Wednesday, January 25, 2012

পৃথিবীতে আছড়ে পড়লো বৃহৎ সৌরঝড়




সূর্যের এই আজব ব্যামো হলেই চঞ্চল হয়ে ওঠে পৃথিবী । কারণ সূর্যের এই সাময়িক রোগ হলে  পৃথিবীকে যে নানা অশান্তির সম্মুখীন হতে হয় ! তাঁর এই ব্যাধি নিয়ে আবার চিন্তিত ধরিত্রীর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও আসলে সূর্য বাবাজির হাঁচির এক ব্যামো আছে যা কিছু বছর পর পর ঘুরে ফিরে আসে । গত ২৩ জানুয়ারি ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে নয়টায় তাঁর এক বিকট হাঁচি অশান্তির ঝড় তুললো পৃথিবীতে ।
পৃথিবীর সবথেকে কাছের নক্ষত্র সূর্য আমাদের সব শক্তির উৎস । সূর্যের অন্দরে পরমাণুর প্রতিনিয়ত বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে অফুরন্ত শক্তি । প্রায় পনেরো কোটি কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে বিকিরণের মাধ্যমে মাত্র ৮.৩ মিনিটে সূর্য থেকে সেই ভাণ্ডার পৃথিবীতে চলে আসে । পাশাপাশি ক্ষতিকারক রশ্মিও পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এসে পৌছায়, কিন্তু ওজোনস্তরের উপস্থিতির জন্য সেগুলো পৃথিবীতে পৌছাতে পারেনা । এ ছাড়া পৃথিবীর নিজস্ব চৌম্বকক্ষেত্রও এক্ষেত্রে বর্মের মত কাজ করে । তাই সভ্যতার শুরুয়াত থেকেই জীবজগত সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে সুরক্ষিত আছে । কিন্তু কখনো কখনো সূর্যের সরবরাহকৃত শক্তির যোগান হঠাৎ বেড়ে যায়, আর তখনই হয় বিপত্তি । বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ‘সৌরঝড়’ তবে এই ঝড় একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর হয় ।
     সূর্যের উপর নজরদারি করার জন্য মহাকাশ বিজ্ঞানীরা নানা কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে প্রেরণ করেছেন । সেই মহাকাশযানগুলো থেকে পাঠানো তথ্য সমৃদ্ধ করেছে সৌরবিজ্ঞানকে । সৌরজগতের সবথেকে কাছের নক্ষত্র হল-প্রক্সিমা সেন্টরাইসূর্য থেকে এর গড় দূরত্ব হল প্রায় ৪.২ আলোকবর্ষ (এক আলোকবর্ষ = ৯৫০০০০ কোটি কিলোমিটার)এত দূরত্বে তার এই অবস্থানের জন্য পৃথিবী থেকে শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেও তাকে বৃহদাকারে দেখা সম্ভব হয় না । তাই আমাদের সবথেকে কাছের তারা সূর্যের জন্মবৃত্তান্ত অধ্যয়ন করলেই জানা যাবে দূরবর্তী নক্ষত্র সম্বন্ধে নানা অজানা তথ্য । দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় তার গাত্রে নানা দাগ । যাকে সৌরকলঙ্ক (‘সানস্পট’) বলা হয় । গ্যালিলিও সর্বপ্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্রের দ্বারা এই দাগ দেখতে পান । এই দাগের সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট সময় পর বেড়ে যায় আর এর সময়কাল হচ্ছে এগারো বছর ! ২০০১ সালে সৌরকলঙ্কের উপস্থিতি  সবথেকে বেশী ছিল । আর তাই এই বছর স্বাভাবিক ভাবেই সৌর দাগের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান । মজার ব্যাপার হল  সেই সময় সূর্যের চঞ্চলতাও বেড়ে যায় যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে পৃথিবীতে ।      
