববিদ্যালয় সৌরভকে সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধিতে ভূষিত করলো যা তাঁর পদক প্রাপ্তির ভাঁড়ারে নবতম সংযোজন ।
     কলকাতা থেকে সৌরভের শুধু একটিই বার্তা ছিল যে সকালে শিলচরে এসে একটু জিমে যাওয়ার ব্যবস্থা যেন করা হয়শরীরচর্চা দিয়েই তাঁর রোজকার জীবন শুরু হয়, তাই বাংলার দ্বিতীয় ভূখণ্ডে এসেও তিনি তা ফাকি দিতে চাননা । নিয়মানুবর্তিতা যে তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে । বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে তাই কাছাড় ক্লাবেই তাঁর বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয় যেখানে রয়েছে আধুনিক ব্যায়ামাগার মঙ্গলবার সকাল ঠিক আটটা দশে সৌরভ শিলচরে চেক ইন করেন । তারপর ফ্রেশ হবার পর প্রাতরাশের কথা বলায় তিনি মানা করেন । ধীরে ধীরে প্রস্তুত হচ্ছেন জিমে যাবেন, তখন ঘড়িতে নটা বেজে গেছে । এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘন ঘন ফোন আসছে, কারণ অনুষ্ঠান উদ্বোধনিতে গাঙ্গুলির উপস্থিতি যে খুবই দরকার । খবরটি দাদার কানে পৌছার পর শরীরচর্চা আপাত স্থগিত রেখে বেরিয়ে পড়লেন সৌরভ । ঘড়িতে তখন সকাল নটা দশ । 
     প্রিন্স অব কলকাতা-যে ডক্টরেট উপাধিতে ভূষিত হতে যাচ্ছেন এ খবর ইন্টারনেটের জনপ্রিয় সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ফেসবুক এর মাধ্যমে তামাম বিশ্বের মানুষ কিছুদিন আগেই জেনে গেছেন ব্লগের অসংখ্য পাতায় ফুটে উঠছে মহারাজের ফ্যানদের শুভেচ্ছা বার্তা । বলতেই হয় সাইবার জগতে ক্রিকেটের রয়াল বেঙ্গল টাইগারের উপস্থিতি ক্রিকেট জগতের মতই উজ্জ্বল । 
বরাক উপত্যকায় সৌরভের ঝটিকা সফর এক আলাদা ইতিহাস রচনা করলো । কারণ এই গ্রহে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ই সর্বপ্রথম তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধিতে সম্মান জানালো । নিঃসন্দেহে সৌরভের ব্যক্তিগত প্রোফাইলের পাতায়ও পয়লা ফেব্রুয়ারির দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবেএর ঠিক দেড় বছর আগে ১৫ জুলাই ২০০৯ এ খেলাধুলায় অসামান্য অবদানের জন্য ব্রিটেনের সেন্ট্রাল ল্যাঙ্কাশায়ার ইউনিভার্সিটি  সৌরভকে সাম্মানিক বৃত্তি প্রদান করে ।
সকাল ঠিক দশটা দশে সাদা স্করপিও গাড়িটি এসে নেতাজী মঞ্চের পাশে এসে দাঁড়ালো । গাড়ি থেকে নেমে এলেন বাঙালির একালের রোল মডেল সবার প্রিয় দাদানীল ব্লেজার-স্যুট আর বেগুনি টাই এর ব্যাকগ্রাউণ্ডে সাদা শার্ট পরিহিত দাদা বা হাতের রূপালি রঙের রোল রয়েস ঘড়িটা সূর্যের আলোতে চকচক করছে ।  খয়েরী রঙের ফ্রেমের চশমা পরিহিত মানুষটাই আজকের অনুষ্ঠানের মুখ্য আকর্ষণ । আর একটু পরই পোষাক বদলে সোনালি সুতোয় কাজ করা লাল গাউন পরবেন তিনি ।  দাদার ঠিক পেছনে ঘোড়ার উপর বসে থাকা নেতাজীর মূর্তি মনে করিয়ে দিচ্ছিল বাঙালির সেকালের আর এক রোল মডেলের কথা । প্রকৃত অর্থেই সেকাল আর একালের যুগলকে একই ফ্রেমে দেখে মন প্রাণ ভরে উঠলো ।  
নেতাজী মঞ্চের দিকে দাদার বীরদর্পে হেঁটে যাওয়া মনে করিয়ে দিচ্ছিল পুরানো দিনের দৃশ্য সেই আত্মবিশ্বাসী অভিব্যক্তি যা কিনা ক্রিকেটের ময়দানে সৌরভকে এক আলাদা পরিচয় এনে দেয় । সমাবর্তন অনুষ্ঠানের স্পটলাইট যেন আজ কিছুটা পক্ষপাতপুষ্টভেতরে উপস্থিত ডিগ্রিধারি থেকে পদাধিকারী-হাজার জোড়া চোখ প্রাণ ভরে দেখছে ক্রিকেট বিশ্বের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে । শিক্ষায়তনিক পরিসরে দাদার উপস্থিতি খেলা আর শিক্ষার জগতকে যেন আজ পাশাপাশি নিয়ে এলো
উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্যের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সৌরভের কেরিয়ারের গ্রাফ নড়েচড়ে আবার উর্দ্ধমুখে ধাবিত হল । মৃদু হাসি দাদার মুখে। এই সম্মান যেন ভুলিয়ে দেবে সব বঞ্চনা...।  
তারপর নিজ আসনে বসে দাদা ভলান্টিয়ারকে ডেকে এক কাপ চা দিতে বললেন । এর অল্পকিছুক্ষণ পর সমাবর্তন অনুষ্ঠান শেষ হবার পর সাজঘরে দাদাকে পেয়ে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম - আপনাকে নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের চরম আবেগের খবর কি আপনি রাখেন? চটজলদি উত্তর, তাই তো ছুটে এলাম আবেগের সম্মান দিতে আর আগামীতেও আবার এখানে বারবার আসতে চাইবো স্বল্পকথার সৌরভ বিশ্ববিদ্যালয়কে সাধুবাদ জানাতেও ভুলেননি । পাহাড়ঘেরা ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে দাদা মুগ্ধ । আগামীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালুমনি অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হবারও প্রবল ইচ্ছে তাঁর ।
দুপুর ঠিক পৌনে একটায় দাদা স্বল্পক্ষণের জন্য খোলা মঞ্চে এসে দাড়ালেন । দাদা দাদা চিৎকারে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠলো । ক্রিকেটের ময়দানে দাপিয়ে বেড়ানো অফ সাইডের ভগবানকে দেখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথে নজরকাড়া ভিড় ছিল । যারা সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত নয় তাদের ভিড় সামলাবার জন্য কর্তৃপক্ষকে বিশেষ ব্যবস্থা করতে হয়েছে । দাদাকে একটিবার মানসচক্ষে দেখবার জন্য সবার উৎসাহ ছিল দেখার মত । বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের শিক্ষক, অশিক্ষক কর্মচারী, ছাত্রছাত্রী ছাড়াও স্থানীয় মানুষদের অবস্থানে ক্যাম্পাস এক উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল ।
দাদাকে নিয়ে এক জবর খবর জানলাম তিনি যাবার পর । বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের রিসেপশন কমিটির চেয়ারম্যান ডঃ নিরঞ্জন রায় জানালেন যে সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধিতে ভূষিত হবার আগে পর্যন্ত দাদা উপোস ছিলেন । কারণ দাদার ইচ্ছে সাত্বিকভাবেই তিনি এই সম্মান গ্রহন করবেন । আর ডিগ্রি নেবার পরই তিনি চা পান করেন, তারপর হালকা নিরামিষ খাবার । আমিষ আজ নৈব নৈব চ ।  
            সত্যি ডঃ সৌরভ চণ্ডিদাস গঙ্গোপাধ্যায়, তোমাকে হাজার সেলাম !

No comments:

Post a Comment