নাসার বিজ্ঞানীরা গত ২৩ জানুয়ারি সূর্যের আকস্মিক বিস্ফোরণ ‘সোলার ডাইনামিকস অবজারভেটরি স্পেস ক্রাফট’-এ বিদ্যমান উচ্চ প্রযুক্তির ক্যামেরার সাহায্যে ভিডিও রেকর্ড করেছেন । বিজ্ঞানের ভাষায় এই বিস্ফোরণকে ‘করন্যাল মাস ইজেকশন’ বলা হয় । এই ইজেকশন হলে সূর্য থেকে আগত বিকিরণের মাত্রাও তখন বেড়ে যায় । এ যেন সূর্যের হাঁচি দেওয়ার মত ঘটনা । আর সূর্যের এই হাঁচিতে সৃষ্টি হয় ‘সৌরঝড়’ আগামী বুধবার পর্যন্ত এই ঝড়ের প্রকোপ থাকবে । এখানে উল্লেখ্য যে সৌর বিকিরণ ঝড়ের ফলে মূলত: সূর্য থেকে উচ্চ শক্তির প্রোটন কণা নির্গত হয় । ‘এই ঝড়ের প্রকোপ ২০০৫ সালের মে মাসে হওয়া করন্যাল মাস ইজেকশন থেকেও অনেক বেশী’ – বলেছেন নাসার বিজ্ঞানি ডঃ ডউগ বিসেকার সূর্যের আবহমণ্ডল অধ্যয়ন করার জন্য ১২টি কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবী থেকে প্রেরণ করা হয়েছে যারা প্রতিনিয়ত সূর্যের উপর নজরদারি রাখছে ।
     সৌরঝড়ের আবির্ভাবে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয় । আমাদের বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগে যেসব ‘কমুনিকেশন স্যাটেলাইট’ রয়েছে সেগুলোর উপর সব থেকে বেশী প্রভাব পড়ে । সূর্য থেকে আসা উচ্চশক্তির কণার আঘাতে ঐ স্যাটেলাইট গুলোর নানা যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে যায়,  যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থায়মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত টিভি চ্যানেল, বিমান পরিষেবা, ব্যাংকিং পরিষেবা ইত্যাদি মারাত্মক ভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয় ।  বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়ে । ২০০৫ সালের মে মাসেও তেমন সৌরঝড়ের ঘটনা ঘটেছিল । এছাড়া রয়েছে ক্ষতিকারক রশ্মির পৃথিবীতে ঢুকে পড়ার আশঙ্কা । আসলে বায়ুমণ্ডলে ওজোনস্তরের উপস্থিতির জন্য অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে পৌছাতে পারেনা । কিন্তু পরিবেশ প্রদূষণের ফলে ওজোনস্তরে দেখা দিয়েছে ফুটো, আর এ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন বিজ্ঞানীরা । এই অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে এসে পৌঁছালে মানবদেহে নানারকম চর্মরোগ দেখা দেবে । এমনকি স্কিন ক্যান্সারও হতে পারে । এছাড়া আরও নানারকম সর্বনাশা রোগের জন্ম হবারও সম্ভাবনা রয়েছে । সূর্যের সুনামির জন্য তাই পৃথিবী বাসির আতঙ্কিত হওয়া স্বাভাবিক ।     
     সৌরঝড় একটি প্রাকৃতিক ঘটনা । একে নিয়ন্ত্রিত করার ক্ষমতা বিজ্ঞানেরও নেই ! কিন্তু পৃথিবীর পরিবেশকে নিয়ন্ত্রিত করার ক্ষমতা আমাদের আছে । ওজোনস্তরের প্রলেপকে রক্ষা করার দায়িত্বও তাই পৃথিবী বাসির । কিন্তু এনিয়ে ভাবার সময় কি আমাদের আছে?

Saturday, January 14, 2012

হ্যাপি নিউ ‘হ্যাংকে -হেনরি পার্মানেন্ট ক্যালেন্ডার’




কেমন হবে যদি ...
১) দৈনন্দিন ব্যবহৃত ক্যালেন্ডারটি বছর বছর পরিবর্তন করতে না হয় !
২) জন্মের বার প্রতি বছর একই হয় !
          ৩) নূতন বছরের প্রথম দিন সবসময় রবিবার হয় !
          ৪) ক্যালেন্ডারটিতে ৩০ দিনের মাস আটটি হয় !
৫) ফেব্রুয়ারি মাস ৩০ দিন এবং জুন আর সেপ্টেম্বর মাস ৩১ দিনের হয় !
৬) জানুয়ারি, মে, জুলাই, আগস্ট আর অক্টোবর মাস ৩০ দিনের হয় !
৭) ক্যালেন্ডারটিতে কোনও বছর ৩৬৪ দিন আবার কোনও কোনও বছর ৩৭১ দিনের হয় !
... খুব মজাই হবে, তাই না ?
তেমনই এক অভিনব ক্যালেন্ডার গত ১লা জানুয়ারি ২০১২ থেকে বেসরকারিভাবে শুরু করে দিয়েছে ‘দ্য হেনরি ফাউন্ডেশন’ । ‘হ্যাংকে–হেনরি পার্মানেন্ট ক্যালেন্ডার’ নামের এই ক্যালেন্ডারটি নিয়েই এখন সারা বিশ্বে চর্চা তুঙ্গে । নেপথ্যে রয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনস হোপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী -রিচার্ড কন হেনরি আর ওয়াইটিং স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অর্থনীতিবিদ -স্টিভ হ্যাংকে । প্রচলিত ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’-টির আমূল পরিবর্তন করে নূতন ক্যালেন্ডার প্রচলনের পেছনে রয়েছে তাঁদের সুদীর্ঘ কয়েক বছরের অক্লান্ত গবেষণা । সারা বিশ্বের জনমত সংগ্রহের লক্ষ্যে ক্যালেন্ডারটি ইতিমধ্যে ফাউন্ডেশনের ওয়েবপেজে রাখা হয়েছে । বিশ্বের তামাম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মতি হাসিল হলেই ক্যালেন্ডারটি আগামী ১লা জানুয়ারি ২০১৭ থেকে চালু হয়ে যাবে ।
     সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই মানুষ দিনের হিসেবের জন্য ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে আসছে । দেশ কাল ভেদে ক্যালেন্ডারের প্রকারও ছিল ভিন্ন । এর মধ্যে হিন্দু, বাহাই, চায়নিজ, জাপানি, হিব্রু, ইসলামিক, পার্সিয়ান, গ্রেগরিয়ান, জুলিয়ান ক্যালেন্ডারগুলি অন্যতম । মূলত: চন্দ্র আর সূর্যের মাসিক বা বার্ষিক গতির উপর ভিত্তি করেই ক্যালেন্ডার নির্মাণ হতো । চন্দ্রের প্রাত্যহিক গতির উপর নির্ভর করে বানানো ক্যালেন্ডার কে ‘লুনার ক্যালেন্ডার’ বা চন্দ্র ক্যালেন্ডার বলা হয় । যেমন – ইসলামিক ক্যালেন্ডার । সূর্যের বার্ষিক গতির উপর ভিত্তি করে বানানো ক্যালেন্ডারকে ‘সোলার ক্যালেন্ডার’ বলা হয়ে থাকে । যেমন – পার্সিয়ান, জুলিয়ান, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ইত্যাদি । চন্দ্র আর সূর্য উভয়ের গতির উপর ভিত্তি করে ‘লুনি-সোলার ক্যালেন্ডার’ বানানো হয়েছিল । যেমন – হিন্দু, হিব্রু, চায়নিজ ক্যালেন্ডার ইত্যাদি । দেখা গেছে যে সূর্যের বার্ষিক গতির উপর ভিত্তি করে বানানো ক্যালেন্ডারটিই বিজ্ঞান সম্মতভাবে সঠিক । ক্যালেন্ডারের বিবর্তনের ইতিহাস খুবই চমকপ্রদ যা এই স্বল্প পরিসরে ব্যক্ত করা সম্ভব নয় । তবে ‘জুলিয়ান  ক্যালেন্ডার’ আর ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’-এর ব্যাপারে একটু জেনে নেওয়া দরকার । বিখ্যাত রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের নামেই জুলিয়ান ক্যালেন্ডার এর নামকরণ হয় । ৪৫ খৃঃ পুঃ তে জুলিয়াস সিজার এই ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন । জুলিয়ান বছরের সময় কাল ৩৬৫ দিন, যাকে ১২টি মাসে বিভক্ত করা হয় । জুলিয়াস সিজারের সময় কালেই ‘লিপ ইয়ারে’ ফেব্রুয়ারিতে একটি অতিরিক্ত দিনের সংযোজন হয় । এর মানে জুলিয়ান বছরের গড় সময় কাল ৩৬৫.২৫ দিন । বলাবাহুল্য যে এই ক্যালেন্ডার সৌর কেন্দ্রিক ছিল । কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা যায় যে সৌরবছরের নির্ভুল সময় হল ৩৬৫.২৪২৫ দিন । এর মানে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে সৌরবছরের হিসেব ১১ মিনিট বেশী ধরা হয়েছিল । পরে হিসেব করে দেখা গেল যে এই ১১ মিনিটের হিসেবের গরমিলের জন্য প্রতি চার শতাব্দীতে তিন দিন অতিরিক্ত সংযোজন হয়ে গেছে । পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি ১৫৮২ সালে সেই ভুল সংশোধন করে তখনকার প্রচলিত জুলিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে ১০ দিন কমিয়ে দেন । আর সেটি করতে ১৫৮২ সালের অক্টোবর মাস থেকে দশটি দিন কেটে হিসেবের গরমিলকে দূর করা হয় । ১৫৮৩ সাল থেকে আবার অক্টোবর মাস ৩১ দিনের হয়ে যায় । গ্রেগরির নামানুসারেই এটিকে ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’ বলা হয়ে থাকে । তবে এই ক্যালেন্ডার সব দেশে প্রচলিত হতে হতে বেশ কয়েকবছর কেটে যায় । বর্তমানে এটিই আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডার যা বিশ্বের প্রতিটি দেশ ব্যবহার করছে ।   
     এবার জেনে নেওয়া যাক নূতন ক্যালেন্ডার সম্পর্কে । ছবিতে দ্রষ্টব্য ‘হ্যাংকে–হেনরি পার্মানেন্ট ক্যালেন্ডার’-এর চিত্রটির একেবারে উপরের দিকে তাকালেই দেখা যাবে যে এতে কিন্তু কোন বছরের উল্লেখ নেই । এর মানে ক্যালেন্ডারটি প্রতি বছর বদল করার কোনও প্রয়োজন নেই । এই ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস প্রচলিত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ২০১২ এর জানুয়ারি মাসের মতই । তবে নূতন ক্যালেন্ডারে জানুয়ারি মাস ৩০ দিনের । তাই ঐ তারিখের পরই গ্রেগরির সঙ্গে হ্যাংকে-হেনরির পা মিলিয়ে চলার ছন্দে ইতি ঘটবে । নূতন ক্যালেন্ডারে ফেব্রুয়ারিকে লিপ ইয়ারে আত্মত্যাগ করতে হবেনা । তাকে যথাযোগ্য মর্যাদায়  ৩০ দিনে ফিরিয়ে আনা হয়েছে । এটির সব থেকে মজার ব্যাপার হল ক্যালেন্ডারের মধ্যের বর্ডার লাইন একটি দর্পণের মত কাজ করছে । জানুয়ারি মাসের প্রতিবিম্ব জুলাই মাস, ফেব্রুয়ারির প্রতিবিম্ব আগস্ট মাস ইত্যাদি । প্রথম ছয়টি মাসের বারের বিন্যাস গুলিই আবার পরবর্তী ছয় মাসে ফিরে আসছে । আর একটি উল্লেখ যোগ্য ব্যাপার হল নূতন ক্যালেন্ডারে জুন আর সেপ্টেম্বর মাস ৩১ দিনের হয়ে গেছে যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ৩০ দিনের ছিল । এ ছাড়া জানুয়ারি, মে, জুলাই, আগস্ট আর অক্টোবর মাসগুলিরও এক দিন কর্তন হয়ে ৩০ দিনের করে দেওয়া হয়েছে । এই ক্যালেন্ডার মনে রাখার সহজ উপায় হল মার্চ মাসই প্রথম মাস যা ৩১ দিনের,  এর ঠিক তিন মাস পর পর ৩১ দিনের মাস আসবে । তার মানে জুন, সেপ্টেম্বর আর ডিসেম্বর ৩১ দিনের । 
২০১৭ থেকেই বা ক্যালেন্ডার শুরু করার প্রস্তাব কেন করা হয়েছে ? আসলে ২০১২ এর ১লা জানুয়ারির ঠিক পাঁচ বছর পর ২০১৭ এর ১লা জানুয়ারিতেই আবার একই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ঘুরে আসছে । তার মানে বছরের প্রথম দিনই রবিবার মানে সপ্তাহের প্রথম দিন । হেনরি ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে প্রস্তাব রাখা হয়েছে যে ১লা জানুয়ারি তারিখ থেকেই ‘আন্তর্জাতিক সময়’ ২৪ ঘণ্টা স্কেলের নিরিখে গণনা করা যেতে পারে । বিশ্বের প্রতিটি দেশে তারপর সময় আর তারিখ একই থাকবে । সময় আর তারিখ নিয়ে আর ঝঞ্ঝাট থাকবেনা । এটা সর্বজন বিদিত যে প্রশান্ত মহাসাগরের ১৮০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশের উপর অবস্থিত উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু অবধি কাল্পনিক রেখাকে ‘আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা’ বলা হয়ে থাকে । ধরে নেওয়া যাক ঐ রেখার বাঁদিকের কোন দেশের তারিখ ২২শে জানুয়ারি, তাহলে রেখাটির ডান দিকের দেশের তারিখ হবে ২১ জানুয়ারি । কিন্তু  নূতন ক্যালেন্ডার প্রবর্তিত হয়ে গেলে ‘আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা’-এর অস্তিত্বও বিলুপ্ত হয়ে যাবে । লন্ডনের গ্রিনউইচ মান মন্দিরে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬-তে ঠিক রাত বারোটার পরই গণনা শুরু হয়ে যাবে নূতন ‘আন্তর্জাতিক সময়’ । ১লা জানুয়ারি ২০১৭-তে সবদেশেই তখন হয়ে যাবে একই তারিখ, একই সময় । সেটা ব্রিটেন, রাশিয়া, ভারত, জাপান বা আমেরিকা যে দেশই হোক না !
     ‘আমাদের এই নূতন ক্যালেন্ডার প্রস্তাব রাখার মূল উদ্দেশ্যই হল জনসাধারণকে একটি স্থায়ী ক্যালেন্ডার উপহার দেওয়া যা বছরের পর বছর অপরিবর্তিত থাকবে । স্কুল, কলেজ থেকে কর্পোরেট সেক্টর সবাই সারা বছরের কর্মযজ্ঞ একবার ভাল করে ঠিক করে নিলে বছর বছর পরিবর্তন করতে হবে না’ । বলছেন রিচার্ড কন হেনরি, যিনি মেরিল্যান্ড স্পেস গ্র্যান্ট কনসরসিয়াম এরও ডিরেক্টর । তাঁর দৃঢ় আশা যে বিশ্বের জনসাধারণ এই ক্যালেন্ডার থেকে নানা ভাবে উপকৃত হবেন । আসলে এই ক্যালেন্ডারটি বব ম্যাকক্লেননের ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত ক্যালেন্ডারের সংশোধিত রূপ ।
     নুতন ক্যালেন্ডারে মোট দিন রয়েছে ৩৬৪ দিন । কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু বছরে সেটা হয়ে দাঁড়ায় ৩৭১ দিনে । কেন ? ব্যাপারটি বুঝতে হলে আমাদের আবার পৃথিবীর বার্ষিক গতির সময়ের দিকে চোখ রাখতে হবে । পৃথিবীকে সূর্যের চারিদিকে পাক খেতে সময় লাগে ৩৬৫.২৪২৫ দিন । ৩৬৪ দিনের ক্যালেন্ডার হওয়ায় এই অতিরিক্ত ১.২৪২৫ দিনকে মিলানোর জন্য প্রতি ৫ বা ৬ বছর পর অতিরিক্ত একটি সপ্তাহ ডিসেম্বরের পর জুড়ে দেওয়া হয়েছে । যাকে ‘লিপ উইক’ নামকরণ করা হয়েছে । সেই বছর গুলো হল ২০১৫, ২০২০, ২০২৬, ২০৩২, ২০৩৭, ২০৪৩, ২০৪৮, ২০৫৪, ... ইত্যাদি । ছবিটিতে  Xtr হল সেই অতিরিক্ত সপ্তাহ । আর তখন সেই নির্দিষ্ট বছর হয়ে যাবে ৩৭১ দিনের ।   
     এই ক্যালেন্ডারের সুবিধা কি ? কোনও ব্যক্তি যদি ১৭ ডিসেম্বর জন্মান তাহলে প্রতি বছরই তাঁর জন্মবার শনিবার থাকবে । তার মানে জন্মের বার কারও পরিবর্তিত হবেনা । ছুটির দিন পূর্ব নির্ধারিত থাকবে । বড়দিন আর ১লা জানুয়ারি প্রতি বছরই রবিবার থাকবে । গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের মত ছুটির বার নিয়ে আর অনিশ্চয়তা থাকবে না । ছুটির দিন প্রতি বছর বাড়া বা কমার ঝক্কি থাকবে না । আর প্রতি বছর ছুটির তালিকা বানানোর জন্য বৃথা সময় নষ্টও হবেনা । ‘আমাদের ক্যালেন্ডার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের জটিল হিসেব নিকেশ সহজ করে দেবে । স্থায়ী ক্যালেন্ডারের দৌলতে ব্যাঙ্কের সুদের হিসেব নিকেশ থেকে ধরে অন্যান্য কাজও অনেক সুবিধেজনক হয়ে যাবে । তাই এই ক্যালেন্ডার অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আমাদের লাভবানই করবে’ । বলছেন অর্থনীতিবিদ তথা এই ক্যালেন্ডারের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ডঃ স্টিভ হ্যাংকে । ক্যালেন্ডারে ৩১শে মার্চ শনিবার থাকায় নানা দেশের মত আমাদের দেশেও অর্থনৈতিক বছরের শেষে আর্থিক লেনদেনের সুবিধেই হবে । এর আগেও কিছু গবেষক বিকল্প ক্যালেন্ডারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন যেখানে সপ্তাহ সাত দিনের বদলে ছয় দিনের কথা বলা হয়েছিল । তবে সাত দিনের সপ্তাহের মিথ ভেঙ্গে কারো সম্মতি মিলেনি নুতন ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের । কিন্তু ‘হ্যাংকে–হেনরি পার্মানেন্ট ক্যালেন্ডার’-এ সপ্তাহ সাত দিন রাখার ফলে সেটা রয়েছে বেশ সুবিধেজনক অবস্থায় ।  
     নুতন ক্যালেন্ডারে যে অসুবিধে হবেনা এমন নয় । যাদের জন্ম ইতিমধ্যে ৩১শে জানুয়ারি হয়ে গেছে তাঁরা নুতন ক্যালেন্ডার প্রবর্তিত হয়ে গেলে তো ইহ জীবনে জন্মদিন উদযাপন করতে পারবেন না । যারা ডিসেম্বরের মাসের পর অতিরিক্ত সপ্তাহে জন্মেছেন তাঁদের তো পাঁচ বা ছয় বছর পর সেই দিন ঘুরে আসবে । যদিও হেনরি ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে বলা হয়েছে যে ৩১শে জানুয়ারিতে যাদের জন্ম তাঁরা  জানুয়ারির শেষ দিন মানে ৩০শে জানুয়ারিতে জন্মদিন উদযাপন করতে পারেন; কিন্তু সেটাও তো মেনে নেওয়া যায়না । সৌরবছরের সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার । কিন্তু অপরিবর্তিত ক্যালেন্ডার থাকার দরুণ ‘হ্যাংকে–হেনরি ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সৌরবছরের ছন্দ পতন ঘটবে । এ ছাড়া ২০১৫, ২০২০, ২০২৬ ‘লিপ ইয়ার’-এর  অতিরিক্ত সাত দিনের জন্য তো আলাদা ভাবে ভাবতে লাগবে । কারণ এই সাত দিন শ্রমিকেরা ডিসেম্বর মাসের শেষে কাজ করলে অতিরিক্ত বেতন পেতে পারেন কিনা সেটাও ভেবে দেখা দরকার । এই ক্যালেন্ডার নিয়ে তাই সারা বিশ্বে শুরু হয়েছে তর্ক-পাল্টা বিতর্ক । রাষ্ট্রপ্রধানরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দিকের ব্যাপারগুলো খতিয়ে দেখবেন ।  সব দেশেই যে আগামী ২০১৭ তে এই ক্যালেন্ডার মেনে নিতে পারে এরও কোনও নিশ্চয়তা নেই । আর যেহেতু প্রতি দেশের ঘড়ির সময় আলাদা, তাই একক আন্তর্জাতিক সময় মেনে নেওয়ার ব্যাপারেও থাকবে নানা প্রতিবন্ধকতা । সব মিলিয়ে বেশ কাঠখড় পুড়িয়েই এগোতে হবে হ্যাংকে–হেনরি ক্যালেন্ডারকে । তবুও তাঁদের বিশ্বাস পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি যেমন ১৫৮২ সালে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার সংস্কার করেছিলেন, ২০১৭ সালে হ্যাংকে–হেনরিও সেই অসাধ্য সাধন করতে পারবেন ।